আজকের দুনিয়ায় ইসলামের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচার খুব জোরেশোরে চালানো হচ্ছে, মুসলিম সমাজে অমুসলিম কিংবা সংখ্যালঘুর অধিকার সুরক্ষিত নয়। অথচ এই অপপ্রচার একেবারেই অমূলক ও ভিত্তিহীন। অমুসলিমের অধিকার, সংখ্যালঘুর অধিকার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ইসলামই সর্বপ্রথম পৃথিবীর বুকে স্থাপন করেছে। ইসলাম পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয় এবং পারস্পরিক সম্প্রীতির সঙ্গে সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করে। প্রথমত কোনো অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করার অবকাশ নেই। ধর্মের ব্যাপারে যেকোনো ধরনের বল প্রয়োগ ও জবরদস্তি ইসলামে নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন,'দ্বীনের ক্ষেত্রে কোনো বাড়াবাড়ি নেই।' (সুরা বাকারা : ২৫৬)
আন্তর্জাতিক আইনে সংখ্যালঘু কারা?
জাতিসংঘের অধিবেশনে ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদের ৪৭/১৩৫ সিদ্ধান্ত মোতাবেক গৃহীত জাতিসংঘ সংখ্যালঘু ঘোষণাপত্রের ধারা ১ অনুযায়ী জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সংখ্যালঘুর প্রতি বৈষম্য প্রতিরোধ ও তাদের মানবাধিকার সুরক্ষাসংক্রান্ত জাতিসংঘ সাব-কমিশনের বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেস্কো ক্যাপোটোর্টি ১৯৭৭ সালে সংখ্যালঘুর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, সংখ্যালঘু বলতে সে সম্প্রদায়কে বোঝায়, যারা সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক দিয়ে একটি রাষ্ট্রের জনসংখ্যা, অবশিষ্ট অংশের চেয়ে ন্যূনতম একটি আধিপত্যাধীন অবস্থানে রয়েছে, যারা জাতিগতভাবে এমন একটি নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যা তাদের অবশিষ্ট জনসাধারণের কাছ থেকে পার্থক্য নির্দেশ করে। ইসলামের পরিভাষায় তাদের মু'আহিদ বলে।
অমুসলিমদের মর্যাদা ও সংখ্যালঘুদের অধিকার
ইসলাম শান্তি, সাম্য, উদারতা ও মানবিকতার ধর্ম। তাই অমুসলিম ও সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ে ইসলাম কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছে। এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) বলেন, 'জেনে রাখো, যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিক বা সংখ্যালঘুকে আঘাত করে বা তাকে অপদস্থ করে অথবা কর্মচারী নিয়োগ করে তার সাধ্যের বাইরে কাজ চাপিয়ে দেয়, আমি তার বিরুদ্ধে কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহর দরবারে মামলা দায়ের করব। (সুনানে আবু দাউদ : ২/৪৩৩)
অন্য হাদিসে এসেছে, 'যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করবে, সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না; অথচ জান্নাতের সুগন্ধি চল্লিশ বছরের দূরত্বে অবস্থান করেও অনুভব করা যাবে।' (সহিহ বোখারি : ৬/২৫৩৩)
মহান আল্লাহ বলেন, 'তোমার ধর্মের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেনি, তোমার বসতি থেকে তোমাকে উচ্ছেদ করেনি, তাদের প্রতি তোমার দয়ালু হওয়া উচিত এবং তাদের সঙ্গে ন্যায়ানুগ আচরণ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায় ভালোবাসেন।' (৬০:৮)
অমুসলিমদের অধিকার নিয়ে হজরত ফারুকে আযম (রা.) বায়তুল মুকাদ্দাসের খ্রিস্টানদের একটি উত্তম সংবিধান লিখে দিয়েছিলেন। তাতে বলা হয়েছে, 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এটি একটি নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তিনামা, যা মুসলমানদের আমির, আল্লাহর বান্দা ওমরের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরিত হলো, এ চুক্তিনামা ইলিয়্যাবাসী তথা জেরুজালেমে বসবাসরত খ্রিস্টানদের জানমাল, গির্জা-ক্রুশ, সুস্থ-অসুস্থ তথা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তাদের উপাসনালয়ে অন্য কেউ অবস্থান করতে পারবে না। তাদের গির্জা ধ্বংস করা যাবে না। এবং কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন করা যাবে না। তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো বস্তু, তাদের ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ ও তাদের সম্পদের কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন বা হামলা করা যাবে না। (তারিখুর রাসুল ওয়াল মুলুক, তারিখে তাবারি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৪৪৯)
ফুক্বাহায়ে কেরাম বলেছেন, অমুসলিম নাগরিকের ওপর জুলুম করা মুসলমানের ওপর জুলুম করার চেয়েও বেশি মারাত্মক। কেননা তার মৃত্যুর পর তার কাছ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির কোনো আশা নেই। আজকের পৃথিবীতে প্রায় সব দেশের সমাজেই Pluralistic-এ সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে সবাইকে তার নিজ ধর্ম ও মত অনুসারে কথা বলতে দেওয়া এবং ব্যক্তি হিসেবে Human dignity বা মানবিক মর্যাদা দেখানো আবশ্যক। ইসলাম ধর্মে এগুলোর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাসুলে কারিম (সা.) মদিনায় যখন একটি নতুন রাষ্ট্র স্থাপন করলেন, তার ভিত্তি ছিল Charter of Madina বা মদিনার সনদ। এই সনদের একটি ধারা ছিল, প্রত্যেক ধর্মের লোকেরা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
ইসলামে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই
চলমান বিশ্বে সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা একটি স্পর্শকাতর বিষয়। ইসলাম ধর্মে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। কেননা ইসলাম তো গোটা মানব জাতিকে 'উম্মতে ওয়াহিদা' তথা একটি সম্প্রদায় হিসেবে গণ্য করে। ইসলামের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে বিশ্বনিয়ন্তা পরম প্রভুকে ঘোষণা করা হয়েছে 'রাব্বুল আলামিন' তথা বিশ্বজাহানের পালনকর্তা হিসেবে। তেমনি ইসলামের নবী বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে 'রাহমাতুল্লিল আলামিন' তথা বিশ্বজগতের জন্য করুণার মূর্তপ্রতীক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অনুরূপ মহাগ্রন্থ আল কোরআনকে বিশ্বপ্রভু 'হুদাল্লিন্নাসি' তথা মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাই 'মানুষ এক আল্লাহর পরিবারভুক্ত'- এ নিয়মই ইসলাম স্বীকৃত।
অমুসলিমদের উপাসনালয়ে হামলা গ্রহণযোগ্য নয়
অন্যের উপাসনালয় ভেঙে ফেলার অনুমতি ইসলাম দেয়নি। মসজিদ, মন্দির বা গির্জায় হামলা করা ইসলামের দষ্টিতে নিন্দনীয়। হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.)-এর শাসনের আগে খ্রিস্টানদের একটি গির্জা ভেঙে মুসলমানরা মসজিদ বানিয়েছিল। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) খেলাফত গ্রহণের পর খ্রিস্টানরা এ অভিযোগ নিয়ে খলিফার দরবারে গেলে তৎক্ষণাৎ এক ফরমান পাঠিয়ে খ্রিস্টানদের গির্জা যেভাবে ছিল, ঠিক সেভাবে তৈরি করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) 'হীরা' নামের স্থানের সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিরাপত্তাসংক্রান্ত যে চুক্তি করেছিলেন, তাতে বলা হয়েছে- 'তাদের গির্জা তথা ধর্র্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করা যাবে না এবং তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া যাবে না। এবং ঘণ্টা বাজানো থেকে তাদের নিষেধ করা যাবে না। ধর্মীয় উৎসব উদ্যাপনের সময় ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ বের করাতে বাধা দেওয়া যাবে না।' (ফতোয়ায়ে হক্কানিয়া : ৫/৪৮৫)
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কিছু ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত
ঐতিহাসিকভাবেও ইসলামে অমুসলিমদের প্রতি ইনসাফের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। মদিনার ইহুদিরা সব সময় ইসলামের বিরোধিতা করত, তথাপি রাসুল (সা.) তাদের ধর্ম পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেননি। একবার মদিনার মসজিদে বসে নবী (সা.) নাজরান থেকে আগত একটি খ্রিস্টান প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার বিরতিতে তারা স্ব-ধর্ম অনুসারে প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে নবী (সা.) তাদের মদিনার মসজিদে প্রার্থনা করার অনুমতি দেন। (ফুতুহুল বুলদান, পৃ. ৭১)
ইতিহাস সাক্ষী, বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের শাসন যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন বিধর্মী রাষ্ট্রগুলো থেকে খ্রিস্টানরা মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে ছুটে আসতে থাকে- তার প্রমাণ স্পেন ও মরক্কোর ইতিহাস। তার প্রমাণ আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাস। সেখানে দেখা যায়, ইতালিসহ নানা জায়গা থেকে খ্রিস্টানরা নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিল। ভারতবর্ষে মুসলমানদের সুদীর্ঘ ইতিহাস সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে যখন মিসরের শাসনকর্তা হিসেবে হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) দায়িত্ব পালন করছিলেন, সে সময় একদিন আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রিস্টানপল্লীতে হইচই পড়ে গেল- কেউ একজন যিশুখ্রিস্টের প্রস্তর নির্মিত মূর্তির নাক ভেঙে ফেলেছে। খ্রিস্টানরা ধরে নিয়েছে, এটা মুসলমানদের কাজ, তারা উত্তেজিত হয়ে উঠল। খ্রিস্টান বিশপ অভিযোগ নিয়ে এলেন আমর ইবনুল আস (রা.)-এর কাছে। আমর (রা.) শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তিনি ক্ষতিপূরণস্বরূপ মূর্তিটি নতুনভাবে তৈরি করে দিতে চাইলেন। কিন্তু খ্রিস্টান নেতাদের প্রতিশোধ-স্পৃহা ছিল অন্য রকম। তাঁরা চাইলেন মুহাম্মদ (সা.)-এর মূর্তি তৈরি করে অনুরূপ নাক ভেঙে দিতে। হজরত আমর (রা.) কিছুক্ষণ নীরব থেকে খ্রিস্টান বিশপকে বললেন, 'আমার অনুরোধ, এই প্রস্তাব ছাড়া অন্য যেকোনো প্রস্তাব করুন! আমি রাজি আছি। আমাদের যেকোনো একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত, যার নাক আপনারা চান।' খ্রিস্টান নেতারা সবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন, পরদিন খ্রিস্টান ও মুসলমানরা বিরাট এক ময়দানে জমায়েত হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর (রা.) সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বললেন, এ দেশ শাসনের দায়িত্ব আমার, যে অপমান আজ আপনাদের, তাতে আমার শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই তরবারি গ্রহণ করুন এবং আপনিই আমার নাসিকা ছেদন করুন। এ কথা বলেই বিশপকে একখানা ধারালো তরবারি হাতে দিলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। খ্রিস্টানরা স্তম্ভিত। চারদিকে থমথমে ভাব। সহসা একজন মুসলিম সৈন্য চিৎকার করে বললেন, 'আমিই দোষী, সিপাহসালার কোনো অপরাধ করেননি।' এই বলে তিনি বিশপের তরবারির নিচে নিজের নাসিকা পেতে দিলেন। স্তম্ভিত বিশপ! নির্বাক সবাই। বিশপের অন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তরবারি ছুড়ে বিশপ বললেন, 'ধন্য সেনাপতি, ধন্য হে বীর সৈনিক আর ধন্য আপনাদের মুহাম্মদ (সা.), যাঁর মহান আদর্শে আপনাদের মতো উদার ও নির্ভীক ব্যক্তি-সমাজ গড়ে উঠেছে। যিশুখ্রিস্টের প্রতিমূর্তির অসম্মান করা হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়েও অন্যায় হবে যদি অঙ্গহানি করি। পরধর্মসহিষ্ণুতার এ জ্বলন্ত উদাহরণ আজও বিশ্ববাসীকে হতবাক করে।
সূত্রঃ কালের কন্ঠ
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১২:৫৭