কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নিয়ম অনুসারে বোর্ড থেকে খাতা পেতে হলে সোনালী ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। তাই সাগর স্যার একদিন সোনালী ব্যাংক থেকে একগাদা ফরম নিয়ে আসলেন। আমরা শিক্ষকেরা মহা উৎসাহে সেই ফরমগুলো পূরণ করলাম। অতঃপর একদিন সেই ফরম নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম সোনালী ব্যাংকের উদ্দেশ্যে। ভাববেন না অল্প সময় হাতে নিয়ে গিয়েছি, আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময়ই ছিল।
অ্যাকাউন্ট খোলার প্রথম ধাপ শুরু হলো আমাদের পূরণকৃত ফরম যাচাই ও আনুষঙ্গিক কাজের মাধ্যমে। যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে তারা বহু সময় নিয়েই এই কাজটা করলো। আপনাদের বোঝার সুবিধার জন্য কতক্ষণ সময় লেগেছে তার একটু নমুনা দিচ্ছি। প্রথম ঘন্টা আমি যথেষ্ট ধৈর্য নিয়ে বসে থাকলাম একটি চেয়ারে। এক ফাঁকে ম্যানেজারের সাথেও কিছুক্ষণ আলাপ করে এলাম। এরপর আরো কিছুক্ষণ বসে থাকার পর শুরু হলো তাদের জোহরের নামায ও দুপুরের খাবারের বিরতি। অন্য সব কাজের মতো এই কাজটাও তারা যথেষ্ট সময় নিয়েই করলো। লাঞ্চ বিরতির পর যখন তারা আবার নিজ নিজ আসনে বসলো, লক্ষ্য করলাম আমার পাশের টেবিলেই একটি অল্প বয়সী তরুনী অফিসার কাজ করে যাচ্ছে। কাজ করে যাচ্ছে মানে মোবাইল ফোনে কার সাথে যেন আলাপ করছে। একটু লক্ষ্য করেই দেখলাম শুধু এই মেয়েটিই না, তামাম অফিসের কর্মীরাই একটু পর পর যথেষ্ট সময় ও আন্তরিকতার সাথে মোবাইল ফোনে এই কথা বলার কাজটি করে যাচ্ছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজনদের সাথে তাদের এই ঘনিষ্ঠ বন্ধন দেখে আপ্লুত হয়ে গেলাম। ফারুক স্যার বেরসিকের মতো বললেন, এদের কী কোন কাজকর্ম নাই? খালি ঘোরে আর কথা বলে? যাহোক কথা শেষ হলে মেয়েটির নিকট গিয়ে বিনয়ের সাথে জানতে চাইলাম তাদের এই ব্যাংকে কি কি অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। তরুনীটি কিছুক্ষণ আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পরে এম ই এস ও এফ ডি আরের রেট জানার জন্য আমাকে আরেক মেয়ে অফিসারের নিকট পাঠাল। সেই মেয়ে অনেক চেষ্টা করে একটি পুরনো ফাইল খুজে বের করলো যার মধ্যে অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্য রাখা আছে। যথেষ্ট সাবধানতার সাথে সে বয়সের ভারে হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলো উল্টাতে লাগলো যেন সেগুলো ছিড়ে না যায়। অতঃপর সে এম ই এস এবং এফ ডি আর এর মুনাফার রেট আমাকে জানাতে পারলো এবং এই অসাধ্য সাধন করার জন্য তাকে যারপরনাই আনন্দিত মনে হলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ততক্ষণে দুপুর দুইটা পার হয়ে গেছে।
এরপরে আবারো আধাঘন্টা বসে বসে ঝিমানোর পরে তাদের ফরম যাচাই ও আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হলো। এরপর সাগর স্যার ডাক দিলেন স্বাক্ষর করা ও টাকা জমা দেওয়ার জন্য। এই কাজগুলো অসীম ধৈর্য নিয়ে সাগর স্যারই করলেন। এরপরে সবশেষে আসলো চূড়ান্ত পর্যায়। এক বৃদ্ধ অফিসার যার অবসরের আর মাত্র বিশ দিন বাকী আছে, তিনি ফরম যাচাই করে, সিল ছাপ্পর পরীক্ষা করে, নিজেও কিছু লিখে ও সিল মেরে ফরমগুলো সম্পূর্ণ করলেন। তার এই কাজ করতে কতটুকু সময় লেগেছে তা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দিচ্ছি। মনে করুন একটি শামুক সিদ্ধান্ত নিল যে, সে মালিবাগ থেকে ফার্মগেট বেড়াতে যাবে। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে যে সময় লাগবে তার সাথে ঐ অফিসারের কাজের তুলনা করলেই আপনি সঠিক সময়টি পেয়ে যাবেন। বৃদ্ধ অফিসারটি আবার কানে একটু কম শোনে। তাকে যে কোন কথা আপনি গুণে গুণে তিন চারবার বলার পরে তিনি মনে হয় একটু শুনতে পাবেন। এরপরে তিনি চেকবই বের করলেন।
এই চেকবই দেখে আমারতো ভিরমি খাওয়ার দশা। এই একবিংশ শতাব্দীতে এই রকম মান্ধাতা আমলের চেক বই ব্যবহৃত হয় তা আমি এই সোনালী ব্যাংকে না আসলে জানতেই পারতাম না। চেকবইটি সরু আকৃতির এবং একটি মোটা খাকী কাগজ দিয়ে বাধাই করা। বৃদ্ধ অফিসার এরপর আমার চেকবইটিতে অ্যাকাউন্ট নম্বরটি নম্বর সিল দিয়ে সিল মেরে দিলেন। নম্বরটি প্রায় প্রতিটি চেকেই সঠিক ঘরে না পড়ে এদিক ওদিক পড়লো। তবে এ নিয়ে অফিসারটিকে মোটেও চিন্তিত মনে হলো না। এরপর তিনি চেকবইয়ের উপরে একটি জটিল নকশা আঁকলেন। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে বুঝতে পারলাম যে ওটা আমার নাম। সমস্ত কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে তিনি চেকবই ও জমার বই আমার নিকট হস্তান্তর করলেন। এরপর সাগর স্যার তাকে নিচে গিয়ে চা ও পান খাবার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। এই চা ও পান খাবার আমন্ত্রণ তিনি সাথে সাথেই শুনতে পেয়েছেন দেখে একটু বিস্ময় বোধ করলাম। এরপরে অফিসারটি আমাদের সাথে নিচে নেমে আসলেন এবং চা ও পান খেলেন। দুটি পান তিনি কাগজে মুড়ে নিয়েও গেলেন। বয়স্ক মানুষ। প্রথম সাক্ষাতে আমার নিকট তাকে একজন ভাল মানুষ বলেই মনে হয়েছে। সাগর স্যার বললেন, সোনালী ব্যাংকের অফিসারগুলোকে চা ও পান খাওয়ালে তারা খুব খুশী হয়। সাগর স্যার অত্যন্ত করিৎকর্মা মানুষ। তিনি যা বলেছেন তা ভুল হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই।
এরপর আমি, সাগর স্যার ও ফারুক স্যার বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। ততক্ষণে বিকেল হয়ে গিয়েছে। কী ভাবছেন? অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট খুলেছি? না। যথেষ্ট সময় নিয়েই আমরা এসেছিলাম। মাত্র তিনটা অ্যাকাউন্ট খুলে আমরা সন্ধ্যার সময় বাসায় ফিরলাম।