somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাস্তিক ও মুসলমান: ধর্মানুভূতি

১৭ ই মে, ২০১৫ দুপুর ১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



স্থান:

বাংলাদেশ সার্বিকভাবে এখন মুসলমানদের দেশ। ইদানিং ধর্মানুভূতি বলতেও অন্য কোন ধর্মের অনুভূতিকে বোঝায় না, শুধুমাত্র মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি বোঝায়। এখানে ভিন্ন কোন ধর্ম, আদর্শ বা দর্শনের উপর বিশ্বাস এমন কি সংশয় এখন অবাঞ্চিত, পাপ। তা সে সাধারণ মানুষের কাছে হোক, প্রশাসন বা রাজনীতিকদের কাছে হোক: পাপ, পাপ-ই।

কাল:

৬ই মার্চ ১৯৯৯ (উদীচী হামলা), ১৪ই এপ্রিল ২০০১ (রমনা হামলা), ১৭ই আগস্ট ২০০৫ (৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা), ২১শে আগস্ট ২০০৫ (ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা) এসব ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। এসবের থেকে সাধারণ মানুষেরও কিছু শেখার নেই, রাজনীতিকদের তো প্রশ্ন-ই আসে না। পুলিশ, গোয়েন্দা, সরকারী প্রশাসনের আসলে অত সময় নেই এসব ঘাঁটাঘাঁটি করার।

রাজনীতির ক্ষেত্রে যত বড় খুনি, যত বড় ডাকাত, যত বেশি ঋণ খেলাপি: তত ‘বড় নেতা’। চাকুরির ক্ষেত্রে যত বেশি ঘুষ, যত বেশি বসের পা চাটা: তত প্রমোশন। স্কুল, কলেজে প্রশ্ন আউট, ক্লাসে নকল, ইসলামপরায়ন শিক্ষানীতি, না লিখলেও নম্বর দিয়ে শিক্ষাবোর্ডে পাশের হার বাড়ানোর প্রতিযোগীতা। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আজ জামাই উপাচার্য, তো ভাই চেয়ারম্যান, শ্বশুর ডীন, ভাইরা প্রক্টর, শালী কোষাধ্যাক্ষ, ছেলে-মেয়ে প্রভাষক। সরকার বদলের সাথে এইসব পদও বদলে যায়।

আজীবন ফতোয়াবাজ, নির্যাতনকারী, রাজাকার যখন সরকারী দলের ‘দেশ প্রেমিক’। তখন বাকি ‘এক জন’ও বিক্রি হতে বাদ থাকে না। ঐ ‘এক জন’-এর আঁচলের তলায় বড় হওয়া বখাটে যুবক তখন ‘সোনার ছেলে’।

সাংবাদিক, শিক্ষক, ব্লগার হত্যা; রাস্তাঘাটে যুবতী মেয়েদের ‘নেংটা করা’ এসব এখন স্রেফ ‘দুষ্টামি’।

পাত্র:

ঠিক এমন এক গ্রহণকালে বাংলাদেশের বুকে কান পাতলেই শোনা যায় কিছু পরিচিত সান্ধ্যালাপ। প্রত্যেকেরটাই আলাদা কিন্তু পাহাড় সমান:

১. অনন্ত বিজয়ের খুন আমাকে রাস্তায় নামাতে পারে নি। আমি পাথর হয়ে গেছি। এসব প্রতিবাদ সমাবেশ করে কিচ্ছু হবে না। ওয়াশিকুরের খুনে আমি দুই দুইটা বিশাল স্টাটাস দিয়ে, কমেন্টস করে, শেয়ার দিয়ে শোক প্রকাশ করেছিলাম, প্রতিবাদ করেছিলাম। অভিজিত ব্লগ চালাতো, আমেরিকায় থাকতো, ভালো চাকুরি করতো, দেখতেও হ্যান্ডসাম ছিল তাই তার জন্য প্রতিবাদ করতে অফিস থেকে আসার পথে মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। বন্ধুকে বলেছিলাম জানিস মিছিল থেকে এলাম, অভিজিতকে খুন করে ফেলেছে, বাংলাদেশ রসাতলে গেল। অভিজিত রায়েরা হেরে গেলে, হেরে যাবে বাংলাদেশ।

২. অনন্ত বিজয় আবার কে, নাম শুনিনি। আরে ভাই আমি ওসবের মধ্যে নেই। ওসবের দিন শেষ, এক সময় কত্ত করেছি, এখন আর না। শরিফ ভাইরে চিনো? এক লগে মিটিং করছি, কুপা কুপিতে নেতৃত্ব দিছি মিঞা। এখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছি। রাত তিন চারটে অবধি বায়ারদের মেইলের রিপ্লাই, স্কাইপ, ভাইবার কইরা ঘুমাইতে গেছি। সারাদিন কারখানা ঘুরে দেখাও, বাজার করো, নামাজ পড়, ভাত খাওয়ার টাইম নাই। এর মধ্যে আবার কী সব অনন্ত ফনন্ত! এইগুলার টাইম নাই। শুনছি এইগুলা আমাদের নবীরে গাল দিছে, কার্টুন বানাইছে, এইগুলা শালা নাস্তিক। ইসলামরে নিয়ে খুঁচাইতে আসে ক্যান, আর কাম নাই? চুলকাইতে গিছে, কুপাই দিছে, ঠিক-ই আছে!

৩. আরে তোমরা ছেলেরা ওসব করো ক্যান বলো তো? বাপ মা খাটুনি খাইটা কী তোমাদের বড় করছে এইসব করার জন্যে? বাপ মা’র দিকে চাও না তোমরা। পড়া লেখা শিখছো, চাকরি করো, বিয়ে করছো, এখন একটা মাথা গোঁজার ঠাই তো হওয়া চাই, না কী? তোমার বয়সের মুকুল, তোমার চেয়ে বয়সে ছোট রোকন দেখ কেমন সুখের চাকরি করছে, দুই ছেলের বাপ। আর তুমি! বোমা মারলেও দুই পয়শা বাইর করার ক্ষমতা নাই। মা’র অষুধ কিনবার, মোবাইলে দুইটা টাকা দেবার মত টাকা থাকে না। চাকরির দুই পয়সা কামায় করো কি না করো, বারো ভুতেরে দিয়ে খাওয়াও। লজ্জা করা উচিত। নিজের বাপরে ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতা নাই আবার রাত জেগে লেখা-লেখি। মাস শেষে দুই পয়সা বেতন তা দিয়ে আবার বই কেনা। ওসব কী পেটে ভাত দেবে? সময় থাকতে বুঝো, নইলে পস্তাবা।

৪. পাড়ার লোকজন সব ছিঃ ছিঃ করে। ইসলামরে নিয়া, আমাদের নবীরে নিয়া কী সব কইছো? কী দরকার এইসব কথা বলা? কই পাও এই সব ফালতু বই? শুক্রবারেও তো উষ্টা দিয়ে মসজিদমুখী হও না। তুমি ইসলামের কী বুঝো? বড় জ্ঞানী হয়ে গিছো, না? এসব কথা যেন আর কোন দিন না শুনি। বই খাতা আমি সব পুড়াই দিবো। এই কম্পিউটার সব নষ্টের গোড়া। সারাদিন গুটুর গুটুর ফুটুর ফুটুর, ফেসবুক-টেসবুক কিসব। কোন ভালো পোলাপান এই বয়সে ওসব করে না।

উদ্দেশ্য:

প্রগতিশীল(!) বাংলাদেশে এদের সংখ্যা-ই ১০০%। ৫৬% অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের দেশে হাতে গোনা দুই চার জন জ্ঞানের সাথে জীবনের মিল খুঁজতে যায়, এরা গোনার মধ্যে না পড়া ‘ব্যতিক্রম’। ১০০% এদেরকে ডাকে ‘নাস্তিক’। দুষ্টামি হলেও সত্য: একমাত্র এরাই সমাজটা পাল্টাতে চায়, এমনকি বিশ্বাসটার মুলে আঘাত করার দুঃসাহস দেখায়! অথচ তলায় হাত দিয়ে দেখে না ওজন কত! কী হয়ে কাকে পাল্টাতে চাওয়া হচ্ছে! এই চাওয়ার কৌশলটা কী! লিখে? প্রথাগত চিন্তাকাঠামো, বাপদাদার অভ্যেস, দানবের দানব প্রশাসনযন্ত্র সব পাল্টিয়ে ফেলতে চায় কেবল ‘লিখে’!

উপায়:

দেখুন: হুমায়ূন আযাদ, রাজিব হায়দার, অভিজিত রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় কী উপরের কথাগুলো জানতেন না? এটাও কী জানতেন না যে ঠিক এই কারনেই বেঁচে থাকাকালীন এরা কেউ থালে ভাত পাবে না? জানতেন। তারপরেও বিবেকের তাড়নায় স্থান, কাল বিবেচনা না করে যতটুকু পারতেন কেবল ‘লিখতেন’। আমরা ঐ ১০০% এর ভেতরে বলে খুন হবার পরেই আমরা এদের নাম জানতে পারি। এবং ঠিক এই কারনেই আমরা কাল আবার এদের ভুলে যাবো। এবং আগে পরে কোনদিন আমরাও এদের একটা লেখা পড়েও দেখবো না। ক’জন আজ অবধি এদের বইগুলো, লেখাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি? এমনকি এদের খুন হয়ে যাবার পরেও? সেটার চর্চা করা তো দূরের কথা।

সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, যাঁরা খুন হয়েছে তাঁরা কি কোন প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা গ্রহন করেছে? করে নি। কোন মুখশের আশ্রয় নিয়েছে? নেয় নি। একে কী সাহস বলবেন? খালি গায়ে, খালি হাতে ক্ষুধার্ত কুমিরের পালের ভেতর বসে ‘সত্যবাণী’ শোনাবেন আর কুমিরেরা তাই শুনে সব ভালো মানুষ হয়ে যাবে? বিবর্তনবাদের ঝাণ্ডা উড়ানোর কৌশলটাও বিবর্তনবাদী হওয়া চাই, না হলে বিবর্তন হয় না, টেকে না। যা হয় তা তো দেখছেন, কিন্তু কেবল-ই দেখছেন।

এক্ষেত্রে যারা নাস্তিকতার পক্ষে মৌসুমি দুটো স্টাটাস দিয়ে, ইভেন্ট ডেকে একটা ফাইন ব্যালান্স করে টিকে থাকতে চাইছেন তাদেরই কেবল জয় সুনিশ্চিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান মনস্ক হতে চাচ্ছেন, যুক্তিবাদী হতে চাচ্ছেন তাঁদের শুধু পড়ালেখা করলেই চলবে না। লেখার কৌশল নিয়েও দু’পাতা পড়ুন। কী লিখলে, কী ভাবে লিখলে টার্গেটেড লোকজন ‘খাবে’ তা নিয়েও একটু ভাবুন। নইলে লিখে কী লাভ? হয় আত্মরতিমুলক বা উষ্কানিমুলক লেখা লিখছেন না কেবল তাহলে?


ক) একদল যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক চাকুরিজীবী এবং সবশেষে লেখক। তাঁরা বিজ্ঞানকে নিজের জীবন ও কর্মে প্রয়োগ করতে চায়, ফলে অজান্তেই জ্ঞাননির্ভর যু্ক্তিকে ধারণ ও প্রয়োগ করতে থাকে। ফলে প্রচলিত বিশ্বাসভিত্তিক যুক্তিগুলোর দেয়াল খসে পড়ে এবং তারা সবকিছুকেই প্রশ্ন করতে থাকে। এমনকি তারা সমাজের আর দশটা মানুষের বিশ্বাস, কর্ম ও চিন্তাকে প্রশ্ন করে ফেলে। খুব শিগ্গিরি-ই তারা পরিচিত চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় পড়ে এবং এই ‘পরিচিত চারপাশ’ যখন তাকে চ্যালেঞ্জ করে, হেয় করে, দূরে ঠেলে দেয়; তখন এসব প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ থেকে সে আরও শক্তি সঞ্চয় করে। দৈন্দন্দিন আর দশটা কাজের চেয়ে পড়াশুনা, চর্চা ও যুক্তিভিত্তিক প্রশ্নগুলোকে সবার উপরে প্রাধান্য দিতে থাকে। এই লেখককূলের কেউ কেউ আবার একটু বেশি উত্তেজিত। তাঁদের উত্তেজনা যুক্তিকে ছাপিয়ে যায় এবং স্রেফ আক্রমনের জন্য আক্রমন, তর্কের খাতিরে তর্কে উপনিত হয়। কিন্তু তাতে মাত্রাতিরিক্ত অনুভূতিপরায়ণ মুসলিমদের খুব একটা যায় আসে না। এরা চোর, ঘুষখোর, মুনাফেক, মিথ্যুক, সুবিধাবাদী, হারামখোর, অলস, ও মুর্খ হলে কী হবে ধর্মের অনুভূতির জায়গায় ষোল আনা।

খ) প্রতিপক্ষের আরেক দল ধর্মের খাঁচায় জন্ম নিয়ে, সেই খাঁচাকেই অমোঘ ধরে নিয়ে জীবনবাস্তবতাকে অস্বীকার করে কল্পনায় দিনাতিপাত করে। যার কাছে চারপাশে সব ভয়ানক শত্রু, পাপে ভরপুর। মানুষ বলে কিছু নেই। হয় মুসলমান না হয় কাফের। মুসলমানদের ভেতর কে কতখানি খাঁটি মুসলমান তার প্রতিযোগীতা আরও ভয়াবহ। এবং সে যা বিশ্বাস করে কেবলমাত্র সেই গোত্র ছাড়া আর সব টাইপের মুসলমানরাও কাফের। শিয়া সুন্নিরা একে অপরের কাছে কাফের। এছাড়া হানাফি, শাফি, হাম্বলি, ইসমায়েলি, আহলে হাদিস ছাড়াও শ’য়ে শ’য়ে ভাগ রয়েছে। কে নামাজের সময় কত বার সেজদা দিলো, কেমনে দাঁড়ালো, কে আমিন জোর গলায় বললো, কে কোন দুআ পড়লো তাই নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং একে অপরের চরম শত্রু। মোটা দাগে আবার এদের প্রত্যেকের কাছে মুসলমান বিনা সবাই ইসলামের জাতশত্রু। এক্ষত্রে হিন্দু, ইহুদী, খৃষ্ঠান, বৌদ্ধ, শিক, যে কোন উপজাতী সবাই ইসলামের শত্রু। এরা দিনরাত ২৪ ঘণ্টা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। এদের যে কোন কার্যকলাপ, পোষাক-আশাক, হাঁটা চলা ইসলামের জন্য চরম হুমকী। এই চরম আতঙ্কের ভিতর থাকতে থাকতে এরা মনে করে গান শোনা পাপ (শয়তানের কাজ), বাদ্যযন্ত্র বাজানো পাপ, ছবি তোলা পাপ, সিনেমা দেখা পাপ, হাসি-ঠাট্টা পাপ, বেড়াতে যাওয়া পাপ, গোড়ালির নিচে কাপড় পরা পাপ, গোঁফ না কাটা পাপ, চুল লম্বা রাখা পাপ, শার্ট-প্যান্ট লুঙ্গি পরা পাপ, ব্রাশ করা পাপ, কুলুপ না করা পাপ, বাম পাশে কাত হয়ে শোয়া পাপ, পশ্চিম দিকে পা দিয়ে শোয়া পাপ। এ তো শুধু পুরুষ-মহিলা উভয়ের বেলায়। তাছাড়া মহিলাদের বেলায় পাপ ও নিষিদ্ধের কোন সীমা নেই। সর্বাঙ্গ অনাকর্শনীয় কাপড় দিয়ে ঢেকে দরজা বন্ধ করে শুধু নামাজ আর কুরআন পড়লেই পাপ থেকে নিষ্কৃতি মিলবে না। তাকে শস্যক্ষেত্র হয়ে জীবন যাপন করতে হবে, কারনে অকারনে অপবিত্র হতে হবে। তখন এটা ছোঁয়া যাবে না, ওটা ধরা যাবে না, কোথাও যাওয়া যাবে না। এই জীবনকেই মুসলমানরা বলে ‘সম্পূর্ণ জীবন বিধান’। ইসলামের এই সম্মোহনী শক্তির ভেতরে ডুবে গেলে সেই মানুষ আর মানুষ থাকে না। সে তখন স্থায়ী ঘোরের ভেতর ঢোকে। তার বাপ মা, বোন, ঔরশজাত সন্তান, কবিতা, গান, প্রেমিকাকে ডিঙ্গিয়ে অজান্তে বাংলা ভাই, ওসামা, শফি বা তাদের জিহাদী সৈনিক হয়ে ওঠে।

ফলাফল:

এই জিহাদী সৈনিকেরা চারিদিকে, এমনকি স্কুল কলেজ হাসপাতালে কেবল কাফের মুনাফেক এবং ইসলামের শত্রু দেখে। ঠিক এই সময়ে যদি বড় হুজুর বলে শাহবাগ নাস্তিকদের জায়গা, প্রজনন চত্ত্বর, সে তো আর ভুল বলে না। জিহাদী সৈনিক তখন প্রত্যেক নামাজের শেষে দুই রাকাত নফল পড়ে হাত তুলে কান্নায় গলা ভাসায়। হে আল্লাহ, পরওয়ার দেগার তুমি তোমার বান্দাকে এরকম একজন নাস্তিককে কতল করে শহীদ হবার তৌফিক দাও। বড় হুজুর যখন ৮৪ জনের লিস্ট প্রকাশ করে তখন জিহাদী সৈনিকের জন্য কাজটা সহজ হয়ে যায়। প্রত্যেক পাড়ায় পাড়ায় তখন খোঁজ চলে, এশার নামাজের পর দ্বীনের আলোচনা একটু ঘনঘন শুরু হয়। ঐ ৮৪ জন বা তাদের মত এ পাড়ায় কে কে আছে তার খোঁজ পড়ে যায়। এবং মেসের সবচেয়ে মেধাবী, নামাজী, কথা না বলা, ভীড় এড়িয়ে চলা ছেলেটা আরও নামাজী হয়ে ওঠে। মাঝে মধ্যে কসাই খানার আশেপাশে ঘুরফির করে। সযত্নে রাখা চা’পাতিটাকে খুব আপন মনে হয় হঠাত, মিস করতে থাকে। বড় হুজুর আশ্বাস দেয় আল্লা’য় দিলে সব সময়মতো হাজির হয়ে যাবে। ওসব নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না। তার পর কোন এক শুক্রবার সন্ধ্যায় মাগরীবের নামাজ পড়ে সে চাপাতিটা সযত্নে ব্যাগে ভরে বের হয় যেখানে নাস্তিকটা প্রতিদিন সন্ধ্যায় চা-বিড়ি খেতে আসে । কিন্তু সেদিন সে ছোট্ট ছেলেটাকে যাদুঘর দেখাতে নিয়ে গেছে। শনিবার সকালে, যখন নাস্তিকটা রিক্সায় করে অফিস যায় তখন তো আর মিস হয় না। নাস্তিকের মাথায় সৌখিন আল্পনা এঁকে দিয়ে বড় হুজুরের সারের দোকানের পেছন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই হয়।

এদিকে ঘণ্টা দু’য়েকের মধ্যেই দিন দু’য়েকের জন্য সুশিলেরা মিডিয়ায়, ইন্টারনেটে দামামা বাজাবে। বড় হুজুর ভালোই জানে এসব ক্যামনে সুনিপুন সামাল দিতে হয়। বড় হুজুর জানেন কারণ তিনি খুব ভালো করেই খেয়াল করেন পুলিশের মুরোদ কতটুকু এবং কোন কোন ক্ষেত্রবিশেষ। তিনি জানেন যার অর্ডারে পুলিশ দৌঁড়ায় তিনি কে এবং কী বললে তিনি গুটিয়ে যান। এমন কি প্যাঁচটা ঠিকমত দিতে পারলে তিনি পায়ে পড়ে মাদ্রাসার জন্য জান-মাল ঢেলে দিবেন। হাসিনা সরকার তখন জালেম হলেও বন্ধু, আমরা-আমরাই।

মুসলমানরা সব থেকে কম লেখাপড়া করে। দর্শন, বিজ্ঞান ও যুক্তির নিয়ে পড়াশুনা করতে এরা ভয় পায়, মনে করে নাস্তিক হয়ে যাবে, বা কী দরকার এত পড়াশুনার। ফলে নিজেদের বিশ্বাসের ভিত্তিগুলো সম্পর্কেও এরা তেমন কিছুই জানে না। কুরআন হাদিসের বাক্যগুলো সম্পর্কে, ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে, আধুনিক জীবন যাপনের সাথে এদের অস্তিত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ১০০% মানুষ কোন সদুত্তর দিতে পারে না। তারা গোঁড়া ধার্মিক, মুর্খ এবং পরিবারের একমাত্র শিক্ষিত ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে; জীবনে এর চেয়ে পাওয়ার আর কিছু নাই। আর সময় কখন, ছেলেটাকে ঢাকায় ম্যাচে রেখে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ যোগাতে হয়। আর আজকাল সবকিছুর যা দাম!

কিন্তু হাতে গোনা ‘কয়েকজন হুজুর’ ঠিক-ই জানে এই প্রশ্ন কেন জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। সময় নষ্ট না করে এরা শুরুতেই খুঁজতে শুরু করে কীভাবে অপর পক্ষকে কুপোকাত করা যায়। এবং যেহেতু জ্ঞান বাস্তবতা দিয়ে এই আলোচনায় অংশগ্রহন করা শয়তানের কাজ তাই মুসতাকিমের পথে আহ্বান শুরু করে। পাড়ার দোকানে, ফেসবুকে বা ব্লগের কমেন্টেও ব্যাপারটা একেবারেই একই রকম। এই কয়েকজন হুজুরের ব্যক্তিগত জীবন ইসলামবিরুদ্ধ কাজে ভরপুর থাকলেও ১০০%এর এই সমাজে এরা যে কোন প্রশ্নের ঊর্ধে। ফলে প্রশ্নকারীর প্রতি ওয়াজিব কাজটি করার জন্য নিজে সরাসরি চাপাতি তুলবার দরকার হয় না। এদের চারপাশে এমন অনেক সাহাবী থাকে যারা তথ্য প্রমানের ধার না ধেরেই ‘বড় হুজুর নাস্তিক বলেছেন’ এটুকুই যথেষ্ঠ ধরে চাপাতি জিহাদে ঝাঁপ দেন। ১০০% এর এই সমাজটা এইসব হুজুর এবং তাদের তালেবুল এলেমদের সম্পূর্ণ অনুকূলে।

পুরো জীবনকে যে ধর্ম অস্বীকার করে, যে মানুষ তাকে ধারণ করে, সেই ধর্ম ও তার অনুসারীকে খালি হাতে মনুষত্ব, জ্ঞান, যুক্তি এসব দিয়ে বিশ্লেষণ করতে যাওয়া মৃত্যুর সামিল। যাদের কাছে যুদ্ধের দাওয়াত, যুদ্ধ এবং যুদ্ধে মৃত্যু-ই কেবলমাত্র লক্ষ্য, তাঁদের কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জীবনের আহ্বান শুধু লিখে পৌঁছানো যাবে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই আদর্শের বাস্তবায়ন করতে হলে এর পেছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে। তারপর সামাজিক শক্তি অর্জনের চেষ্টা করতে হবে, তার পর যদি কোনদিন একটুও পাল্টায়।

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৫ দুপুর ২:০১
২০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×