আম পাবলিক হওয়ার অনেক ঝামেলা। ঝামেলা গুলো ইদানিং ফেস করতে শুরু করেছি।
অনেক ভেবে দেখলাম এইসব ঝামেলা থেকে রক্ষা পাওয়ার সব থেকে সহজ উপায় হচ্ছে বুদ্ধিজীবি হয়ে যাওয়া। সন্দেহ হচ্ছে? তাহলে আসুন দেখুন কিভাবে বুদ্ধিজীবি হলে আমার ঝামেলামুক্ত দিন কাটতো!
১।
ঘুম থেকে একটু সকাল সকাল উঠতাম। ফ্রেশ হয়ে পরতাম সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবী। কারণ সাদা রংটা বুদ্ধিজীবিত্বের সাথে বেশ মানিয়ে যায়। ও হ্যা! মোটা ফ্রেমের চশমাটা পরতে ভুলতাম না।
তারপর বারান্দায় ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে পড়তাম। ওখানে আগে থেকেই সবক'টা জাতীয় দৈনিক রাখা থাকবে। আস্তে আস্তে চোখ বুলাতাম সবকটা পত্রিকায়। কিছু কিছু খবর খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তাম। যায়গায় যায়গায় কপাল কুচকাতাম। এর ফাকে কাজের মেয়ে চা নিয়ে আসতো। আমি চায়ের কাপ নেওয়ার অজুহাতে আস্তে করে মেয়েটার হাত ছুয়ে দিতাম। মেয়েটা হয়তো বেশ বিব্রত হতো। হলে হোক! আমার ওটা দেখার সময় নেই। পত্রিকায় অনেক খবর এখনো পড়া বাকি। দেশের দুরবস্থা দেখে অনেক কপাল কুচকানো বাকি।
২।
পত্রিকা পড়া শেষ করে কলম আর খাতাটা বিয়ে বসতাম। পত্রিকার জন্য কলাম লিখতে হবে। অনেক কাজের ভিড়ে পত্রিকা গুলোর জন্য কলাম লেখার সময় বের করাটা তখন বেশ কষ্ট হবে। হোক কষ্ট। দেশের জন্য; গনতন্ত্রের জন্য একটু কষ্ট না হয় করলামই।
কলাম লেখাটা একটু ঝামেলারই বটে। আগে দেখতে হবে কোন পত্রিকায় লিখছি। আমার দেশ-এ হলে একরকম লেখা লিখতে হবে। আবার প্রথম আলো হলে অন্যরকম।
যেমন আমার দেশের জন্য হলে কিছু শব্দের ব্যাবহার অবশ্যই করতে হবে। যেমন ট্রানজিট, প্রতিবেশী দেশ, সীমান্ত, মুদ্রাস্ফীতি, দালাল এইসব।
আবার প্রথম আলোর জন্য হলে অন্যরকম শব্দ লিখতে হবে। যেমন- যুদ্ধাপরাধ, গনতন্ত্র, সুশীল, জবাবদীহিতা, সুশাষন ইত্যাদি।
৩।
কলাম লেখাটা শেষ করে একটু রবীন্দ্র সঙ্গীত ছাড়তাম। রবীন্দ্র সঙ্গীত আসলেই চমৎকার জিনিষ। কি জীবন বোধ একেকটা গানে। অসাধারণ! এক কথায় অসাধারণ। আমাদের তরুন সমাজ আজকাল এসব একদম শুনে না- এইটা ভেবে খানিকক্ষন আফসুস করতাম।
হাতে টিভির রিমোট নিয়ে একটু চ্যানেলগুলোতে ঘুরে আসতাম। ভারতীয় কোন ছবি চললে ঐটা দেখে ফেলতাম এক সুযোগে। রগরগে কোন দৃশ্য থাকলে একটু মনযোগ দিয়েই দেখতাম। দেখে টেখে কিচ্ছুক্ষন কপাল কুচকাতাম। কি হচ্ছে এসব! এগুলো আজকাল দেশের সংস্কৃতির সাথে মিশে যাচ্ছে। কোন মানে হয়!!
৪।
দুপুরের সময়টা হতো সভা সেমিনারের। প্রেস ক্লাব কিংবা চিন মৈত্রী সম্মেলনে ডাক পড়তো। দেশের কঠিন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আলোচনা করে দেশের সব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে হবে। স্যুটেড ব্যুটেড হয়ে দেশের নির্যাতিত নিপিড়িত মানবতার কল্যান নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতে হবে।
ঐ সেমিনারের পরে ওখানেই হালকা একটা মানব বন্ধন করে ফেলতে হবে। ওখানে সব টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা মাইক ধরবে। আমাকে চোখে মুখে উদ্ধিগ্ন ভাব নিয়ে বিবৃতি দিতে হবে।
৫।
সন্ধ্যার দিকে বাসায়ই থাকতাম।
বাসায়ই চলে আসতো টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাগুলো। তাদের আবার অনেক অনেক মতামত দিতে হয়। যেমন
উইকিলিক্সে বাংলাদেশ; বিষয়ক তথ্যফাস আমার মতামত।
সম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসন; আমার মতামত।
সরকারের ২ বছর; আমার মতামত।
ইত্যাদি ইত্যাদি। এই মতামতগুলো তাদের লেট নাইট নিউজের আইটেম হিসেবে যাবে।
৬।
রাতে শুরু হবে আমার প্রধান কাজ। দেশ উদ্ধার করার জন্য রাতটাই পারফেক্ট। টিভি চ্যানেল গুলো টকশো-র মাধ্যমে দেশ উদ্ধারের ইজারা নিয়ে নিয়েছে। ঐ টকশো গুলাতে টক করতে হবে।
টক শোর টকার হওয়াটা বেশী কঠিন কিছু না। চলমান কোন বিষয়ের সাথে উপযুক্ত কিছু শব্দ ব্যাবহার করতে পারলেই হলো।
উধাহারণ দেই। চলমান শেয়ার বাজার নিয়ে কথা বলতে গেলে এই শব্দ গুলো ব্যাবহার করতে হবে- আন্তর্যাতিক বাজার, সাম্প্রতিক বিশ্বমন্দা, বাজারের অস্থিতিশীলতা, জনরোষ, সরকারের সদিচ্ছা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
৭।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে!
বাসায় এসে পত্রিকা অফিসে ফোন করতাম। লেখার বিল দিতে দেরী করায় তাদেরকে একচোট ঝাড়ি দিতাম।
ঘুমাতে যাওয়ার আগে কিছু ফোন আসতো।
যেমন মানবাধিকার সংস্থার কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার।
-"স্যার! সিঙ্গাপুরে আমাদের একটা সেমিনার আছে। আপনাকে কিন্তু ওখানে মুল্যবান বক্তৃতা দিতে হবে। সমস্যা নেই স্যার! ওখানে পাচ তারা হোটেলে থাকবেন আপনি। সার্বক্ষনিক পরিবহন ব্যাবস্থাও দেওয়া হবে আপনাকে। বিনোদনের কোন অসুবিধা হবে না।"
ফোন রেখে আমি আবার কপাল কুচকাবো! আবার বিদেশে যেতে হবে!
হোক! মানবাধিকারের কাজ করতে বিদেশে গেলেও সমস্যা কি! অভাগা দেশের জন্য আরেকটু কষ্ট না হয় করলামই।
আচ্ছা! সিঙ্গাপুরে সি বিচ আছে না! ওখানে তো মনে হয় স্বল্পবসনাদের অভাব হবে না!
সিঙ্গাপুরের সি বিচের স্বল্পবসনাদের কথা চিন্তা করতে করতেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়বো। স্বল্পবসনাদের সাথে হয়তো এক চোট সুখস্বপ্নও দেখে ফেলতে পারি।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:০২