আমাদের এই পৃথিবীটায় সময়ের হাত ধরে জানা অজানা কত মানুষ-ই না এলো গেলো। এই যে আমাদের বঙ্গভূমের কথাই ভাবুন না, অসুরের আমল থেকে আজকের আমরা সবাই- একটা মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কত যুদ্ধ, কত আঁতাত-ই না করেছি তার ইয়ত্তা নেই। শেষ পর্যন্ত একাত্তর সালে আমাদের বঙ্গভূমের রাজনৈতিক সত্ত্বার আত্মপ্রকাশের ভিতর দিয়ে অন্যান্ন মুক্তির দ্বার খুলে যায়। নিজেদের মত করে সাজাবার বা গড়বার মত একটাকিছু আমাদের পুর্বসূরিরা হয়ত অর্জন করে। 'বাংলাদেশ' বলে একটা প্রাতিষ্ঠানিক নামও তাঁরা-ই দেয়।
এই আমি তার প্রায় একযুগ পরে বঙ্গভূমে জন্মেছি। তাই পূর্বসূরিদের বীরত্বগাঁথায় আমার কোন নায়কের ভুমিকা নেই। এমনিক '৮৯ এর কথাও আমার কিছু মনে পড়ে না। ব্যক্তি বা নাগরিক হিসেবে বুঝেওঠা বলতে যা বোঝায় তা আমার সবে শুরু হয়েছে। আমি নতুন প্রজন্মের মানুষ, নতুন মানুষ। আমার কাছে ৪৭, ৫২, ৭১, ৮৯ সব ইতিহাস। ইতিহাসের বই পড়ে বা দু'একজনের মুখে শুনে সামান্য আঁচ করতে পারি একটা জনপদের ক্রমাণ্বয়ে বেড়েওঠার গল্প। নিজেকে খুঁজে পাই দুর্বলচিত্তের একজন হিসেবে।
শশাঙ্কের পর থেকে বাঙালিদেরকে বাঙালিরা কখনও শাসন করেনি। এরা নিজেদর ভেতর থেকে কারো নেতৃত্ব মানেনা। তার চেয়ে বরং অন্যজাতের দাস হয়ে স্বচ্ছন্দে বেড়ে ওঠে। সে মোঘল, পাঠান, তুর্কি, ফরাসি বা ইংরেজ- যাই হোক। এই সভ্যতায় রাজা জন্মে না। জন্মে চোর, জন্মে শোশিতপ্রিয় মেরুদন্ডহীন, ব্যক্তিত্বহীন আন্তঃদ্বান্দিক মানুষের মত প্রাণিরা। যারা যুদ্ধ, শাসন, বিলাস কিছুই করতে জানে না। এদের ভিতর আবিষ্কারের নেশা নেই। এরা ইউরোপ, আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করতে পারে না। বাঙালিরা প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, উপর নীচ চারদিক দিয়ে আক্রান্ত হয়েই শান্তি পায়। আক্রান্ত হওয়া এদের কাছে কুম্ভকর্ণের সুঁড়সুঁড়ি।
বাংলাদেশের ক্ষেপনাস্ত্র নেই যা অন্যকারো দিকে তাক করা থাকতে পারে। আমাদের চল্লিশ বছর ধরে পরমানুচুল্লি থাকতে পারে কিন্তু পরমানু অস্ত্র থাকতে পারে না। অন্যদের ডুবোজাহাজগুলো যখন একডুবে ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে আসে, তখন আমরা বিদেশ থেকে নৌকা আমদানি করি। বরং আমাদের দেশটা অন্যসব প্রভুদের ভাগাড়। ভাগাড় বলেই আমাদের নদী-নালা, সমুদ্রের রং বদলায়। আদাদের জীববৈচিত্রের সুতো ছিঁড়ে যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে কম গ্রিনহাউস গ্যাস ব্যবহারকারিদের ভিতর আমরা অন্যতম। অথচ সবথেকে আগে ডুবে মরি আমরাই। অন্যজাতির দুঃসময়েও আমরা কিছুই করতে পারিনা। আমরা ঋণ নিই, দিতে পারিনা। উত্তরোত্তর আমাদের ঋনের বোজা বেড়েই চলে। জনপ্রতি ত্রিশহাজার টাকার ঋনের বোঝা মাথায় নিয়ে নিশ্চিন্তে বংশবৃদ্ধি করে চলি। মুখ দিয়েছেন যিনি আহার দিবেন তিনি, নইলে আল্লা'র মাল আল্লা'য় নেবে এইতো! কিন্তু ফতোয়া এই সমাজে থাকতেই হবে, পরিবার পরিকল্পনা চলবে না। যেরকম উর্বর জমি আমাদের তেমনি অনুর্বর মাথা আর দুর্বল হাত। আমারা তসলিমা নাসরিনকে ঝেটিয়ে, হুমায়ূন আযাদকে মেরে নিজামিদের পুষি। বাংলাদেশে মৌলবাদ একটা চুলকানি। চুলকাতে আমরা মজা পাই। এর অষুধ খুঁজি না, এর জীবানু কতদুর তা খতিয়ে দেখার সাহস ও বুদ্ধি আমাদের নেই। প্রজাদের প্রজাতন্ত্রে আর কী থাকতে পারে? নিশ্চই রাজাদের রাজতন্ত্রে যা তাকে তা নয়। আপনারা বলবেন আমি প্রজাতন্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা করি। কিন্তু এটা আমাদের রক্তের তন্ত্র। দাসতন্ত্র। এখানকার তেলচিটচিটে খোবলা খোবলা মাংসবহুল সুশীল সমাজ, ভীরু বিজ্ঞানীরা নিজেদের আখের পুর্তির চিন্তায় ব্যস্ত। তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি নিয়ে ভাবে না। অতীত থেকে তারা শিক্ষা নেয় না, তাই বর্তমান তাদের কাছে অস্পষ্ট।
আমি বোধহয় একটু বেশি বুঝি, নইলে ইঁচড়ে পাকা। কী-ই বা দেখেছি এক'দিনে! কিন্তু আমার বয়স পঁচিশ। পঁচিশ বছর বয়স নিয়ে আমি আজও হেঁটে চলেছি হাজার বছর। দারিদ্র, দাস্য আর মৃত্যুর ভিড় ঠেলে - আমি পায়ে পায়ে চলেছি; দেখছি দুর্নীতির ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস, শোষনের ইতাহাস।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০০৮ রাত ১১:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




