একজন অভিজিৎ ও সময়ের ঘণ্টি
গোলাম রব্বানী
১.
এই ছাব্বিশ তারিখের আগেও হাতে গোনা ক’য়েকজন অভিজিতের নাম জানতো। তাঁকে রাজনীতিক মহাজনেরা চিনতেন না। টক’শো করতো না, ফলে উঠতি বা পাকা – কোন আঁতেলের পর্যায়েও সে পড়তো না। কোন নায়ক, গায়কও না যে উঠতি যুবতীরা তাঁর ছবি দিয়ে মোবাইলের স্কৃন সেভার বানাবে। ঢাকায় একটা শিক্ষিত পরিবারে বেড়ে ওঠা মেধাবী এই তরুন প্রযুক্তিবিদ: চাকুরি, ডলার, বাড়ি, মডেলের গাড়ির পেছনে না ছুটে জ্ঞানের পিছু ধরেছিলেন। তাঁকে তিন ধরনের মানুষে চিনতো। এক. যাঁরা দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান এবং হ্যাঁ, ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতেন; তাঁদের সবাই না, কেউ কেউ। দুই. তাঁর সহকর্মীরা, যারা জীবিকার সূত্রে জৈবপ্রকৌশল নিয়ে কাজ করতেন। আর তিন. তাঁর পরিবার ও বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব।
অভিজিৎ এমন একটা দেশে এমন একটা সময়ে বেড়ে উঠেছেন যখন প্রত্যেক সরকার প্রগতি, মুক্তচিন্তা, হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বরং ধর্ম-ব্যাবসায়ীদের(কেউটে সাপের) মুখে চুমু খেয়ে এরা সবাই ক্ষমতায় এসেছে, দুধ-কলা দিয়ে বড় করেছে। অন্যদিকে যাঁরা প্রগতি, মুক্তচিন্তা বা ধর্মীয় সহাবস্থানের কথা মনে করিয়ে দিতে কলম তুলে নিয়েছে তারা-ই বলির পাঁঠা হয়েছেন। খুন হয়েছেন হুমায়ুন আযাদ, মোহাম্মদ ইউনুস, এম তাহের, এ কে এম শফিউল ইসলাম, জিয়াউদ্দীন জাকারিয়া, রাজিব হায়দার, আশরাফুল আলম, আরিফ রায়হান দ্বীপ, জগতজ্যোতি তালুকদার, জাফর মুন্সী এবং সাম্প্রতিক অভিজিত রায়। এছাড়া অনেকেই হুমকির মুখে রয়েছেন, কেউবা দেশ ত্যাগ করেছেন। প্রত্যেক সরকার এইসব হত্যার বিচার হবে, অপরাধী ধরা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ব্যাস, ও পর্যন্তই। সবাই জানে কারা খুন হয়, কে খুন করে, এমনকী কবে নাগাদ করা হয়ে থাকে। মানুষ এটাও জানে এসব খুনের বিচার হবে না।
অভিজিতের লেখা সম্পর্কে যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক দু’চারজন যেমন খোঁজ খবর রাখতেন, তার চেয়ে ঢের বেশি খোঁজ রাখতো মৌলবাদীরা। তারাই তাঁর লেখাকে ভয় পেত, অনেকেই না পড়েই ভয় পেত এবং কেবল তারাই তাঁর শত্রু ছিলো। কিন্তু লেখার জবাব লিখে, প্রতিযুক্তি দিয়ে ওরা উত্তর দিতে পারে না। লিখতে গেলে যে ঈমানি এলেমের দরকার, যে কল্বের দরকার তা তাদের নেই। কারণ তারা মুর্খ, ফলে অভিজিতের যুক্তির কাছে হিংস্রতা, খুন-ই মৌলবাদীদের একমাত্র উত্তর। অভিজিতের শত্রুরা তাই চিহ্নিত এবং এদের ক্ষমতা, হিংস্রতা ও আক্রমনের প্রকৃতি এবং ভয়াবহতা সম্পর্কে অভিজিত নিজেও যে জানতেন না, তা নয়। তাঁর মতো অন্যান্য সবাইকে তিনি সতর্ক করে দিতেন, সাবধানে থাকতে বলতেন। কিন্তু শত্রুকে আক্রমন করার জন্য অস্ত্র তুলে নেয়া অথবা অবসম্ভাব্য আক্রমন থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করার কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবতেন না। তিনি মৌলবাদীদের আক্রমন করার পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকায় আসতে পারতেন। বাদ জুম্মা এক মাহফিলে গিয়ে স্টেজের ডজনখানেক হুজুরের গর্দান ফেলে দিতে পারতেন। পরদিন আমেরিকার ফ্লাইট ধরে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু সেই চিন্তা তাঁর কখনো আসে নি, আসতে পারেও না। আহত তৃষ্ণার্ত হরিনের থেকেও তিনি তাই ঝুঁকিতে ছিলেন। জন্মভূমি যে মৃত্যুকুপ হতে পারে, এটা মানলেও সেই মৃত্যুকুপ তাওয়াফ করা থেকে অভিজিত নিজেকে ঠেকাতে পারেনি।
ফেসবুক থেকে জানা গেছে তিনি বাংলাদেশে আসছেন। আসছেন চিহ্নিত মৌলবাদীদেরকে নিশ্চিহ্ন করার মিশন নিয়ে নয়, নিজের দুই দুটো বই বের হয়েছে সেই পুলকে। বইগুলো মেলায় স্টলে উঠবে, দুই একজন তাঁর বই কিনতে যাবে। কেউ লেখকের বা বইয়ের নাম ধরে আছে কি না জিজ্ঞেস করবে, প্রকাশক চকচকে বই বের করে দিবেন। বইটা হাতে নিয়ে মলাটের এপাশ-ওপাশে হাত বুলিয়ে মানিব্যাগ থেকে টাকা গুনে দিয়ে ভিড়ে মিলিয়ে যাবে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে লেখকের এই দৃশ্য দেখার চেয়ে আনন্দের আর কী থাকতে পারে? আর কেউ যদি লেখকের কথা জিজ্ঞেস করে এবং স্টলের ভিতর বসা লেখককে দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করে তাঁর লেখার প্রশসংসা করে, অটোগ্রাফ চায়? একজন লেখকের জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তির আর কী থাকতে পারে! অভিজিতের খুনিরা জানতো: সে বাংলাদেশে আসছে, বই মেলাতে যাবে না, তা হবে না। গেলে বডিগার্ডও রাখবেন না, পকেটে মেশিন এর বদলে বরং বৌ নিয়ে ঘুর ঘুর করবেন। সস্তায়, নির্ঝঞ্ঝাটে এমন একটা মাথা কুপিয়ে ভাঙ্গা, ঝুনা একটা নারকেল ভাঙ্গা থেকে সহজ। হজম করে ফেলা আরও সহজ। নাস্তিক ছাপ আগে থেকে মারা আছে, ফলে সরকার বা আমজনতা কেউ টু শব্দটি করবে না। বরং নামাজী জনগণ ভেতরে ভেতরে বলবে কাফেরটা মরেছে, যে মেরেছে সে আস্ত একটা জান্নাতুল ফেরদাউস পাকাপোক্ত করে নিলো। ফজরের নামাজ শেষে দু’হাত তুলে মুনাজাতে বলবে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকেও যেন এমন একজন নাস্তিক, কাফেরকে কতোল করবার তৌফিক দান করেন।
২.
প্রথম দুই চারদিন অভিজিতের খুন নিয়ে রাজনীতি হয়নি, টু-শব্দও হয়নি। তার পর বরাবরের মতো বিভিন্ন ছাতার নিচ থেকে লোকজন বের হতে শুরু করেছে। সবাই খুনের বিচার চায়। কিন্তু কেউ খুনের কারণ খুঁজতে চায় না। কারনটা যে খুব অজানা, তা কিন্তু নয়। কারনটা নিয়ে কথা বলতে গেলেই অভিজিতের গন্ধটা গায়ে মেখে যাবে, সহজ কথায় নাস্তিকতার ছাপ লেগে যাবে। কেউ নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের তকমা নিয়ে বাজারে, চায়ের দোকানে, মসজিদে যেতে চায় না।
কারা এই ছাপগুলো মারে? দূরের কেউ নয়, সে আপনার আপনজনেরাই। আরেকটু সাহস নিয়ে কথা বলতে থাকলেই সেই ছাপ ছড়িয়ে যায় লোক থেকে লোকান্তরে। যতই মানুষটার মাথা থেকে চির পরিচিত ভুতগুলো খসে পড়তে থাকে, চিন্তাটা ততই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে, ততই দেয়াল উঠে যেতে থাকে চার পাশে। সমাজ আড়চোখে তাকাতে শুরু করে এবং অচিরেই নাকের ডগায় বসে থেকেই সে ভিন গ্রহের প্রানীতে রূপান্তরিত হয়। এখানে সমাজ- স্কুলের বুড়া ইংরেজি মাস্টার নয়, সন্ধ্যায় বাজারে চা’খাবার মানুষগুলো। এদের হাতেই আপনার আমার ছেলেপুলেরা বড় হয়ে ওঠে। শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পড়তে যায়।
৩.
সেখানে শিরদাঁড়া ফুলিয়ে ঈমাম শাশিয়ে দেন গান শোনা, সিনেমা দেখা হারাম। বিয়েতে আতশবাঁজি ফোটানো হারাম। যাত্রা, সার্কাস দেখতে যাওয়া হারাম। গান শেখানো, নাটক করতে শেখা হারাম। কবিতা পড়া হারাম। বাদ্য বাজানো হারাম। মেয়েদের খোলা পুকুরে গোসল করতে যাওয়া হারাম। বিকেলে খেলতে যাওয়া হারাম। ফুটবল হচ্ছে শয়তানের ডিম। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেছেন তোমাদের বাড়ির ‘মেয়েছেলে’দেরকে সামলে রাখো। তুমিই বাড়ির প্রধান, কেয়ামতের দিন তোমাকেই তোমার স্ত্রী-ছেলেমেয়ের কাজের হিসাব দিতে হবে। এইসব হারাম কাজের ফলে ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যাবে। কাল পরকালের মাঠে, হাশরের ময়দানে নিজেদের সাথে তাঁদের পিতা-মাতাদেরও দোজখে নিয়ে যাবে। আজ জুম্মাবাদ বাড়ি গিয়ে ঘরের মেয়েছেলেদের, বাচ্চাদের তওবা করাবেন। ওয়াদা করাবেন সবাই কুরআন মুখস্ত করবে, হাদিস পাঠ করবে, সময় পেলেই নফল নামাজে দাঁড়িয়ে যাবে এবং অন্যকে ডাকবে। ভালো কাজে আহ্বান করবে। তাতে দু’জাহানের অশেষ নেকি হাসেল করবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সব্বাইকে সেই তাওফিক দিন। সবাই বলুন আমিন (বারাকাল্লাহু লানাওয়া লা ফি কুরআনুল মাজিদ, ওয়াল ফুরকানিল হামিদ। ইন্নাহু তায়ালা, যাওয়াদুন, কারিমুন, ওয়া মালিকুন, ওয়া বাররুর রাওফুর রাহিম)।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আরব বা পশ্চিমা যে দেশেই হোক না কেন মুসলিম পরিবারে ঈমামের প্রভাব অসীম। তাছাড়া সমাজিক বিন্যাসে মুফতি, মাওলানা, হাজী, কুতুব, আলেম এমনকি মুয়াজ্জিনদের অবস্থানও অসাধারণ চোখে দেখা হয়। পাড়ার বিয়েতে, ঈদের সময়, মিলাদে, নির্বাচনের জনসভায় তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় উদ্বেলিত হতে দেখা যায়। রমজানের সময় হলে এসব অনুভুতি আরো প্রকট আকার ধারণ করে। অথচ এরা কেউই দুই চার পাতা না বোঝা ভাষায় কুরআন-হাদিস ছাড়া কিচ্ছু পড়েনি। পড়ার প্রয়োজনও মনে করে না। আসলে তেমন কিছু না থাকলেও ওটাই সর্বজ্ঞানের ভাণ্ডার বলে দাবী করা হয়। এসব গণ্ডমুর্খ হুজুরেরা মুসলমান সমাজে সবচেয়ে উপরে অবস্থান পায়। সমাজের চোখে আলেম-ওলামাদের যে সম্মান সেটার লোভ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাও সামলাতে পারেন না। উপরুন্তু সুযোগ বুঝে বিজ্ঞানকে ধর্মের গ্লাসে বা ধর্মকে বিজ্ঞানের গ্লাসে উপস্থাপন করার মজাটা এরা বরং শুধু আলেম-ওলামাদের চেয়ে বেশি ভোগ করতে পারে। এরাই বাদ এশা জলশায় জিহাদের ফজিলত বর্ণনা করে, এরাই দেখিয়ে দেয় ইসলামের শত্রুদের। এখান থেকেই সন্তর্পনে সবচেয়ে মেধাবী, সাহসী ও সুঠাম ছেলেটাকে বেছে নিয়ে স্পেশাল তালিম দেয় আল্লাহর সৈনিক হবার। রাতের অন্ধকারে সবাই যখন ঘুমিয়ে, তখন তাহাজ্জত নামাজের নামে সে তালিম নিতে থাকে। জন্মগ্রহন নেয় জামায়াতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ, আনসারুল্লা বাংলা টিম, হিজবুত তাহরিরের মতো সশস্ত্র আত্মঘাতী সংগঠন।
৪.
কিন্তু একজন মুসলিম কেন এরকমটি চাইছেন? কারনটি ব্যক্তি নির্ভর নয়। একটা পুরুষ যখন ছওয়াবের আশায় সব ধরনের আনন্দ উতসব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, একজন মহিলা পরকালে বেহেস্তের আশায় যখন সারা জীবন সব ধরনের চাহিদাকে জলাঞ্জলি দিয়ে কালো কাফনে মুড়ে ফেলে, একজন শিশু ধর্মীয় বিদ্বেষের ভিতর বেড়ে ওঠে এবং ভালো-মন্দ বিচারের মানসিকতায় ধর্মকেই একমাত্র মাত্রা হিসেবে গণ্য করতে শেখে তখন সেই সমাজের ‘ধর্মীয় (পড়ুন ইসলামিক) অনুভুতি’ মারাত্মক অবস্থা ধারণ করতে বাধ্য। আমাদের ছোট বড় যে কোন সিদ্ধান্ত এবং কাজের পেছনে যে ‘কারণ’, তা যখন কেবলমাত্র ধর্ম থেকে উদ্ভুত হয় তখন সংস্কৃতির অন্যান্য সব উপাদানের সাথে সংঘাত দেখা দেয়। হুজুরেরা এর দ্বারাই প্রভাবিত এবং অন্যকে দাওয়াতের নামে, ছোয়াব ও জান্নাতের নিয়ামতের দোহাই দিয়ে এই পথে প্রলুব্ধ করে। মানুষ এই হাজার হাজার বছরের অভিযাত্রায় বিশ্বাস ও যুক্তির ঘেরাটোপ থেকে বাইরে বের হতে পারেনি। ব্রেন-ওয়াশিং কাজটা তাই ধর্মকে ব্যবহার করে হুজুরেরা যতটা সহজে পারে, বিজ্ঞান বা যুক্তি দিয়ে তা প্রগতিবাদীরা ততো সহজে পারে না। আজও পরিবারের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেটা যখন ভালো রেজাল্ট করে, সাথে সাথে নামাজ পড়ে, ধর্মের সাথে বিজ্ঞান মিলিয়ে মুখরোচক ব্যাখ্যা দেয় তখন সে রাতারাতি সমাজে সেলিব্রেটি হয়ে ওঠে। বিজ্ঞান জানা ও বিজ্ঞান মনষ্ক হওয়া এক কথা নয় কিন্তু বাস্তব সমাজে ধর্মের মোড়কে যারা বিজ্ঞানকে তুলে ধরতে পারে তারাই সবচেয়ে সফল। এদের কাছেই অভিজিতকে হত্যা করা ফরজে আইন। এদের কাছেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য দাওয়াত ও জিহাদ।
অভিজিতের খুনের পরে যাঁরা এর বিচারের পাশাপাশি, কারণটা খুঁজে দেখতে চাইছেন, তাঁরা-ই বাংলাদেশের শেষ বুদঃবুদ। এরা খুব বিচ্ছিন্ন, ফলে দুর্বল। ওহাবিরা যে কাজ ২০১৪ সালে করছে ইরাকে, সিরিয়ায়, ইউরোপে বা আমেরিকায়; অভিবক্ত ভারতে দেড়শ’ বছর আগে থেকে একই ভাবে একই কাজ করে আসছে। বাংলাদেশ যে কারনে জন্মেছিলো সেই কারনের উপরে ওহাবিদের আঘাত চিরদিন ছিলো এবং থাকবে। এখানে মুক্তচিন্তা, সহাবস্থান, প্রগতিশীলতা কোনদিন ভাত পায় নি, পাবেও না। কিন্তু অভিজিতেরা তা বোঝে না। ওরা খুন হবার জন্যেই জন্মায়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




