
আমাদের মুসলিম উম্মাহ’র ভিতর যে কয়টি দল আছে তার ভেতর আহলে সুন্নাহ ও আহলে বাঈত সহ আরও কয়েকটি উপদল আছে যারা ‘আহলে’ শব্দটি দিয়ে শুদ্ধ ইসলামের সাথে তাঁদের সংযুক্তি প্রমান করতে চান। ইসলামের শুদ্ধ অশুদ্ধের বিতর্ক এর জন্মের সমসাময়িক। কুরআনে সুরা বাকার’র দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাক্যে এর উপযোগীতা ব্যাখ্য করা হয়েছে: ‘এ সেই বই, যাতে কোন সন্দেহ নেই, বিশ্বাসীদের জন্য এ পথনির্দেশ। যাঁরা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, সালাত আদায় করে এবং তাঁদের যে জীবনোপকরণ দান করা হয়েছে, তা থেকে ব্যায় করে’। ফলে এই বই বিশ্বাসীদের জন্য। আর যাঁরা বিশ্বাস করতে চায় না তাদের প্রাপ্য ষষ্ঠ ও সপ্তম বাক্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
কিন্তু অবিশ্বাস থেমে থাকেনি। ইতিহাসের সত্য হলো: রাসুল আল্লাহ (সাঃ) এর জীবনের শেষ দিনগুলিতে হয়ত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকেই মুসলিমদের চরম নেতৃস্থানীয়দের ভেতরেই ফাটলের শুরু (ড. মু. মুহসীন খানের ইংরেজী অনুদিত সহীহ বুখারী, প্রথম খণ্ড, হাদীস নং ১১৪)। তাঁর পর রাসুল আল্লাহ(সাঃ) এর মৃত্যুর পরপরই খলিফায় রাশেদীনদের আমলে খুনোখুনি চরমে উঠেছিল। ফলে আবু বকর (রাঃ) ছাড়া আর সবাইকে আভ্যন্তরীন কোন্দলের কারণে খুন হতে হয়েছিল। রাসুল আল্লাহ (সাঃ) এর মৃত্যুর ছয় মাসের মাথায় ‘মুর্তাদ’দের সাথে ইয়ামাম’র যুদ্ধে অনেক কুরআন মুখস্তকারীর মৃত্যু হলে উমর (রাঃ) এর অনুরোধে আবু বকর প্রথম এক জায়গায় কুরআন সংকলন করতে উদ্যোগ নেন।
আট বছর বয়স থেকে রাসুলাল্লাহ’র সাথে থেকে কুরআনের প্রথম সংকলন করেছিলেন হযরত আলী (রাঃ)। সেটা নিয়ে আসার পর ওমর (রাঃ) ও আবু বকর(রাঃ) সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। শিয়া মুসলিমদের সাথে সুন্নীদের এখানেই দ্বন্দ্বের শুরু। খলিফা রাশেদিনদের সবাই তখন বেঁচে আছেন। তাঁদের নির্দেশে যাইদ ইবনে থাবিত(রঃ) এবং উবাই ইবনে কা’ব (রঃ) এর তত্ত্বাবধানে কুরআনের নতুন আরেকটি সংকলন হয়। পরে আবু বকর (রাঃ) হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়লে কুরআনের সেই একমাত্র সংকলনটি উমর(রাঃ) এর মেয়ে এবং রাসুল্লাহ’র বিধবা স্ত্রী হাফসা (রাঃ) এর কাছে রেখে যান। আবু বকরের শাসনামলে সংকলিত কুরআনের এই ভার্সনটিতে কিছু বাক্য বাদ ছিল, বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রনও ছিল(বুখারী খন্ড ৬: ৬১: ৫১০)।
তার পর যখন ওসমান (রাঃ) ক্ষমতায় আসেন তখন কুরায়েশদের উচ্চরিত আঞ্চলিকতাকেই করআনের আদর্শ ভাষা ধরে নিয়ে যাইদ ইবনে থাবিত(রঃ) এর তত্ত্বাবধানে রাসুল্লাহ’র এক সময়ের চাকর আবদুল্লাহ ইবন মাসুদ(রঃ) এবং আইন বিষয়ক সেক্রেটারি উবাই ইবনে কাব(রঃ) সহ আরও কুরাইশদের নিয়ে আবার সংকলন করতে বলেন। উসমার (রাঃ) সংকলিত কুরআনের ভার্সনটি তৈরি হবার পর, সবাইকে বাধ্য করে বাকি সব খণ্ডাংশ, যার কাছে যা জমা ছিল সব পুড়িয়ে ফেলা হয়। পশ্চিমা কুরআনের গবেষকদের মতে এবারই প্রথম কুরআন হয় ১১৪ টি সুরা বিশিষ্ট। তাঁদের গবেষণা মতে আবু বকর(রাঃ) এর সংকলিত কুরআনে আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদের কাছে যে ভার্সনটি ছিলো সেটির মুল্যায়ন করা হয়নি। সেখানে সুরা ফাতিহা, সুরা ফালাক, সুরা নাস সহ আরও কিছু সুরা ছিলো না বলে কুফা অঞ্চলে আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদের অনুসারীরা মনে করেন বলে প্রমান আছে। এমনকি উবাই ইবনে কা’ব এর কাছে কুরআনের যে ভার্সন ছিলো সেখান থেকে দুটি সুরা বাদ দেয়া হয়েছে(লিয়ামান অলিভার, ২০০৬, ক্যানন, দ্যা কুরআন: এন এনসাইক্লোপেডিয়া, পৃ ১৩৬-১৩৯)।
রাশেদীনদের যুগে আরবী ভাষার লিখিত রূপ আজকের ভাষা থেকে কিছুটা আলাদা ছিল। তখন আরবী ভাষার স্বরবর্ণ আজকের রূপ পায়নি। তাছাড়া আরবী ভাষার বিশেষ্য, বিশেষণ ও ক্রিয়া পদের ব্যাবহার সুষ্ঠুভাবে শুরু হতে সময় লেগেছে দশম শতাব্দী অবধি। সর্বশেষ মিশরের সরকার ১৯২০ সালের দিকে কুরআনের আধুনিক প্রিন্ট সংস্করণটি বাজারে নিয়ে আসে। এসময়ও কুরআনের বিভিন্ন ম্যনুক্সৃপ্টের ভিতর কিছু পার্থক্য দেখা দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৩৯ সালে হাফসার (রাঃ) এর কাছে সংরক্ষিত কুরআনটির কাছাকাছি একটা ভার্সনকে স্থায়ী ধরে নিয়ে মুসলিমদের প্রধান গ্রুপগুলো একটা ডিফ্যাক্টো চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। সে সময়ও কুরআনের নির্ধারিত ভার্সনের সাথে দ্বান্দ্বিক ভার্সনগুলোকে নীল নদের গহীনে ফেলে দেয়া হয়(ও প্রেটজি, ডের কোরান, ১৯৭৫, পৃ ৪১১-৪১২।
হাদিস সংকলনের পথটি আরও সঙ্কটময়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর যে সব সহচরেরা কুরআনকে লিখে রাখতেন তাঁরা হাদিসও টুকে রাখতেন। মাঝে মধ্যে তাঁদের লেখাতে একটু-আধটু ওলটপালট হয়ে যেত(কুরআন সংকলনকারী উবাই ইবনে কা’ব বর্ণিত হাদিসটি দেখুন: বুখারী: খণ্ড ৮: পরিচ্ছেদ ৭৬, হাদিস ৪৪৬)। উমর (রাঃ) এর সময় থেকেই হাদীস সংগ্রহ শুরু হয়েছিল, যদিও সেটার মুটামুটি একটা পরিনত রূপ পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল দু’শ বছরের মত। পার্শবর্তী দেশ থেকে নব্য মুসলীমরা মক্কায় এসে রাসুলাল্লাহ (সাঃ) এর জীবন সম্পর্কে জানতে খুব ঔতসুক ছিল। তাছাড়া তখনও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের দলনেতাদের ভার্সনগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেনি। কিন্তু মুখে মুখে শুনে, মনে রেখে অবিকৃত অবস্থায় হাজার হাজার জীবনাচরণ প্রচার করা মানুষের সাধ্যাতীত। ফলে সূত্র ও শুদ্ধতা নিয়ে তর্কবিতর্ক হানাহানি লেগেই থাকত। রাসুল্লাহ’র মৃত্যুর দু’শ বছর পর মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুলগুলোর কয়েকজন প্রধান বৈজ্ঞানিক উপায়ে হাদীস সংকলনের উদ্যোগ নেন। যাঁরা পরে ঈমাম নামে পরিচিত হন এবং নিজেদের ফলোয়ার(মাজহাব) দাঁড়িয়ে যায়। কে কত বেশী বিশুদ্ধ হাদীসের সংকলন করেছেন তাঁর গ্রহনযোগ্যতা তত বেশি। যেমন: কুরআনের পরেই ঈমাম বুখারী (রাঃ) এর হাদীসের সংকলনকে গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। যে হাদীস বুখারি ও ঈমাম কুরাইশী’র মুসলিম উভয় সংকলনে বিদ্যমান তাদের গুরুত্ব আরও বেশি (মুত্তাফাক্কুন আলাই)। রাবী বা বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত চরিত্র, স্মরণ রাখার ক্ষমতা, রাসুল (সাঃ) এর সাথে তাঁর সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে হাদীসের খাঁটিত্ব নির্ধারণ করা হতো। তার পরেও সেগুলোর উতসের ভিন্নতা যাচাই করে শুদ্ধতার সীল দেয়া হতো। হাদীস সংকলনের শুদ্ধতার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন মাজহাব সৃষ্টি হয়।
কিন্তু কুরআন এবং হাদীসের সংকলনে এত সতর্কতার পরেও কোন কোন হাদীসের ভিতর দ্বন্দ্ব রয়েই গেছে। এমন কী কুরআনের কোন এক সূরার সাথে অন্য সূরার দ্বন্দ্বও রয়েছে(শেষ বিচারের দিনে প্রশ্ন করা না করা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে সুরা আল আরাফ এর ৬ এবং সুরা আর রাহমান এর ৩৯ নম্বর আয়াতে)। তাছাড়া দ্বন্দ্ব আছে পৃথিবী এবং বেহেস্ত সৃষ্টির ঘটনাবলী, ইহুদী-খৃষ্চানদের সাথে মুসলিমদের সম্পর্ক ছাড়াও আরও অন্যান্য কিছু বিষয় নিয়ে। এক্ষত্রে কুরআন ও হাদিসের সংকলনের সময় দুঃস্প্রাপ্তি, ক্ষমতা, নিজেদের স্বার্থ, পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার প্রভাবিত করে থাকতে পারে। ফলাফল: মতবিরোধ, মুসলিমদের ভেতরেই কোন্দল [একজন আইসিস সদস্য শিয়া মসজীদে নামাজের সময় বোমা ফাটানোর পেছনে কী ঈমানী শক্তি কাজ করে, তার ব্যাখ্যা হয়তো এইসবের ভেতর লুকিয়ে থাকতে পারে]। তাছাড়া জীবন চলার পথে কুরআন হাদীসের পাশাপাশি প্রয়োজনে জ্ঞানী ব্যক্তিদের সিদ্ধান্ত(এজমা এবং কিয়াস) সাহায্য নেয়াও গ্রহনযোগ্য। কিন্তু এই প্রক্রিয়া চলাকালে মুফতিদের জ্ঞান, পারিপার্শিক পরিস্থিতির প্রভাবে মতপার্থক্য তৈরি হতেই পারে, হয়েও থাকে।
কুরআন ও রাসুল (সাঃ) এর জীবন তথা হাদিস সংকলনের এই প্রকৃয়া এবং সংশ্লিষ্ঠ ইতিহাসকে অস্বীকার করা অসম্ভব। কিন্তু এত কিছুর পরেও বিশুদ্ধ ইসলামের খোঁজ পাওয়া এই ১৪০০ বছর পরে অবশ্যই কঠিন একটা কাজ। আবদুল্লাহ ইবনে আমর(রাঃ) বর্ণিত তিরমিজি শরিফের ২৬৪৩ নং হাদিসে রাসুল (সাঃ) বলেছেন: “ইহুদীরা ৭১ দলে বিভক্ত, তাঁদের মধ্যে এক দল মাত্র বেহেস্তে যাবে (যাঁরা মুসা (আঃ) কে অনুসরণ করে) আর বাকী ৭০ দল দোজখে যাবে। কৃষ্চানরা ৭২ দলে বিভক্ত, তাঁদের ৭১ দল যাবে দোযখে, বাকী এক দল যাবে বেহেস্তে (যাঁর ইসা (আঃ) কে অনুসরণ করেছে), এবং শুধু মাত্র যাদের হাত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর আত্মার সাথে যুক্ত। আমার এই অনুসারীগন ৭৩ ভাগে ভাগ হয়ে যাবে, তাঁদের মাত্র একটা দল বেহেস্তে যাবে, বাকী ৭২ টি দল যাবে দোযখে। মুহাম্মদ (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হলো: হে আল্লাহ’র রাসুল, কারা তারা? তিনি বল্লেন ‘আল-জামা’হ’। অর্থাত যারা নিঃশর্তভাবে রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর প্রত্যক্ষ সহচরদের দেখানো পথে চলবে”। এই হাদীসে রাসুল আল্লাহ (সাঃ) স্পষ্ট বলছেন ইহুদী এবং কৃষ্চানও বেহেস্তে যেতে পারে, যাঁরা তাঁদের ধর্মপ্রবর্তকের দেখানো পথে চলবে।
আল-জামা’হ সম্পর্কে রাসুল আল্লাহ (সাঃ) শুদ্ধ হাদীসের সংকলন বুখারীর ৭১তম খণ্ডের ৩৬৪১ নম্বর (বা আরেক শুদ্ধ হাদীসের সংকলন মুসলীমের ১৯২০ নং) হাদীসে বলেছেন: আমার অনুসরণকারীদের একটি দল নিঃশর্তভাবে সত্যকে ধারণ করবে, তারা বিজয়ী, তারা বিরোধীতাকারীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হবে না, এবং তারা মৃত্যু বা শেষ বিচারের দিন অবধি তাদের সমর্থন করবে না। কিন্তু এই সত্যে কী ভাবে পৌঁছানো সম্ভব? না পৌঁছাতে পারলে ধারণ করাই বা কী ভাবে সম্ভব? আবার কারাই বা এই নিঃশর্ত সত্য ধারনের বিরোধীতাকারী?
ইসলাম প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক অনেক সত্য আছে যা প্রচলিত অনুভুতিকে আঘাত করে। ধর্মভীরু, মুর্খ এবং ধর্মব্যবসায়ী মুসলিম এই ঐতিহাসিক সত্য মেনে নিতে অপারগ। তারা প্রকৃত সত্য খুঁজতে বইপত্র ঘাঁটা তো দূরের কথা, ঐতিহাসিক সত্যটি শুনলেই তাদের ঈমানের স্ফুরণ শুরু হয়, মাথায় খুন জেগে ওঠে। কিন্তু ঐতিহাসিক এই সত্য এড়িয়ে স্থায়ী পার পাবার কোন উপায় নেই – এ কথা তারা বুঝে না। বরং এই সত্যকে ধারণ করলে ইসলামের কি কোন ক্ষতি হয়? আধুনিকতম ধর্ম হিসাবে পূর্ববর্তী স্থানীয় ধর্মগুলোর আচার উপাদানকে গ্রহণ করলে ক্ষতি কী? রাসুল সাঃ নিজে তা করেছেন। যেমন:
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা ফরজ। ইসলামপূর্ব কালে কোন কোন পৌত্তলিকরা কাবার দিকে মুখ করে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত প্রার্থনা করতো (এলিয়াডে কর্তৃক সংকলিত দি এনসাইক্লোপেডিয়া অব ইসলাম, পৃষ্ঠা ৩০৩)। প্রার্থনার আগে তারা পানি দিয়ে নিজেদের পরিষ্কার করে নিত।
মদিনায় হিজরতের এক বছর চার মাস আগ পর্যন্ত মসজিদুল আকসার দিকে মুখ করে সালাত আদায়ের নিয়ম থাকলেও পরে তা কাবার দিকে পরিবর্তন করা হয় (বুখারী খণ্ড ৬ পরিচ্ছেদ ৬০ হাদীস নম্বর ১৩)। যে মসজীদুল আকসা ইজরাইলে অবস্থিত এবং ইহুদী, কৃষ্চান ও মুসলিম সবার পবিত্র স্থান।
১০ই মুহাররমের দিনে রোজা রাখার রেওয়াজ ইসলামপূর্ব কুরাইশ গোত্রের লোকজনের ভিতর প্রচলিত ছিল। পরে রমজানের পুরো মাস রোজার প্রচলন শুরু হলে এটার গুরুত্ব কমে যায়। আয়শা রাঃ বর্ণিত (বুখারীর খণ্ড ৫, পরিচ্ছেদ ৫৮ হাদীস নম্বর ১৭২) হাদিসে: জাহেলিয়ার যুগে মুহাররামের আশুরায় কুরায়েশরা রোজা পালন করত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)ও ঐ দিন রোজা রাখতেন। মদিনায় হিজরতের পরেও তিনি ঐ দিন নিজে রোজা রাখতেন এবং অন্যদের রাখার নির্দেশ দিতেন। তারপর যখন রমজান মাসে রোজা রাখা শুরু হলো তখন ঐ দিন রোজা রাখাটা ঐচ্ছিক হয়ে দাঁড়ালো।
হজ্জের প্রায় সবকিছুই ইসলামপূর্ব সময়ে প্রচলিত ছিল। হজ্জের যে কয়’টি ফরজ ও ওয়াজিব আছে তাঁর প্রায় সব কয়টি’ই পৌত্তলিকদের সময়ে পালন করা হত। কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ করা ইসলামে ফরজ। পৌত্তলিকরাও কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ করতো। রাসুল্লাহ একদিন মক্কায় গেলেন এবং কাবার ভেতরে ঢুকলেন। তখন সেখানে ৩৬০টি মুর্তি ছিলো। রাসুলালাহ সাঃ সব মুর্তিগুলোকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলেন এবং বলেন: সত্য এসেছে, মিথ্য দূরীভূত হয়েছে(বুখারী খণ্ড ৩: পরিচ্ছেদ ৪৩: হাদিস ৬৫৮)। তিনি কিন্তু হাজরে আসওয়াদ(কালো পাথর) কে ইব্রাহীম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ) তৈরি করেছিলেন বলে রেখে দিলেন [এই কী সেই পাথর যা কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে মক্কার বিভিন্ন গোত্রের ভিতর ঝগড়া বেঁধেছিল এবং রাসুলুল্লাহ ছোটবেলায় বিবাদমান গোত্রের নেতাদের নিয়ে একটা সমাধান বের করেছিলেন?]। যদিও কাবার অস্তিত্ব রাসুল্লাহ’র কয়েক দশক আগেই শুরু হয়েছিল। কাবা তৈরি হওয়ার সময় নিয়ে কুরানে বর্ণিত বাণী’র (বাকারা’র আয়াত ১২৫ সাথে বুখারির ৪:৫৫:৬৩৬ হাদিসে স্পষ্ট গরমিল রয়েছে। যদি রাসুলাল্লাহ ঠিক হন তবে কুরআন ভুল(নাওযুবিল্লাহ), আর কুরআন ঠিক হলে বুখারি শরিফের হাদীসটি ভুল(নাওযুবিল্লাহ)। কাবার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর দৃষ্টিভঙ্গি আরও বিস্তারিত জানতে বুখারির সংকলিত আয়েশা রাঃ বর্ণিত ১:৩:১২৮ নম্বর হাদীসে চোখ বুলাতে পারেন। কালো চতুষ্কোণ পাথরে চুম্বনের প্রথা ইসলামপূর্ব সময়েও প্রচলিত ছিল(সুরা নাজ্ম ৫৩:১৯)।
সাফওয়া মারওয়া দুই পাহাড়ের দৌঁড়ানো(সাঈ করা ইসলামে ওয়াজিব)র প্রথাও ইসলামপূর্ব যুগে প্রচলিত ছিল। বুখারি সংকলিত ২:২৬:৭১০ হাদিসে আসিম(রঃ) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, আমি একবার আনাস বিন মালিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কি সাফাওয়া মারওয়ায় তাওয়াফ করতে অপছন্দ করতে? উত্তরে সে বলেছিল, হ্যাঁ, কারণ সাফাওয়া মারওয়া আল্লাহ’র প্রতীক: আল্লাহ’র এমন নির্দেশের আগে পর্যন্ত এটা আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগের প্রথা ছিল। এ কারনে এখন যারা কাবায় হজ্জ পালন করার সময় তাওয়াফ করে তাঁদের জন্য কোন পাপ নয়।
ইহরাম বাঁধা হজ্জের একটি ফরজ কাজ। ইসলামপূর্ব কালে আল-মুসাল্লালায় পৌত্তুলিকরা মান্নাত নামের এক দেবীর কাছে প্রার্থনার সময় ইহরামের মতো সেলাইবিহীন কাপড় পরতো। এ নিয়ে আয়েশা রাঃ এর সাথে সাহাবীদের বিস্তারিত স্পষ্ট কথপোকথন জানতে উরুয়া বর্ণিত বুখারির সংকলিত ২:২৬:৭০৬ নম্বর হাদীসটি দেখুন।
ইসলামিক লেখক ইবনে হাইসামের লেখা রাহমাতুল্লিল আলামিন এর প্রথম খণ্ড ১৫১-১৫৫ এবং দ্বিতীয় খণ্ড ৮৯-৯০ পৃষ্ঠায় ইসলামপূর্ব কালে কাবায় যে ৩৬০ দেব দেবীর প্রার্থনা করা হতো তাদের ভেতর একজন ছিল হুবাল। তাঁর প্রতীক ছিল কাস্তে আকৃতির নতুন চাঁদ। হুবালকে খুশি রাখার জন্য কাবায় মানুষ জবাই করতে হতো। রাসুল সাঃ এর দাদাজান তো একবার তাঁর আব্বাজানকে কুবালের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জবাই করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। ইসলাম প্রতিষ্ঠার শুরুর সময় বদর যুদ্ধের আগ মুহুর্তে আবু সুফিয়ান যখন গলা ফাটিয়ে বলছিল: হে হুবাল তুমিই শ্রেষ্ঠ, তখন রাসুলুল্লাহঃ তাঁর সাহাবীদের নিয়ে আরও উচ্চস্বরে বলেছিলেন: আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম। আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম ঠিকই কিন্তু ‘আল হেলাল: নতুন চাঁদ’ ইসলামের অনেক কিছুকেই প্রভাবিত করেছে। হিজরী ক্যালেন্ডার থেকে শুরু করে সারা বিশ্বে ইসলামের প্রতীক হয়ে আছে সেই কাস্তে আকৃতির চাঁদ। তাই বলে তো হুবালকে উদ্দেশ্য করে মুসলিমরা নামাজ আদায় করে না।
আইয়ামে জাহেলিয়া বা আল্লাহ’র নির্দেশ উপেক্ষার কালে সত্যকে অস্বীকার করা হতো। তাই বলে এখনো? ১৬০ কোটি মানুষ আজ মুসলিম। তাঁর ভিতর সবাই কী এই সব ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করে পার পেয়ে যাবে? এড়িয়ে, পালিয়ে, মাথায় রক্ত চড়িয়ে, সব গুঁড়িয়ে দিয়ে, খুন করে সমগ্র পৃথিবীতে খেলাফাত কায়েম করবে? সমীকরণ পাল্টেছে, ক্ষমতার রসায়নও বদলেছে। সত্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, উপেক্ষার যুগও শেষ হয়েছে। এখন যদি আপনি নিজেকে মুসলিম বলে নিজেকে দাবি করতে চান, ইতিহাসের এইসব সত্যকে মেনে নিন, তাতে আপনার আমার মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোন পাপ দেবেন বলে মনে হয় না। বরং খুশি হয়ে তাঁর বান্দার সত্য ও সুন্দর আলিঙ্গন করার ঈমানী তাগুথের জন্য পুরষ্কৃত করবেন, ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই জ্ঞানের মাধ্যমে আমাদের কল্বকে আলোকিত করুন, আমিন।
গোলাম রব্বানী
গ্রামের নাম এডিংটন, ০৬ই জুলাই ২০১৫

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:৩৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




