সকালে উঠেই পতাকাটা ব্যাগে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল স্বপন। রাতে ভাল মত ঘুম হয়নি। অস্থিরতা কাজ করছে। শিল্পকলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে হয়তো কিছুটা স্থির হতে পারবে। গতবছর ফেব্রুয়ারী থেকে সবচেয়ে উত্তাল দিনগুলো কেটেছে সেখানে। ওর। নাওয়া-খাওয়া, পরীক্ষা, প্রেমিকা, পরিবার, সব ভুলে স্লোগান দিয়ে গলা বসিয়ে ফেলেছে, পোস্টার লিখেছে, পিকাপে করে ছুটেছে পোস্টার লাগাতে। কতজনে তাকে রাজনৈতিক দলের দালাল বলে নিন্দা করেছে। বলেছে ও স্রষ্টাকে মানে না। পরিচিতরাই একবার পথ আটকে হুমকি দিয়েছিল। তবুও স্বপন পরেরদিন গিয়ে দাড়িয়েছে শিল্পকলার গেটে। আজ একটা রায় দিবে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা রায়। যে রায়ের জন্য স্বপন সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছে!
পাড়ার ক্লাব ঘরে প্রায়ই ছেলেরা খবর দেখে। আফিয়া বেগম তার পাশেই বসে আছেন। হাতে সেই একাত্তর সালে তার স্বামীর লেখা একটা চিঠি। মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে ফেরেন নি তিনি। এটাই শেষ চিঠি। খানেরা আফিয়া বেগমের কোল থেকে ছয় মাসের বাচ্চাটিকে কেঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে পুকুরে। এর পর একে একে প্রায় আধ ডজন হায়না তার সর্বস্ব কেড়ে নেয়। তখন থেকে আফিয়া বেগম আর কখনো কথা বলেননি। হয়তো ভুলে গেছেন। একটা খবরের অপেক্ষায় তেতাল্লিশ বছর পেরিয়ে গেল তার। আজ অনেক আশা নিয়ে আছে। কিন্তু না... আজকেও হল না। খবরে এল "আমৃত্যু কারাদন্ড"। আফিয়া বেগমের চোখে পানি। হাতে চিঠিটা নিয়ে ছুটে গেলেন পথে হাটা মানুষ গুলোর কাছে। কারো সময় নেই। কেউ ভিক্ষার আবেদন ভেবে সরিয়ে দিলেন। আফিয়া বেগম পা বাড়ালেন গতবছর অনেক মানুষ যেখানে জড় হয়ে বলেছিল "রাজাকারের ফাঁসি চাই"।
পতাকাটা লাঠিতে বেঁধে শিল্পকলার গেটে বসে আছে স্বপন। এর মধ্যেই আরো দুয়েকজন এসে পড়েছে। গতবছর থেকেই ওদের চেনাশুনা। কারও মুখে তেমন একটা কথা নেই। বড়ভাই এসে পিঠে হাত রেখে বললেন "জানতাম রে দিবে না। তবুও.. একটা আশা ছিল।" স্বপন মুখ নিচু করে নিল। কোলের উপর কোত্থেকে যেন এক ফোটা বৃষ্টি এসে পড়লো ওর। কিচ্ছু করতে পারে নি ও। ওর মনে হতে থাকে অজস্র সন্তান হারা মা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অসংখ্য স্বামী হারা স্ত্রী সুবিচারের আশায় ওর পথ দেখছে। মনে হয় সব বাবারা ওর ভরসায় ছেড়েছে ছেলের খুনের বিচার। মনে হয় নির্যাতীতা বোনের ভাইয়েরা ফুটন্ট রক্ত জমা রেখে গেছে ওর কাছে। স্ত্রীর গায়ে হায়নাদের প্রতিটা আঁচড়ের প্রতিশোধ চেয়েছে স্বামীরা। ভাইয়ের শুণ্য ঘর যত্নে গুছিয়ে রাখা বোনরা ওর উপর আস্থা নিয়ে আছে যে সুবিচার নিয়েই ও ঘরে ফিরবে! কিন্তু ও পারলো না!
বৃষ্টির ফোটা বাড়তে থাকলো স্বপনের কোলে। হঠাৎ মনে হল কেউ একজন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ তুলে দেখলো একটা কাগজ ওর দিকে বাড়িয়ে দাড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধা। চোখ মুছে কাগজটি হাতে নিল...
"আফিয়া,
কেমন আছো বউ আমার? বাবু কেমন আছে? তোমাকে খুব বিপদে ফেলছি না? তুমি আমার উপর রাগ করিওনা লক্ষী বউ। মা তো নাই। তাই আমার এই মায়েরে যদি বাঁচাইতে পারি। শ্বাশুড়িকে নিয়ে ঘরে ফিরলে ঝগড়া করবে না তো আবার? বউ শোন না। খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হচ্ছে জানি, যতটা পারো ঠিকমত খাও। বাবুর জন্য খাইতে হবে না? একটু সাবধানে থাকো। আজকে রাতে নতুন মিশনে যাবো। দুইদিন আগে এক কুলাঙ্গার দেইল্লা রাজাকার খান নিয়ে হুসেন পুরের সব বাসায় মুক্তি বাহিনী খুজার নামে মেয়েদের ধরে মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। এই কুলাঙ্গার গুলার আগে শায়েস্তা দরকার। দেশ স্বাধীনের পর তোমাকে বাবুকে নিয়ে দেশের বাড়িতে ঘুরতে যাবো। দোয়া কর।
খোদা হাফেজ।"
স্বপন কি বলবে বুঝতে পারলো না। পতাকা আর চিঠিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো... একটা রায়ের জন্য আর কত অপেক্ষা? আর কত দলিল চাই?
সাত আট জনের ছোট্ট মিছিলটা স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে গেল। "মুক্তিযুদ্ধের হতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার!"... "ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই... রাজাকারের ফাঁসি চাই!"... "পক্ষ নিলে রক্ষা নাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই!"...
আফিয়া বেগম কান্না ভেজা চোখে বিশ্বাসের হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে সেই দিকে। স্বপনের এক হাতে পতাকা, অন্য হাতে চিঠিটা। ও জানে এটা দিয়ে দেইল্লা রাজাকারের ফাঁসি হবে না। তবুও একজন মুক্তিযোদ্ধার শেষ মিশন পূরা করবে ওরা।
-----------------------
"আমরা জেগে আছি"
রায়ান ঋদ্ধ
বুধবার, দুপুর ২:৫৮
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৩