মুভি দেখে আর যা-ই হোক, নেটে রিভিউ লেখার মানুষ আমি না। কিন্তু কিছু সময় আসে যখন ভালো কিছুর মুখোমুখি হয়ে আসলে কারো সাথে সেটা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছে প্রথম থেকে থাকা সত্ত্বেও এতদিন সুযোগ হচ্ছিলো না ‘গেরিলা’ দেখতে যাওয়ার, আজকে তাই যখন সুযোগ হয়েই গেল, তখন আর তা হারাতে চাইনি। দুপুরের শো তে বন্ধুদের সাথে মুভিটা দেখে আসলাম সিনেপ্লেক্স থেকে। বাসায় ফিরে যখন কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছে হলো কাউকেই পেলাম না। কোন এক অজানা কারণে আম্মুর মেজাজ খারাপ, বোন তার প্রতিদিনের প্যানপ্যানানি সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত আর সব কথা শেয়ার করার বন্ধুটিকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ভাবলাম একা মানুষদের সর্বশেষ জায়গা ব্লগেই এসে কথাগুলো শেয়ার করি।
এটা সেটা না বলে সরাসরি মুভির কথায়ই আসি। কাহিনীর শুরু পঁচিশে মার্চ রাতে। বাইরে অপারেশন সার্চলাইট, আর ভিতরে উদ্বিগ্ন স্ত্রী বিলকিস আর সাংবাদিক স্বামী হাসানের কথোপকথন। তারপর রাত পার হলো, দিন পার হলো, হাসান ফিরেনি। কিন্তু বসে থাকার পাত্রী নয় বিলকিস। ব্যাংক কর্মকর্তা এই নারীটি একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবিশ্রান্ত সাহায্যকারিণী, আরেকদিকে দায়িত্বশীল পুত্রবধূ। সেই সাথে চলতে থাকে স্বামীকে খুঁজে বের করার অসম্ভব প্রচেষ্টা। কিন্তু এতটাই কি সহজ একজন গেরিলার জীবন ? তাও আবার সে যদি হয় একজন মেয়ে ? নাহ, তাহলে মিলিটারীরা এসেছিল কেন এ দেশে ? আর তাদের পা-চাটা জামাত (এদের নামের সাথে ইসলাম শব্দটা আমি কখনোই ব্যবহার করিনা, কারণ এতে আমার ঘৃণা হয়। ), রাজাকার, শান্তি বাহিনীদেরই বা কি দরকার ছিল? তাই হয়নিও জীবন এত সহজ। একসময় নিরাশ্রয়, সম্পূর্ণ পৃথিবিতে একলা মেয়েটিকে নেমে আসতে হয় রাস্তায়।
বাকিটা...হলে গিয়ে দেখে নিবেন।
অভিনয় নিয়ে এই মুভির কথা যতই যা-ই বলি, কম হবে। জয়া আহসান সবসময়ই শক্তিশালী অভিনেতা, কিন্তু সৈয়দা বিলকিস বানুর চরিত্রে তিনি যেন নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। মিলিটারীর দ্বৈত ভুমিকায় শতাব্দী ওয়াদুদ অপরিসীম ঘৃণা পাবেন। আলতাফ মাহমুদের চরিত্রে আহমেদ রুবেল, মিসেস খানের চরিত্রে শম্পা রেজা, এমনকি সামান্য দুধওয়ালার দুটা দৃশ্যের যে অভিনেতা,তার কষ্টটাও মনে রেখে দেয়ার মত।
এবার আসি ডাইরেকশন বা মেকিংয়ের কথায়। এখানেই এই মুভিটি আর দশটি মুভি থেকে আলাদা। যতটা সরাসরি এই মুভিতে মুক্তিযুদ্ধের নির্মমতাকে তুলে ধরা হয়েছে আর কখনো কোন সিনেমাই সেটা তুলে ধরতে পারেনি বা ধরেনি। বর্তমান প্রজন্ম বই পড়ে না, এই ভয়াবহ ইতিহাসটা এদের অনুভব করা তো দূরের কথা, এরা এগুলো জানেই না। এদেরকে এগুলো জানতে হবে। ইতিহাস কি মুক্তিযুদ্ধকে বলা ঠিক? আমার মনে হয় না, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্বের অংশ, আমাদের পরিচয়ের ভিত্তি। আর এই কথাগুলো আসলেই অনুভব করা যায় এখানে। পুরো সিনেমাটিতে যেটা বলতেই হবে, অসাধারণ একটা দরদ দিয়ে তৈরী সিনেমাটি। মুক্তিযুদ্ধ যখন একটি সিনেমার বিষয়, তখন শুধু সেটা বানানোর জ্ঞাণ, ভালো কাহিনী বা চিত্রনাট্য আর ভালো অভিনেতা থাকলেই হয় না, এই সবকিছুর থেকে সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা ভালোবাসা, গোয়ার্তুমি আর অনুভব করার ক্ষমতা।
ভালোবাসা এই দেশটার জন্য, গোয়ার্তুমি নিজেদের অতীতকে আঁকড়ে রাখার, নিজেদের ভিত্তিকে ভুলে না যাওয়ার আর অনুভব করার ক্ষমতা ঐ সময়টাকে আর ঐ সময়ের মানুষগুলোকে।
আর এখানেই সফল ‘’গেরিলা’’বাহিনী। সিনেমার ডাইরেক্টর, রাইটার থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিটা মানুষ। আর তাই ১২০ মিনিটের সিনেমা শেষে প্রতিটা মানুষের হল থেকে বের হবার সময় চোখে ছিল অশ্রু, চেহারায় গর্ব আর বুক ভরা সম্মান নিয়ে।
অশ্রু এই দেশটার জন্য।
গর্ব নিজের বাংলাদেশী পরিচয়টার জন্য।
আর সম্মান...
তার সবটুকু ঐ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।
ট্রেইলার লিঙ্ক।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১১ রাত ১:৩৪