আমি চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। সেদিন স্কুলে কি মনে করে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই পড়িস কেন?’
-আমি আর কই পড়ি ?
-এই যে তুই পদার্থ-রসায়ন-জীব সবগুলাই ত অনেক ভাল করে পড়িস...মানে, তোর সিলেবাস ত মাত্র দেড় মাসেই শেষ ।
-আরে সাইন্সেরগুলা পড়ি কারণ যখন ইউনিতে যাব, তখন বিজ্ঞান ভাল পারা বড় ভাইদের দামই আলাদা... জুনিয়র মেয়েরা পড়া বুঝায় নিতে আসে............ (বাকিটুকু অশ্লীল, তাই লিখলাম না)
যার সঙ্গে এই কথোপকথন সে ‘একটু’ মেয়েঘেষা, তাই খুব বেশি অবাক হইনি ।
আরেকদিন ম্যাথ অলিম্পিয়াডে ন্যাশনাল পর্যায়ে যাওয়া একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি ম্যাথ অলিম্পিয়াডে কেন যাও?
-ভাল লাগে তাই ।
-হুম, ভালো ত লাগে । কিন্তু কেন?
- দেখ, সিম্পিল হিশাব, আমার ইচ্ছা IMO (International Math Olympiad) তে যাব, IMOতে যাইতে পারলে অন্যরকম ‘দাম’ ।
- ত?
-ত ইচ্ছা মত মেয়ে বিয়ে করতে পারব। (আরও কিছু কারণ দেখিয়েছিল সেগুলো হাস্যকর)
- ও ...।
এবার অবাক হয়েছি, বেশ অবাক হয়েছি। তার কাছ থেকে এধরণের উত্তর আশা করি নি। আমি জানতাম সে ম্যাথকে ভালবাসে, তাই অলিম্পিয়াডে যায়। আমি অবশ্য নিশ্চিত নই তার উত্তরটা শুধু মজা করার জন্য ছিল কিনা । তবে তার কথা বলার ধরণে তেমনটা মনে হয় নি ।
এবার নিজেকেই প্রশ্ন করে বসলাম, আমি কেন পড়ি । নিজের কাছে নিজে যেই উত্তরটা দিয়েছিলাম সেটা অনেকটা এরকম, ‘মামনি-বাবা পড়তে বলে তাই পড়ি, ছোটবেলা থেকেই পড়তেছি তাই পড়ি, না পড়লে চাকরি পাব না,চাকরি না পাইলে খাব কি?! আর ভাল কিছু না করতে পারলে ত বউও... (আমার চিন্তাও দেখি, ঐ এক জায়গায় যায়)...।’
জ্ঞানীরা বলেন পড়াশুনার উদ্দেশ হলো জ্ঞানার্জন । সত্যি বলতে, যে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের ইতিহাস পাল্টে যায়, যে দেশে বইয়ের শিশুকে হিজাব পড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতার উৎস বানানো হয়,যে দেশে বছরে পাঁচবার(মতান্তরে ছয়বার) ইংরেজির সিলেবাস চেঞ্জ হয়, যে দেশে বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ভুল থাকে,যে দেশে গাইড বই নিষিদ্ধ হয়না, কোচিং-বাণিজ্য চলে দেদারে (যার বেশির ভাগই ‘অশুভ শক্তি’র হাতে বন্দী) সে দেশের পাঠ্যপুস্তক পড়ে জ্ঞানী হওয়া যায় না। বড় জোর পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ঠোঙা বানানো যায়। ঠোঙায় জ্ঞান থাকে না, পেঁচানো-পেঁচানো জিলাপি থাকে।
তাই আমরা জানার জন্য পাঠ্যবই পড়ছি না, পড়ছি পরীক্ষার খাতায় কে কতটুকু বমি করতে পারি সে প্রতিযোগিতায় নামার জন্য ।
‘পরীক্ষা’ জিনিসটিও আমার মাথায় ঢুকে না। এটি নিয়ে প্রশ্ন করলে খুব সাধারণ যে উত্তরটি পাওয়া যাবে সেটি হলো, ‘কে ভাল ছাত্র কে খারাপ ছাত্র, সেটা জানার একটা প্রক্রিয়া।’ মানে পরিষ্কার করলে বলতে হয় ভাল আর খারাপ ছাত্রের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা। আচ্ছা, পার্থক্য হলো, আপনারা জেনে গেলেন কারা ভালো। তাদের নিয়ে দেশ গড়লেন, উন্নত সমাজ গড়লেন। আর যাদের খারাপ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা কোথায় গেলো ?! ধরে নিলাম, ডারউইন সাহেবের উক্তি মেনে নিয়ে কিছু কিছু দুর্বলেরা বিলুপ্ত(আত্মহনন) হলো। তারপরও যাদের কই মাছের প্রাণ কিংবা চক্ষুলজ্জা নেই(!), তাদের কি হবে ? তাদের ত আগেই বাদ দিয়েছিলেন, তারা ত পিছনেই পড়ে আছে, আবার তারাও আপনার উন্নত(!) দেশের নাগরিক। উন্নত দেশে অনুন্নত মানুষ ব্যাপারটা একটু কেমন কেমন না...!?
আমি ঠিক বুঝি না, কেন আমাকে সেরা হতে হবে : পড়াশুনায়, কেন আমাকে বিতর্কে শ্রেষ্ঠ হতে হবে, কেন আমাকে আঁকতে হবে সেভাবেই যেভাবে আমাকে শেখানো হয়েছে, কেন আমি আকাশের রঙ ঘন সবুজ দিতে পারি না, কেন আমাকে সাধারণ একটি ১০০ মিটারের দৌড়ে প্রথম হতে হবে, যখন আমি জানি জীবনের দৌড় আরও অনেক বাকী। আমরা কি ক্রীতদাস নাকি মস্তিষ্কহীন রোবট। সবথেকে ভালো শেষ পর্যন্ত একজনই হয়, কিন্তু জন্ম দেয় অজস্র সবথেকে খারাপের ।
জনৈক খারাপ ছাত্র বলেছিলেন, ‘Everyone is genius. But if you judge a fish by its ability to climb a tree, it will live its whole life believing that it is stupid.’
আমি বলছিনা পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করা হোক, কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনা হোক যে মাছকে যেন আর গাছে উঠতে না বলা হয়।
সমস্যাটা আসলে সিস্টেমে না, আমাদের মধ্যে। আমরা পর্ণ দেখে অনেক কিছুই শিখি, কেউ কেউ নাকি বাস্তবেও চেষ্টা করে, কিন্তু 3 idiots অথবা চলো পালটাই এর মত মুভি যতক্ষণ চোখের সামনে চলে ততক্ষণ দেখি, তিন ঘণ্টা শেষ হলে, আবার ‘সৃজনশীল গাইড’ নিয়ে সৃজনশীলতা মুখস্থ করি। (এই ‘সৃজনশীল গাইড’ মালটা আসলে কি? ক্লাস ফাইভে পোলাপান আমাকে জিগাইত কবিতা লেখা শিখছি কিভাবে। তখন সৃজনশীল গাইড ছিল না, থাকলে বলতাম সৃজনশীল গাইড পড়ে শিখছি)
নান্না, আর লেখা যাবে না... পড়তে বসা লাগবে। ‘১৫র এস.এস.সি. পরীক্ষার্থী আমি। গোল্ডেন ত পাওয়াই লাগবে ...। আমার ‘পাঞ্জেরীর’ ‘গণিত সৃজনশীল গাইড’টা দেন কেউ......।