পৃথিবীর যে বিষয়টা নিয়ে আমি একেবারেই লিখতে পারিনা তা হচ্ছে ভূত। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে ভূত-টুত বিশ্বাস করা চিরকালই হারাম ছিল। আর আমার কথা হচ্ছে, যে জিনিসটা জীবনে দেখিইনি এবং যা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই, তা সম্বন্ধে আবার লিখে কিভাবে? মাঝখানে কিছুদিন অবশ্য চেষ্টা করেছিলাম, লেখার শেষমেষ দেখা গেল ওই ভাঁটার মতো চোখ, মূলার মতো দাঁত, সিঙাড়ার মতো নাক, বিরাট বিরাট কান আর শনের মতো চুলওয়ালা জন্তুবিশেষ জানালার পাশ থেকে কিংবা খাটের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে। নামও দেখা গেল মাথা থেকে ওইরকমই বের হচ্ছে, ‘মামদো ভূত,’ ‘স্কন্ধকাটা,’ ‘বাঁশভূত, ‘মাছভূত’ ইত্যাদি ইত্যাদি। নতুন কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনা। বরং সবগুলো গল্পই বিশ্রী ধরনের রম্য হয়ে যাচ্ছে। একবার শাকচুন্নি পরিবার নিয়ে লেখা একটা ভূতের গল্প বিরাট উৎসাহ নিয়ে ম্যাগাজিনে পাঠিয়েছিলাম, দেখি তারা রম্য নামে ছাপিয়ে দিয়েছে। তাই বিরক্ত হয়ে ছেড়েই দিয়েছি ভূতের গল্প লেখা।
যাই হোক, আমার রম্যরূপী ভূতূড়ে লেখাটাই ব্লগে দেব বলে দিনকয়েক আগে লিখে শেষ করছিলাম, এমন সময় ঘটল কান্ডটা। সে এমনই কাণ্ড, যার কাছে আমার অখাদ্য সে গল্প তুচ্ছ তো বটেই, পান করারও অযোগ্য বলা যায়।
আইডিয়াটা পেয়েছিলাম আমার দাদীর কাছে অনেক আগে শোনা এক কাহিনী থেকে। কাহিনী আমার ছোটকাকাকে নিয়ে, যিনি ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন যুবক। একটা মাদ্রাসায় পড়াতেন, কালো চাপদাড়িতে তার চেহারায় আলাদা একটা নূরানী ভাব চলে এসেছিল।
তো ঘটনা হল, কাকা একবার গভীর রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে উঠোন পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে গিয়েছেন, এমন সময় নারী কন্ঠে নিজের ডাক শুনতে পেলেন। যতোটা অবাক হওয়ার কথা ততোটা হলেন না, কারণ তিনি জানেন এটা হচ্ছে মেয়ে জ্বিন। জ্বিনদের কাজই হচ্ছে সুন্দর সুন্দর মানুষদের বিরক্ত করা। আমাদের সমাজে তো ইভটিজিং প্রচলিত, জ্বিনেরা ইভটিজিং-অ্যাডামটিজিং দুটোতেই অভ্যস্ত। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল যখন সেই মিস জ্বিন তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। শুনে তিনি ঠায় দুই মিনিট তাঁর সামনের সাদা ইয়া লম্বা পর্দার মতো ‘জিনিস’টার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর গোঁ গোঁ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। আর মিস জ্বিন তার প্রপোজালের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে রেগেমেগে কাকাকে এমনই থাপ্পড় দিল যে তাঁর চাপদাড়ির শেপ বদল হয়ে গেল, এমন কি ডান গালে পার্মানেন্টলি দাগ কালো ক্ষত পর্যন্ত পড়ে গেল। সে ক্ষত নাকি আবার অমাবস্যার রাতে কাকার কাছে ভিজে ভিজে লাগত, তিনি বলতেন জ্বিনটা নাকি তাঁর জন্যে কান্নাকাটি করছে। পরে তিনি মাঝে মাঝেই উদাস গলায় বলতেন, ‘অজ্ঞান হওয়া উচিত হয়নাই। বিয়া কইরা ফালাইলেই পারতাম। জ্বিনও আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি, তাদের বিয়া করলে পাপ নাই। বরং অবলা এক নারী জ্বিন বড়ই খুশি হইত।‘ তাহলে কেন তখন বিয়ে করেননি, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন কেন জিজ্ঞেস করলেই অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি নাই নাকি? বাচ্চাটা কিরাম হবে ভাইবা দেখছ?’
এবং কাকার সেই দাগের জন্যেই পরে তাঁর বিয়ের সময় কনে পেতে জান বের হয়ে গিয়েছিল।
এই ঘটনাকে ভিত্তি ধরে সেই গল্প ফাঁদলাম। পার্থক্য হচ্ছে কাকার জন্যে ফিদা হওয়া নায়িকা ছিল জাতে জ্বিন, আর আমার গল্পের নায়িকা পরমাসুন্দরী এক শাকচুন্নি। সে এতোই সুন্দরী যে, সে যে শ্যাওড়া গাছে থাকে সে শ্যাওড়া গাছই আলোকিত হয়ে যায়।
এখানে বলা দরকার, আমার দৃষ্টিতে ভূতেদের সবকিছুই হচ্ছে মানুষের উলটা। তাই আলোকিত মানে আসলে অন্ধকারাচ্ছ হয়ে যাওয়া, যেটা ভূতের খুব পছন্দ। আমাদের সুন্দরীরা হয় টানা টানা চোখের, টিকোলো নাকের, চিকন ঠোঁটের। তাদের চুল হয় রেশমের মতো, গায়ের ত্বক হয় মাখনের মতো। আর শাকচুন্নি সুন্দরীরা হয় সিরিশ কাগজের মতো ত্বক বিশিষ্ট, মুখ তাদের বর্ষার ঘনকালো মেঘের চেয়ে কয়েক পোঁচ কালো! চুল হয় তাদের শনের মতো, জট পাকিয়ে এমন বিতিকিচ্ছিরি হয়ে থাকে যে মনে হয় দড়ির গোছা। আমাদের সুন্দরীদের চুল থেকে স্ট্রবেরী শ্যাম্পুর ঘ্রাণ বের হয়, আর শাকচুন্নিদের চুল থেকে বের হয় পঁচা শ্যাওলার গন্ধ! কিন্তু ভূতদের কাছে এসবই হচ্ছে রূপের লক্ষণ। যে শাকচুন্নির চুলে যতো জট থাকে, তার চুল হচ্ছে ততো সুন্দর। আমার মাথায় ভূতদের রূপ সম্বন্ধে এমন আজব ধারণা ঢুকল কিভাবে বলা মুশকিল, কিন্তু বিখ্যাত ভূতূড়ে গল্প লেখক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ও শাকচুন্নিদের রূপ(!) এভাবেই বর্ণনা করেছেন!
তো, সেই রূপসী শাকচুন্নিকে নিয়েই গল্প লিখেছিলাম, যে কিনা নিজের কুচকুচে কালো রঙে, শনের মতো চুলে আর চুলের অতি উৎকট শ্যাওলা পচা গন্ধ নিয়ে তিতিবিরক্ত। যেখানেই যায়, চুলের প্রশংসা শুনতে শুনতে সে শেষ। সব যুবক ভূতরা হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, প্রাণভরে শ্যাওলার গন্ধ উপভোগ করে। অনেক মাস্তান ধরনের ভূত আবার তার দিকে প্রায়ই ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দেয়। আগে এসবে বিরক্ত হত ংঙ্যুণ্রী (সরি, উচ্চারণ বলতে পারব না!), এখন আর হয়না। সুন্দরীদের জীবনে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়, এই সত্যটা সে মেনে নিয়েছে। এই ংঙ্যুণ্রীকে নিয়েই সে গল্প।
সে রাতে খালার বাসায় ছিলাম, গাজিপুর। ঘন্টাখানেক হল কারেন্ট চলে গিয়েছে, আমি গল্পটা শেষ করতে খটাখট টাইপ করে চলেছি ল্যাপটপে। গ্রাম এলাকা, নিশুতি রাতে চারিদিক নিঝুম। প্রায় শেষ করে এনেছি, একটু পরই ভাবছিলাম পোস্ট করব। তো, শেষদিকে যে ভূত ছেলেটির প্রেমে পড়ে ংঙ্যুণ্রী তার কথা লিখছি, এমন সময় হঠাৎ একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। আমি ভূত লেখার জন্যে ‘V’ চাপতেই বাটনটা কী-বোর্ডের ভেতর ঢুকে গেল। আমিতো অবাক! এ কী ব্যাপার! টানাটানি করেও উঠল না। যাই হোক, আবার শিফট চেপে ধরে ‘U’ চাপতেই সেটাও ভেতরে ঢুকে বসে গেল!
আমার তো মাথা বনবন করে ঘুরছে। রাত প্রায় দেড়টা, এ কি ভূতূড়ে কাণ্ড! অন্য কী চেপে দেখলাম, কোনটাই আর বসল না। কিন্তু ভূত লিখতে গেলেই অক্ষর দেবে যাচ্ছে। কিন্তু শুধু ‘ভূ’ লিখে লেখা পোস্ট করি কিভাবে! এমনিতেই V আর U দেবে যাওয়ায় খুব অসুবিধা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে একটা ‘ভূ’-এর পাশে গিয়ে ‘T’ চাপলাম। আর যায় কোথায়! চপাৎ করে T-ও নিচে দেবে গেল!
ঠিক এইসময় অসম্ভব মিষ্টি, খিলখিলে একটা হাসি শুনতে পেলাম। এমন সুন্দর হাসি আমি জীবনে শুনিনি!
অজ্ঞান এখন হব, নাকি ভূতের চেহারাটা দেখেই হব ভাবছি, এমন সময় রিনরিনে গলায় কেউ বলল, ‘নামের বানান ভুল করেছ কেন?’
আমি সাথে সাথে অজ্ঞান হওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। এতো মিষ্টি কণ্ঠ যে ভূতের, তার সামনে আবার অজ্ঞান হয় কিভাবে! বরং মানুষ হিসেবে ভূতের সামনে প্রেস্টিজ রাখা আমার কর্তব্য!
ঘরে মোমবাতির মিটিমিটি আলো আর ল্যাপটপের স্ক্রীনের আলো ছাড়া অন্য কোন আলো নেই, এবং সে আলোতে ঘরে কাউকে দেখা গেল না। এ ঘরটা মূল বাড়ি থেকে একটু দূরে, উঠানের শুরুতে। খালারা নিশ্চয়ই অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে, নইলে হাসি শুনেই এগিয়ে আসত।
শেষ অংশ
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৫:২০