somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙ্গলাবর্তের অনার্য ধর্মসমূহ, যা অন্ত্যজ হিন্দুদের জানা প্রয়োজন

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ৮:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাঙ্গলাবর্তে আর্যদের উপনিবেশায়নকালে অনার্য জনগোষ্ঠী নিষাদ, দ্রাবিড় ও তিব্বতীয়-বর্মী ইত্যাদি অনার্য ভাষায় কথা বলতো এবং বহুধা বিভক্ত নৃগোষ্ঠিসমূহ লৌকিক ধর্মসমূহ পালন করতো। মধ্যযুগে বিরাজমান ধর্ম-পরিস্থিতি থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, পূর্বকালে এতদাঞ্চলে চণ্ডী পূজা, মনসা পূজা ও ধর্মপূজা নামক লৌকিক ধর্মানুষ্ঠানের প্রচলন ছিলো। স্থানভেদে লৌকিক ধর্মের ধরণ অভিন্ন ছিলো না। উদাহরণস্বরূপ, রাঢ় ও বঙ্গে যথাক্রমে ধর্মপূজা ও মনসা পূজার প্রাধান্য ছিলো। আবার কিরাত শ্রেণির নৃগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে চণ্ডী পূজার প্রচলন ছিলো। সম্প্রদায়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় রীতিনীতি ও উৎসব পালিত হতো। কিন্তু সেই যুগে পালিত ধর্মগুলোর সঠিক কোন লিপিবদ্ধায়িত ইতিহাস নেই। এসব ধর্মের ইতিহাস আমাদের হাতে এসে পৌঁচেছে, আর্যায়ন উত্তরকালে লিখিত ইতিহাসের মাধ্যমে। কাজেই এ সব ধর্মের যে ইতিহাস আমাদের কাছে পৌঁচেছে, তা আদি ও অকৃত্রিম নয়। কারণ আর্যদের উপনিবেশায়নের ফলে আর্য পৌরহিত্যে অনার্য ধর্মসমূহের সাথে শ্রমণিক ও পৌরাণিক ধর্মের সংশ্লেষণ ঘটে। অনার্য জনগোষ্ঠীতে যে সব ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিলো বলে ধর্মীয় ইতিহাসে লিখিত হয়েছে, তার অন্যতম হলো:

১) মনসা পূজা
বাঙ্গলাবর্তে সর্প পূজা একটি প্রাচীন অনুষ্ঠান। মনসা সাপের দেবী। তিনি মূলত লৌকিক দেবী। পরবর্তীকালে পৌরাণিক দেবী রূপে স্বীকৃত হন। শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে মনসা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। জাতিবর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু সম্প্রদায় আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে দেবী মনসার পূজা পালন করে থাকে। বর্ষার প্রকোপে এ সময় সাপের বিচরণ বেড়ে যায়, তাই সাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভক্তকূল দেবীর আশ্রয় প্রার্থনা করে। এছাড়া ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতির জন্য সর্পদেবীর ভক্ত তার দ্বারস্থ হয়। আদি পুরাণগুলিতে মনসার কোনো উল্লেখ নেই। অপেক্ষাকৃত নবীন পুরান ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান ও দেবীভাগবত পুরাণে মনসার উল্লেখ রয়েছে। মধ্যযুগের সাহিত্যকর্ম মনসামঙ্গল কাব্যে মনসার মাহাত্ম্য নিয়ে রচিত হয়েছে নানা গাঁথা ও পাঁচালি।

২) চণ্ডী ও কালী পূজা
চণ্ডী, কালী ও দূর্গা ইত্যাদি দেবী আদ্যশক্তির প্রতীক। আদ্যশক্তি হলো স্ত্রীলিঙ্গীয় দেবতাসমুচ্চয়ের সামগ্রিক রূপ। চণ্ডী বা চণ্ডিকা দেবীমাহাত্ম্যম গ্রন্থের সর্বোচ্চ দেবী। তিনি দুর্গা সপ্তশতী নামেও পরিচিত। চণ্ডী ও কালী পূজা অপেক্ষাকৃত পূর্বকালে প্রচলিত ছিলো, কিন্তু অপেক্ষাকৃত আধুনিক যুগে শক্তি পূজার নতুন অনুষঙ্গ হিসাবে দূর্গা পূজা যুক্ত হয়েছে। বাঙ্গলায় মুচি ও হাড়ি প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর ব্যক্তিরা এককালে শক্তির উপাসক ছিল। বৌদ্ধযুগে শক্তির পূজা ক্ৰমশঃ বিলুপ্ত হয়, শেষে মুচির হাতে পৌরোহিত্যের ভার পড়ে—শূন্যপুরাণের দুই একটি কথায় উহাই অনুমিত হয়। সেজন্য দুৰ্গাকে কখনও কখনও ‘হাড়ির মেয়ে’ বলা হয়। কারণ হাড়ির বাড়ীতে বাদ্য না বাজলে কোনও কোনও স্থানে দুৰ্গা পূজা আরম্ভই হতো না¬― এরূপ জনশ্রুতি রয়েছে।

৩) ধর্মপূজা
ধর্মপূজা হলো লৌকিক ধর্মবিশ্বাস ভিত্তিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই পূজার বিধি-ব্যবস্থাদি রামাই পণ্ডিত রচিত ‘শূন্যপূরাণ’ ও ‘ধৰ্ম্মপূজা-পদ্ধতি’ প্রভৃতি পুস্তকে পাওয়া যায়। ধর্মপূজায় গীত ধর্মের আখ্যান ছিলো এর মূল বিষয়। শস্য উৎপাদন ও প্রজননকে কেন্দ্র করে কতগুলি ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাস ও ক্রিয়াকর্মের মধ্য দিয়ে ধর্মপূজার উদ্ভব হয়েছে। পূর্বকালে অনার্য সমাজের নিকট পাহাড়, গাছ ও সাপ ছিলো যথাক্রমে পৃথিবী, অরণ্য ও প্রজনন শক্তির প্রতীক। এই শক্তির প্রতিভূ হলো ধর্মঠাকুর। ধর্মঠাকুর হলো সূর্যের প্রতীক, যা ধর্মরাজ নামেও পরিচিত। তিনি বাঙ্গলার অন্যতম অনার্য দেবতা। এই অনার্য দেবতা ধর্মঠাকুরকে তুষ্ট করতে ধর্মপূজার আয়োজন করা হয়। এ পূজার প্রধান পুরোহিত হচ্ছে ডোম; তবে কৈবর্ত, শুঁড়ি ও বাগদিরাও এ পূজার পৌরহিত্য করতে পারে। বাৎসারিক ধর্মপূজা কোথাও কোথাও ‘দেউল’ নামে পরিচিত। ধর্মপূজার প্রধান উৎসব গাজন নামে অভিহিত।

আর্যদের উপনিবেশায়ন পর্বে অনার্য ধর্মসমূহ অনুষ্ঠিত হতো লৌকিক পর্যায়ে। আর্যগণ উপনিবেশ স্থাপনের পূর্বেই বাঙ্গলাবর্তে শ্রমণিক ধর্মসমূহ প্রবেশ করে। গুপ্ত যুগে (খ্রিষ্টীয় ৩২০ থেকে ৫৫০ অব্দ) মধ্য-গাঙ্গেয় অঞ্চলে শ্রমণিক ধর্মসমূহের বিপরীতে পৌরাণিক ধর্মের বিকাশ ঘটে। আর্যদের উপনিবেশায়ন শুরু হলে, আর্যদের পৌরহিত্যে পৌরাণিক ধর্মের সাথে সংশ্লেষণের মাধ্যমে অনার্য ধর্মগুলোর রূপান্তর ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ শুরু হয়। এভাবে অনার্য সমাজে শ্রমণিক ধর্মগুলোর প্রাধান্যে বৈদিক ধর্মগুলোর বিস্তৃতি বাধাগ্রস্থ হয়। এ প্রেক্ষিতে পৌরাণিক ব্রাহ্মণগণ অনার্য সমাজে তাদের পৌরহিত্য প্রতিষ্ঠিত করতে, স্থানীয় দেবদেবীদের স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে অনার্যদের ধর্মকে পৌরণিক ধর্মের অঙ্গীভূত করতে শুরু করে, যার ফল হয় সুদূরপ্রসারী।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ৮:০১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামাস বিজয় উৎসব শুরু করেছে, ইসরায়েল বলছে, "না"

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:০৮



গতকাল অবধি হামাস যুদ্ধবিরতী মেনে নেয়নি; আজ সকালে রাফাতে কয়েকটা বোমা পড়েছে ও মানুষ উত্তর পশ্চিম দিকে পালাচ্ছে। আজকে , জেরুসালেম সময় সন্ধ্যা ৮:০০টার দিকে হামাস ঘোষণা করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×