লিট্লম্যাগ
গোলাম রব্বানী
আনন্দ যেদিন থেকে বস্তুতান্ত্রিক, সেদিনই প্রজ্ঞা জানালা দিয়ে পালিয়েছে। সারাবিশ্বেই আজ তাই মোরালিটির মহামারি। মানুষ ষাষ্ঠাঙ্গে প্রনাম করছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে, বস্তু ও তার নির্ণায়ক অর্থকে। ফলে প্রজ্ঞার দুই হাতে থাকা প্রান ও আনন্দের সাথে মানুষের সৃষ্টি হয়েছে অবিশ্বাস। দূরত্ব বেড়েছে সৃষ্টির সাথে সুন্দরের, প্রকৃতির সাথে সভ্যতার। আর তাই মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ছে শিল্পের উপর। শিল্প তাই তার নিজের গণ্ডি পেরিয়ে জীবনের গণ্ডি ছাড়িয়ে মানিব্যাগের কাছে আশ্রয় খুঁজছে। কিন্তু সমাজের ভিতর চিরায়ত কিছু বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ আছে যারা স্রোতের উল্টো সাঁতরায়। মুষ্টিমেয় চতুর মানুষগুলোর ফাঁকি দেখে এরা আর দশজনের মতো হাতপাগুটিয়ে অন্যকারো আশায় বসে থেকে বুড়ো হয় না। পুরোনো কলম আর সাহসকে সম্বল করে যারা ঝাঁপিয়ে পড়ে অসংগতির বিরুদ্ধে, হাতিয়ার হিসেবে তারা বেছে নেয় সাহিত্যের কনিষ্ঠতম অস্ত্র লিটল ম্যাগাজিন। সমাজের কনিষ্ঠতম স্তরের মানুষ এই অস্ত্রটি নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে সমাজের প্রাচীন কালথেকে জমে ওঠা পর্বতসমান অসংগতিগুলোর বিরুদ্ধে। এবং এই অস্ত্রের ভেতরেই মানুষ শোনে ভাঙ্গনের আওয়াজ, এর সামনেই নতজানু হয় নতুন সময়।
আমাদের দেশে পত্রিকার তিনটি ধারা বিদ্যমান। একটা গবেষণাধর্মী বা একাডেমিক পত্রিকা, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তাঁদের পদোন্নতির মই হিসেবে ব্যবহার করেন। সেখানে কবে কী প্রকাশিত হলো, তা কখনো জনসাধারনের সামনে আসে না। ছাপাখানা থেকে অন্ধকারে জন্ম নিয়ে লাইব্রেরির রেয়ার সেকশানে তার জীবন কেটে যায়। আরেকটা আগেপিছে সব বাদ দিয়ে শুধু ‘পত্রিকা’। এটা প্রতিষ্ঠিত লেখকগনের জলসাঘর। যত সমৃদ্ধই হোক, যত সত্যিই হোক না কেন একেবারে নতুন কারো সৃষ্টিকর্ম নিয়ে এরা মাথা ঘামায় না। কোয়ালিটির দেয়াল পেরিয়ে নতুনদের সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
আরেকটি যে ধারা আছে, তাকে লিট্লম্যাগীয় ধারা বলা যায়। আজও নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে যাবো-যাবো অবস্থাতেই এই পত্রিকা বের হয়। ফলে জগাখিচুড়ির একটা গন্ধ থাকেই। কিন্তু মজার বেপার হচ্ছে শেষপর্যন্ত বেরটা হয়েই যায়। এটাই তারুন্য। দিনেশ-গোকুলের (কল্লোল) হাত ধরে কয়েকটা যুবক যেমন নজরুল, প্রেমেন্দ্র, বুদ্ধদেব হ'য়ে উঠেছিলেন, সেইসাথেই কিন্তু বাংলা সাহিত্যও তার আধুনিকতার ফিনিশিং টাচ্টা পেয়েছিল। বুদ্ধদেব বসু তার প্রগতি বা কবিতা'কে সংগায়িত করতে গিয়েই হোক আর দিলীপ কুমার গুপ্ত তার ‘কৃত্তিবাস’ ছাপতে গিয়েই হোক – তাঁরা লিট্লম্যাগ শব্দটা ইংরেজী থেকে ধার করেছিলেন। পঞ্চপাণ্ডবের কাজই ছিলো শক্তির স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে আরেকটা বিকল্প শক্তিকেন্দ্র নির্মান। প্রাচ্যের প্রজ্ঞা আর পশ্চিমের বস্তুবাদকে মিলিয়ে তারা নিশ্চয়ই উত্তরাধুনিকতার স্বপ্নই দেখেছিলেন। আবার উত্তরাধুনিকতার উল্টোপিঠের মুখোশ খুলে নিতে এসেছিলেন হাংরি জেনারেশন। লিটলম্যাগের বাহনে চড়ে উত্তরআধুনিকতা বাংলাসহিত্যে এলো বটে, কিন্তু কাল না পেরুতেই সে লিটলম্যাগ উত্তরাধুনিকতাকে বহন করে নিলো। আবেগসম্বল কিন্তু দৃঢ়সংকল্প নিয়ে সম্পাদক বিখ্যাত লেখকদের দুই একটা রচনা আর বন্ধুবর্গের গুটিকয়েক 'লেখা' নিয়ে একপ্রকার সংকলন বের করেন। কিন্তু দারিদ্র আর আবেগকে সম্বল করে যে সংকল্প করা হয়, ডালপালা গজিয়ে তা কাল বা সাহিত্যে কোনো জায়গা করতে পারে না। সুনিল যেমন বলেন এই পত্রিকা হৈ চৈ করে কিছুদিন বাঁচে তার পরেই মরে যায়। ব্স্তুবাদ বা ঔপনিবেশিক পিতৃত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে যে ধারার উৎপত্তি, বিভিন্ন বিপ্লব যে পত্রের বাহন - সেই বাহক-ই শেষাবোধি জ্বরাজীর্ণ। আদর্শভিত্তিক ও গোষ্ঠিকেন্দ্রিকতা থেকে দূরে সরে এসে এই ধারাটি এখন আবেগভিত্তিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আর ইউরোপ বা পশ্চিমে এসবের আগাগোড়া অনেক আগেই বিলীন।
এটাকে অবক্ষয় বা প্রয়োজনের সাপেক্ষে অনেক তর্ক করা যেতে পারে। আশা বা হতাশাবাদীরাও তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্তু একটু উপর থেকে দেখলে লিটলম্যাগের এই অবস্থাকে বিবর্তন বলা যায়। কোনোক্রমেই আবার পরিবর্তন বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। সব সৃষ্টির পেছনে কমবেশি একটা মেনুফেস্টো থেকেই যায়। সেখানেই থাকে বদলে যাবার আহ্বান, গতানুগতিকতার মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস। সমাজের সেই অশুভ চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ করার প্রকৃতিটা আলাদা হতেও পারে, কিন্তু উদ্দেশ্যটা একই।
লিটলম্যাগ ধারনাটা ইউরোপ থেকে আমদানী হলেও বঙ্গজে তার চেহারা অনেকটা আলাদা। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরনে তার বড় অবদান আছে। কখনও ভূ-রাজনৈতিক, কখনও ইতিহাস, বা স্রেফ সাহিত্যিক প্রেরনা (কেউ কেউ বলেন ‘কেয়ার ফ্রি প্যাশন’) থেকে এই ধারা একটা পোক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। মফস্বল বা গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে’রা এর মাধ্যমে জানাচ্ছে তাদের আনন্দ, বেদনা, প্রতিবাদ। ধারন করছে সময়। প্রগতিশীলতার প্রতীকও বলা যায়। রাজধানীতে এই চেহারা আবার আরেকটু ভিন্ন। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা তাদের লেখনীর হাতেখড়ি করে এই পত্রিকার মাধ্যমে। সামাজিক অসংগতির বিরুদ্ধে যুবারাই চিরদিন প্রথমে বিদ্রোহ করে থাকে। জীবনবাস্তবতার যুদ্ধের ঠিক আগমুহূর্তে যে সংঙ্কা, আনন্দ বা স্বপ্ন - সেসব উপজীব্য করে তারা আঁচড় কাটে লিটলম্যগের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন চুরি হয়ে যায়, যখন কেউ কেউ প্রাতিষ্ঠানিকতাকে চাপিয়ে দেন, ব্যবহার করেন নিজের নাম বৃদ্ধিতে। বিরুদ্ধাচরন করলে হিংস্র বলির স্বীকার হয় অনেকেই। মাঝখান থেকে প্রত্রিকটা মুখ থুবড়ে পড়ে ইতিহাসের কোলে। বিশ্ববিদ্যালয় পার হবার পর যখন তারা ব্যক্তি হয়ে ওঠার ধ্যানে ব্যস্ত তখন একসময়ের ভালোবাসার উপাদানটি বড্ড অচেনা বনে' যায়। সংকটে যখন নাকটা ডুবে যায়; সমাজ, রাষ্ট্র, আইন ও ধর্মের স্বরূপ তখন আরো স্পষ্ট হয়। কিন্তু চারপাশে হাতড়ে হাতিয়ারটা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নপুংসক সামাজিক সব প্রতিষ্ঠান এবং নির্লজ্জ ভোগবাদের বিরুদ্ধে যখন তাদের সাহিত্যিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার কথা তখন তারা ছাপোষা কেরাণি হবার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। আসলে সমস্যাটা আরও গভীরে।
আমাদের সাহিত্যের একটা সমৃদ্ধ অতীত থাকলে কী হবে, গত চল্লিশ বছর ধরে কোনো দক্ষ প্রজন্ম তৈরি হয়নি যারা সমুজ্জল অতীত, সংঘাতময় বর্তমান আর স্বাপ্নিক ভবিষ্যৎ নিয়ে এগুবে। তরুনদের একটা বড় অংশ আজ শেকড়হীন। সংস্কৃতির গহনাগুলোকে তারা ফ্যাশান বলে চালিয়ে দিতে চায়। ভঙ্গুর শাসন ব্যবস্থা, চরম দুর্নীতি, নির্লজ্জ ভোগবাদিতা, নিরর্থক শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে এরা বেড়ে উঠছে। হাজার বছরের পরাধীনতা ও যুদ্ধ আমাদের সমাজের বুনন, মূল্যবোধ এবং সম্পর্কগুলোকে নড়বড়ে করে ফেলেছে, ফলে তরুনদের ভাষাটা হয়ে পড়ছে নপুংসক। কিন্তু কথাছিলো পরাধীনতার অভিজ্ঞতা, মুক্তিযুদ্ধের শক্তি আর বাঙালিত্ব মিলিয়ে একটা শক্তিশালী আধুনিক যুবসমাজ তৈরি হবার। যে মুক্তিযুদ্ধ ছিলো একটা জাতির যূথবদ্ধ প্রয়াশ, এক সংগে জেগে ওঠার অনুশীলন, এক মহাজাগরণ। তবে একটা আশার কথা হচ্ছে প্রযুক্তি ও গণসচেতনতা ইদানিং যুবসমবজের আচারনের অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। এদের একটা বড় অংশ সংস্কৃতিবান কিন্তু সংস্কারমুক্ত, এরা বৈশ্বিক এবং বিজ্ঞানমনস্ক।
কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে। কম্পোজ করতে এখন কেউ আর অন্যের বাড়ি বা দোকানে হণ্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় না, নিজেরাই কাজটা সেরে নেয়। এমনকি প্রুফটাও দেখে ফেলে। কেবল বইয়ের আকার দেবার আগেই ছাপাখানার কথা বিবেচনা করলেই হয়ে যায়। কিন্তু ঘটনা আরও এগিয়ে গেছে। ব্লগিং আজ লিটল ম্যাগের ধারনা পাল্টে দিচ্ছে। এখন ছাপা হবার জন্যে আর ঠাঁয় বসে থাকতে হয় না, লেখা শেষ তো তুলে দাও যে কোনো ব্লগে অথবা সামাজিক পৃষ্ঠায়। কিছুক্ষণ পরে জালে মাছ ধরা পড়ার মতো মন্তব্যে, সমালোচোনায় লেখাটা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। লিটল ম্যাগ আকারেই কিন্তু ওয়েবসাইটে বের হচ্ছে আজকাল বেশকিছু বাহারি পত্রিকা। সাহিত্য ভূ-রাজনৈতিক সীমানাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলে যাচ্ছে পৃথিবীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। প্রযুক্তিবান্ধব বাংলার গ্রামান্তরও যুক্ত হচ্ছে এই আন্তর্জালিক আহ্বানে। প্রযুক্তির এই আশির্বাদ কাজে লাগিয়ে বিপ্লবও পাল্টে ফেলেছে তার চেহারা মধ্যপ্রাচ্যে।
বাংলাদেশের একচতুর্থাংশ আজ তরুন। তাঁদের ভেতর উল্লেখযোগ্য একটা অংশ নিশ্চয়ই সুশিক্ষিত এবং স্বশিক্ষিত। তাঁদের হাত দিয়েই প্রতিবছর প্রকাশিত হচ্ছে জানা অজানা কয়েকশ’ লিটলম্যাগ। বইমেলার একটা অংশ জুড়ে তাঁদের দাপট। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক উপলক্ষকে সামনে রেখে সারা বাংলা জুড়ে বের হচ্ছে এসব পত্রিকা। কিন্তু আক্ষেপটা হলো এর প্রতিবাদ করার শক্তিটা নিয়ে। প্রযুক্তি আছে, অসংগতি আছে, প্রতিবাদের মাধ্যম আছে কিন্তু সেই যুগ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠি নেই, আধমরাদের চিন্তা বা বিশ্বাসের সমূলে আঘাত হানবার মতো ভাষা নেই। তাইবলে আস্থাহীনদের সারোথী নই আমি। একটা জনপদের ভাঙনের শব্দও যেমন শতাব্দীকাল ধরে শোনা যায়, জেগে ওঠার জন্যেও অপেক্ষা করতে হতে পারে প্রজন্মান্তর। স্বাধীনতাউত্তর সেই প্রজন্ম তৈরি হতে সময় নিচ্ছে বৈকি, কিন্তু জমাটবদ্ধ অন্ধকারের গায়ে চীড় ধরছে, ভেতরের গোঙানি - গর্জনে পরিনত হতে খুব আর দেরী নেই। আপনিই হয়তো সেই মহাজাগরনের প্রথম সৈনিক।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




