প্রিফিয়া তাকিয়ে আছে নেত্রকোনার বিরিশিরির নীল জলরাশির দিকে।পাশে বসে আছে জিহান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সফর। সবাই যে যার মত আনন্দে মেতে আছে।ওরা মিশে আছে এই নীলের নীলায়।
-আমার খুব ভয় হয়, প্রিফিয়া।
-কেনো?
-বাবা,পেনশনে চলে এলো, ছোট দুটি ভাই বোন,এখনো বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ চুকাতে পারি নি, চাকরি বাকরি তো বহুদূর?
এর মধ্যে তোমাকে জড়িয়ে ফেলেছি।
-সব ঠিক হয়ে যাবে।আর তুমি চাইলে আমকে না করে দিতে পারো। আমার একাকি ভালই কাটবে,তবু টেনশন করোনা। সিগারেট খেয়ো না।
-সিগারেট ছাড়তে পারব না। যতদিন দুঃখ থাকবে ততদিন সিগারেট খাব।
জিহান জানে,প্রিফিয়া এমনই বলবে।মেয়েটা দেখতে অপ্সরার মত।চোখগুলো যেনো এই পানির মতই নীল।আর মায়া,যেন ঢেউগুলোর মত, যতই দূরে যাই যেনো ফিরে আসে বারে বারে।
আবার বলে উঠল ক্ষোভ নিয়ে,বাবা যে কেনো লেট ম্যারেজ করলো? ওনার কলিগদের প্রায় সবার ছেলেরাই আজ প্রতিষ্ঠিত।
-বাবার ওপর আক্ষেপ করে কি লাভ।ওনি যখন ভালো মনে করেছেন তখন বিয়ে করেছেন?
-আর আমি তো বাকি সব প্রেমিকাদের মত তোমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছি না।
-কিন্তু তোমাকেই বা তোমার বাবা মা কতদিন বসিয়ে রাখবে।
-ও নিয়ে তোমার চিন্তা করার দরকার নেই। আমার টা আমি বুঝব।
জিহান ভাবছে, হয়ত বা একদিন প্রিফিয়া লাল শাড়ি পরে আরেকজনের ঘরে চলে যাবে। ও কিছুই করতে পারবে না। বাবার ডায়াবেটিস, মার প্রেসার, সংসারের খরচ আর ছোট ভাই বোন দুটির লেখাপড়া। দেশের যা অবস্থা এক বছর পর পড়াশোনা শেষ করলেও, চাকরি কপালে জুটবে কিনা কে জানে।তার উপর নেই মামার জোর।
ঘুমুতে যাবার আগে আট নম্বর সিগারেট টা জ্বালালো।ভাবছিলো ওর মত ছেলের তো প্রেম করার কথা ছিলো না। কিভাবে কি হয়ে গেলো।ঐ দিনের ঘটনাটা মনে পড়ল।
ওর বাবার সরকারি চাকরির কারনে বিভিন্ন জায়গায় যায়।একবার কুমিল্লায় কলেজ লাইফে এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে দেখে,ওদের বিশাল বাগান। অনেক সুন্দর ও বাহারি রকম ফুলের গাছ। এর মধ্যে বিশেষ একটা ফুল গাছ দেখলো। যে গাছে ফুটে আছে নীল গোলাপ। ও একটি কলপ চেয়ে নিয়ে এলো। ওদের চাঁদপুর যেখানে নিজেদের বাড়ি,তার ছাদে টবে নীল গোলাপের চারা টি
রোপন করল।ওর বাবার রিটায়ার মেন্টের পরে ওরা এখন চাঁদপুরেই থাকে,নিজেদের বাসায়। পড়াশোনা করছে চাঁদপুর সরকারি কলেজে স্মমান ৪র্থ বছর কেমেষ্ট্রি তে। চাঁদপুরে অনেক নামি দামি স্কুল কলেজ আছে। এই সরকারি কলেজ ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত।
শীতের কুয়াশা ভেজা এক সকালে,ও একদিন ছাদে সিগারেট খেতে ঊঠল। দেখলো চার টি নীল গোলাপ চুপসে আছে, একটি গোলাপ ছিঁড়ে হাতে নিল। এক হাতে সিগারেট আর এক হাতে নীল গোলাপ । এর মাঝে একটি কাক বিশ্রী ভাবে কা কা শব্দে মেজাজ বিগড়ে উঠে জিহানের। ও কাক টি কে তাড়াতে গেলে,ওদের বাসার পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তায় প্রিফিয়া কে প্রথম দেখতে পায়।
ওর বাম হাত থেকে সিগারেট টা পড়ে প্রিফীয়ার উপর। তেমন কোনো সমস্যা হয় নি। শুধু ওড়না টা একটু পুড়ে গিয়েছিলো। আর প্রিফিয়া উপরে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল।
জীহান তাড়াতাড়ি নিচে নামল।
-কি?মেয়ে মানুষ দেখলে মাথা ঠিক থাকে না?
-আমি খুব সরি। আসলে ইচ্ছে করে করিনি। অসাবধানতা বসত এমন টা হয়ে গেছে।
-হায়রে পুরূষ মানুষ, এমন ভান করছেন যেনো ভাজা মাছ টা উলটে খেতে পারে না।
-প্লিজ বাসায় বিচার দিয়েন না।
-আচ্ছা এখন সরে দাড়ান, আমাকে যেতে হবে,
-এতক্ষনে সুমিষ্ট একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
জীহান সরে গেলো। ভেবেছিলো বিচার দিবে,কিন্তু দেয় নি।
মেয়েটা আসলেই ভালো, মনে মনে ভাবলো।
সুখস্মৃতি ভাবতে ভাবতে নবম সিগারেট টা ধরালো।প্রায় বছর তিন আগের কথা। একন প্রিফিয়া ওর জীবনের নীল গোলাপ হয়ে গেছে।
পড়াশোনা শেষ।চাকরির জন্য হন্য হয়ে ঘুরছে। এবার চাকরি পেয়ে সংসারের হাল ধরতে হবে। বোনের বিয়ে, ছোট ভাইয়ের এডমিশন। বাবা মার চিকিৎসা।
প্রিফিয়া সম বয়সী হওয়াতে ওর বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। কিন্তু ও কিছুই বলে না।
অঙ্গীকার নামে চাঁদপুরে একটি ভাস্কর্য আছে। তার নিচ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট লেক। আর লেকের পাশ ঘেঁষে রেল লাইন।
ওরা দু জন বসে আছে সেই রেল লাইনের উপর। বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে। গোধূলির আলো পড়ছে প্রীফিয়ার গালে। মেয়েটিকে আজ আরো সুন্দর লাগছে।
আর কটা দিন প্রিফিয়া, বোনের বিয়েটা হয়ে যাক।আর ভাইকে ভালো ভাবে সেটেল করে দিতে পারলেই, শুধূ তুমি আর আমি।
বাবা-মা এর সাথেই থাকব বা যেখানেই যাই তারা আমাদের সাথেই থাকবে।
শুধু একটা চাকরী।
প্রিফিয়া তাকিয়ে আছে লেকের পানিতে, ওর চোখ কেমন জানি ছল ছল করেছে। তার আগেই ও উঠে পড়ে চলে গেলো।
চাকরী না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছে জীহান। ওর এক বন্ধু শেয়ার ব্যবসা করে এখন কোটিপতি। হঠাত ওর মাথায় শেয়ার ব্যবসার ভূত চাপল। বাবার পেনশনের এককালীন যে টাকা, তার হাফ তুলে নিয়ে শেয়ার কিনলো। শেয়ারের দাম বাড়লো একবার। ও ধরে রাখলো, আরো দাম পাবার আশায়। কিন্তু তারপর শেয়ার বাজার এ পুরোপুরি ধস নামলো।
জীহান আরো ভেঙ্গে পড়লো।
ছয় মাস টিউশনি আর সিগারেট এই চলছে জীবন।
প্রিফিয়ার হলুদের আয়োজন চলছে।
এর মধ্যে জিহানের আম্মুর খালাতো বোনের জামাই যে কিনা লন্ডনে সেটেল্ড সে দেশে আসলো। তার নদী ঘেরা চাঁদপুর দেখার খুব ইচ্ছে।
হূমায়ন আহমেদের একটা বইতে চাঁদপুরের বিবরণ পাওয়া যায়। রাত্রি বেলা যখন লঞ্চ ঘাট এর আসে আশে সবগুলো লাইট জ্বলে ঊঠে তখন কোনো ব্রীজের উপর থেকে বা নদীর কোল ঘেঁষা কোণো ছাদের উপর থেকে চাঁদপুর কে অপরূপ মায়াময় সুন্দর মনে হয়।
আর সন্ধ্যে বেলায় তিন নদীর মোহনা যেখানে মিলেছে তার পাশের ব্লকে বাঁধানো তীর থেকে সূর্য ডোবা যেনো সব সুন্দরের েশ্রষ্ঠ সুন্দর।
জিহানের আম্মুর খালাতো বোন তার জামাই সহ চাঁদপুর বেড়াতে এলো। জীহান তাদের চাঁদপুর ঘুরিয়ে দেখাতে থাকল। এর মাঝে জিহানের আম্মুর খালাত বোনের বরের সাথে খুব ভালো খাতির হয়ে যায়।তিনি তাকে গলা কাঁটা পাসপোর্ট দিয়ে লন্ডন নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব করেন। এর আগে ওনি যত জনকে এভাবে নিয়ে গেছেন। সবাই সফল ভাবে লন্ডন যেতে পেরেছে।এ কথা শুনে জীহান রাজি হয়ে যায়।
জীহানের আম্মুর খালাতো বোনের জামাইয়ের নাম হচ্ছে বিপু। তো বিপু সাহবের প্রস্তাবনা সবাইকে চিন্তায় ফেলে দিলো। জিহানের বাবা কোনোভাবেই রাজি হচ্ছেন না। তিনি ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। জীবনে দুই টাকা ও ঘুষ খান নি।আর দু নম্বরি কাজের সাথে কখনই আপোষ করেন নি।
জিহানের মা তার বাবা কে বুঝালো।
-দেখো আমাদের ছেলে লন্ডন যেতে পারলে,আমাদের আর ছোট গুলো কে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
-কিন্তু ও যদি না যেতে পারে,থলে তো আমরা পুরো শূন্য হয়ে যাবে,আর তা ছাড়া বিপদ আপদের তো হাত পা নেই।
-ও নিয়ে তুমি টেনশন করো না,আমি বিপুকে ভালোভাবে চিনি।ও ঠিক ই জীহান কে নিয়ে যাবে।
-কিন্তু......
-আর অমত করো না, এ সুযোগ হয়ত আর পাবে না।আর ওর তো চাকরি-বাকরিও কিচ্ছু হচ্ছে না,বেকার বসে আছে।
-আচ্ছা,তোমরা যা ভালো মনে করো,তাই করো।
বাবার পেনশনের বাকি টাকা তুলে ল
ন্ডন যাওয়ার ব্যবস্থা করে। একই সাথে তারা সেখানে জীহানের থাকা, খাওয়া এবং কাজের প্রতিশ্রুতি দেয়। জীহান তার বাবার শেষ সম্বল টূকু নিয়ে পাড়ি দেয় লন্ডন।
প্রিফিয়া তার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া লোকটিকে ফোনে জানায়, তার পক্ষে এ বিয়ে করা সম্ভব না।সে ওই লোককে সব গোপন রাখতে বলে। কিন্তু লোকটি তা সবাইকে জানিয়ে দেয়। প্রিফিয়ার বিয়ে ভেঙ্গে যায়।
প্রিফিয়া চারদেয়ালে আটকা। ওর বাবা বেজায় বদ মেজাজী। যতদিন না প্রিফিয়া ওনার পছন্দ অনু্যায়ী বিয়ে করতে রাজি না হবে ততদিন তিনি তাকে এভাবে বন্দী করে রাখবেন। আর ওই ছেলের(জীহান) ই বা কি আছে। এখনো চাকরী করে না,বাবার ও কিছু নেই।তার ধারনা
মেয়ে ও ঘরে বিয়ে দিলে,পরে আবার নিজের ঘাড়ে এসে পড়বে। এ টাইপের লোকদের ধারনা মেয়ে মাত্রই বোঝা, এদের ভালো যায়গায় পাত্রস্থ করতে পারলেই মুক্তি।
কিন্তু প্রিফিয়া চারদেয়ালে স্বপ্ন বুনে যাচ্ছে। ওর ধারনা জীহান পারবেই। কিন্ত ও জানে না জীহান আজ লন্ডন চলে যাচ্ছে। চোখ বুজে আসছে প্রীফীয়ার, আর সবুজ ঘাসে ঘুমিয়ে আছে ও আর জীহান। চারিদিকে লাল নীল ফড়িং আর প্রজাপতি ওদের ঘিরে রেখছে।
না,ঘুম ভাঙতেই টের পেলো স্বপ্ন দেখছিলো ও।
জিহান লন্ডন যাওয়ার আগে শেষ দেখা করে যেতে পারে নি।
ঢাকা টু লন্ডন ফ্লাইট এখন কাতার। পাসপোর্ট চেকিং হচ্ছে। আগে কখনো এখানে চেকিং হত না। আজ একটি বিশেষ কারনে চেকিং। ধরা পড়ে যায় জিহান।
২ বছরের জেল হয়।
গলাকাটা পাস মানে হচ্ছে আপনি লন্ডন দেশে থাকেন।এখন বেড়াতে বাংলাদেশ আসছেন,আবার ফিরে যাচ্ছেন।জীহান কে যখন তারা লন্ডন এর তথ্য জিজ্ঞাসা করে ,সে কিছুই উত্তর দিতে পারে নি। পরে অনলাইনে চেক করে তারা জানতে পারে এটা নকল পাস।
১ বছর ৬ মাস পর,
জিহানের মা তার কাছে থাকা সব স্বর্ণ একের পর এক বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন।
তার প্রিয় নীল গোলাপ গাছটি কিছুদিন আগে মারা গেছে।
আর তার জীবনের নীল গোলাপ ............।
যেসব পাঠক বিরহ চান না,তারা সমাপ্তি টা এভাবে পড়তে পারেন...
২ বছর পর.....................
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দেশে আসে জীহান। মনোবল ভেঙ্গে পড়ে ওর।কিন্তু ওর মা ওকে একটা কথা বলে, ইমানদার ব্যাক্তি কখনও হতাশ হয় না। আল্লাহ্র উপর ভরসা রাখে।আবার পড়াশোনা শুরু করে। সব নিয়োগে এর জন্য দরখাস্ত করে। আসে এক এক করে প্রীক্ষার পালা।
বাবা- মার দোয়া আর আল্লাহ্র অশেষ মেহেরবানীতে চান্স সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে।
তারপর এক এক করে, প্রাইমারী শিক্ষক হেডমাস্টার পদে নিয়োগ পায়।
আবার পরীক্ষা দিয়ে উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগ পায়।
হাল ধরে সংসারের।বাবা মা এখন অনেক খুশী।
প্রিফিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ায় আর জীহান এর অবস্থার বদলানোয় তার বাবা রাজি হয়ে মেয়েকে জীহানের হাতে তুলে দেয়।
চলছে ওদের ছোটখাট সুখের সংসার।
দু বছর ওদের ঘর আলো করে আসে ফুটফূটে প্রিহান, প্রিফিয়ার প্রি আর জীহান এর হান।
প্রথম সন্তান জন্ম নেবার পর,
সিগারেট যেটা কিনা সে জীবনেও ছাড়তে পারবে না,সেটা সে ছেড়ে দেয় চিরতরে।
(উৎসর্গ করছি প্রিয় চাঁদপুর শহর কে,যেখনে আমার ৈকশোর এবং যৌবনের প্রথমাংশ কাটিয়েছি। আর সেই সব বন্ধুদের যাদের সাথে স্কুল ,মাঠ, ঘাট আর চা-সিগারেটের টঙ্গের দোকান ঘরে আড্ডা বাজি করেছি সারাটা দিন ।খুব মিস করছি প্রিয় চাঁদপুর শহর আর সেই সব বন্ধুদের।ভাল থেকো সবাই।)
(এই গল্পের প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক ও কাঁকতলিয়।)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১৩ ভোর ৫:৫৭