somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কে বুদ্ধজীবী ? --------শহিদুল ইসলাম-৩

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১ম পর্বঃ
২য় পর্বঃ
৩য় পর্ব
রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সংমিশ্রণে রাজনীতি আজ সকল প্রকার নিষ্ঠুরতাকে অতিক্রম করেছে বলে মনে করেন সাঈদ। তিনি যুগোশ্লাভিয়ার উদাহরণ টেনে ধর্ম ও রাজনীতির সংমিশ্রণের ভয়াবহতা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের ধর্মভীরু অথচ রাজনৈতিক সচেতন মানুষ এ-বিপদ সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন। তাই সাঈদ একজন বুদ্ধিজীবীর পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া বাধ্যতামূলক বলে মনে করেন। এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর এই বইতে এন্টেনিও গ্রামসির প্রিজন নোটবুক-কে ভালোভাবে ব্যবহার করেছেন। গ্রামসি বুদ্ধিজীবীদের দুটি গ্রুপে ভাগ করেন। এক. ঐতিহ্যবাহী। দুই. জৈব বুদ্ধিজীবী। প্রথম দলে আছেন শিক্ষক, যাজক, পুরোহিত, মোল্লা এবং প্রশাসক। তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই কাজ করে চলেন। কিন্তু জৈব বুদ্ধিজীবীরা সরাসরি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন। তারা তাদের উদ্দেশ্যকে সংগঠিত করতে জানেন; শক্তি সঞ্চয় করতে পারেন এবং আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। গ্রামসি বিশ্বাস করেন যে, জৈব বুদ্ধিজীবীরা সমাজে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। তারা চিন্তার পরিবর্তনের জন্য নিরলস সংগ্রাম করে চলেন। নিজেদের সামাজিক ভূমিকা বাড়িয়ে চলেন। অন্যদিকে ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধিজীবীরা একইস্থানে স্থবির থাকতে পছন্দ করেন। চেনা রাস্তায় চলাফেরা করেন। অন্যপক্ষে জৈব বুদ্ধিজীবীরা সবসময়ে কর্মতৎপর ও চঞ্চল থাকেন। সবসময়ে নুতন কিছু সৃষ্টিতে তৎপর থাকেন।
এখানে গ্রামসি যাদের ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধিজীবী বলেন, তার সঙ্গে এডওয়ার্ড সাঈদের বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞাটির কিছুটা বিরোধ দেখা যায়। সাঈদের সংজ্ঞানুযায়ী একজন বুদ্ধিজীবী এমন একজন ব্যক্তি সমাজে যার একটি সুনির্দিষ্ট ভূমিকা থাকবে যে ভূমিকাকে একজন বিচ্ছিন্ন পেশাজীবীর সত্মরে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাকে কেবল একটি শ্রেণীর এমন একজন দক্ষ সদস্য হলেই চলবে না যিনি কেবল নিজের কাজকর্ম নিয়েই ব্যসত্ম থাকেন। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী গ্রামসির ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধিজীবী নামের অন্তর্ভূক্ত হতে পারেন না। এডওয়ার্ড সাঈদ একজন শিক্ষক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও আমেরিকান সাহিত্য পড়াতেন। কিন্তু সাঈদ যদি তাঁর শ্রেণীকক্ষের মধ্যে কেবল তার পেশায় নিয়োজিত থাকতেন, তাহলে কি তিনি আজ সারা বিশ্বে অন্যতম প্রধান বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন? পারতেন যে না এ-সত্যটি সন্দেহাতীতভাবে সত্য। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মতো হাজার হাজার শিক্ষক ইংরেজি ও আমেরিকান সাহিত্য পড়ান। তাঁরা কেউ এডওয়ার্ড সাঈদ হতে পারেন নি। শিক্ষকতার ক্ষুদ্র পেশাগত গণ্ডীর মধ্যে সাঈদ নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। আরো বিস্তৃত ও বৃহত্তর জগতে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যেসব লেখার জন্য সাঈদ আজ বিশ্বময় পরিচিত, তার সঙ্গে তার পেশাগত শিক্ষকতার কোন সম্পর্ক নেই। সেসব লেখা বা কথা তিনি কোনদিন তার শ্রেনীকক্ষে উচ্চারণ করেন নি। জানিয়েছেন সাঈদ নিজে। সকল ধর্মের ধর্মবেত্তাগণ মন্দির-মসজিদ-গির্জায় সারাজীবন একই শিক্ষা দিয়ে আসছেন যুগের পর যুগ। তাদের মধ্যে নুতন কিছু করার বা বলার প্রবণতা অনুপস্থিত। সে-ইচ্ছাও তাদের নেই। মানুষের ইহজাগতিক স্বাধীনতা ও জ্ঞান বৃদ্ধি তাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়। পারলৌকিক মুক্তিই তাদের শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। তাই বুদ্ধিজীবীর কর্মকান্ড পরিচালিত হবে মানুষের স্বাধীনতা এবং জ্ঞানকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে। সাঈদের এ-কথা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আর প্রশাসক/আমলা? তারা তো অন্য জগতের মানুষ। তারা তো জনগণের ছোঁয়া বাঁচিয়ে সংরক্ষিত এলাকায় বসবাস করেন। নিপীড়ক রাষ্ট্র যন্ত্রের তারা এক শক্ত খুঁটি। কাজেই সাঈদের সংজ্ঞানুযায়ী তারাও বুদ্ধিজীবীভূক্ত হতে পারে না। বিণয় ঘোষের সঙ্গেও গ্রামসির পার্থক্য লক্ষ করা যায়। বিণয় ঘোষ মনে করেন, মহা বিদ্বান হয়েও কেউ যদি অগাধ জ্ঞানসমুদ্রে তলিয়ে থাকেন, তারা বুদ্ধিজীবী নন। গ্রামসির ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধিজীবীরা তো এ-দলেই।
অন্যদিকে সাঈদ মিচেল্‌স ফুকোর কথা উল্লেখ করে বলেন যে, বুদ্ধিজীবীরা একটা শৃংখলার মধ্যে কাজ করলেও তাঁরা তাদের অভিজ্ঞতা যে-কোন দিকে পরিচালিত করতে পারেন। ফুকো বলেন, বুদ্ধিজীবী ছাড়া আধুনিক ইতিহাসে কোন বিপ্লব সংঘটিত হয়নি, তেমনি বুদ্ধিজীবী ছাড়া পৃথিবীতে প্রধান কোন প্রতিবিপ্লবও সংঘটিত হয়নি। তাই ফুকো বুদ্ধিজীবীদের এমনকি যে-কোন আন্দোলনের মা-বাবা, অবশ্যই পুত্র-কন্যা, ভাইপো-বোনপো বলে উল্লেখ করেন।
সাঈদ রাসেল জ্যাকোবাইয়ের দ্য লস্ট ইন্টেলেকচুয়্যাল : আমেরিকান কালচার ইন দ্য এজ অব একাডেমি বইটি থেকে বড় উদ্ধৃতির উল্লেখ করেন। জ্যাকোবাই তাঁর বইতে বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ননএকাডেমিক (অপ্রাতিষ্ঠানিক) বুদ্ধিজীবীরা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গেছে। সেই স'ান দখল করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভীরু এবং দুর্বোধ্য অধ্যাপকবৃন্দ, যাদের প্রতি সমাজের একজন মানুষও কোন গুরুত্ব দেন না।
জ্যাকোবাই মনে করেন বুদ্ধিজীবীরা শহুরে মানুষ। এর ফল হয়েছে এই যে আজকের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চিত আয়ের ক্ষুদ্র নিভৃত শ্রেণীকক্ষে নিজেদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করেন। শ্রেণিকক্ষের বাইরে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পৃথিবীর সঙ্গে কোন রকম সম্পর্ক স'াপন করতে চান না তারা। জ্যাকোবাই অভিযোগ করেন যে, এই ধরণের বুদ্ধিজীবীরা রহস্যজনক ও রুচিহীন গদ্য লিখে থাকেন যা কেবল অ্যাকাডেমিক উন্নয়ন ঘটায়-সমাজে বিন্দুমাত্র ঢেউ তোলে না। সুতরাং তার মতে, বর্তমানের এই নয়া রক্ষণশীল আন্দোলনের সময় একসময়ের স্বাধীন, প্রগতিশীল বামপন'ী বুদ্ধিজীবীরা খোলাখুলিভাবে প্রতিক্রিয়াশীল না হলেও, তারা রক্ষণশীল সামাজিক এজেন্ডার প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। আমেরিকার সবচেয়ে নামকরা প্রগতিশীল পত্রিকা নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানকার প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকাগুলো উঠতি লেখক ও সাংবাদিকদের টানছে, যাদের মধ্যে এককালের অনেক বামপন'ী বুদ্ধিজীবীও আছেন। সবশেষে জ্যাকোবাই বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে তার ধারণাটি প্রকাশ করেন এই বলে যে, চূড়ান-ভাবে স্বাধীন মানুষ তিনি যিনি কারও কোন প্রশ্নের জবাব দেন না। এভাবে একটি প্রজন্ম হারিয়ে গেছে এবং জ্যাকোবাইয়ের মতে, একদল মুখচাপা ও ক্লাসরুমটেকনিশিয়ান, যারা সহজেই প্রভাবশালী কমিটির ভাড়াটে বাহিনীতে পরিণত হতে পারেন কিংবা যারা সবসময়ে উৎসাহদাতা পৃষ্ঠপোষক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহকে তুষ্ট করতে সর্বদা ব্যসত্ম থাকেন কিংবা সেইসব শিক্ষাগত প্রশংসাপত্র এবং সামাজিক কর্তৃপক্ষ যা বিতর্ক সৃষ্টিতে উৎসাহ প্রদান করে না বরং যশ বা খ্যাতি এনে দিতে পারে এবং সেইসঙ্গে অবিশেষজ্ঞদের ভয় দেখায়, তাদের ভয়ে কন্টকিত হয়ে থাকেন, এমন ব্যক্তিরা সেই শূণ্যস'ান পূরণ করেছে।

চলবে.....................
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৩:৩৯
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×