জেলহত্যা দিবসে (৩/১১/১৫) ঢাকা সহ কয়েকটি জেলায় অর্ধদিবস হরতালের সমর্থনে গণজাগরণের শান্তিপূর্ণ মিছিল হয়ে গেল। হরতালটি জেলহত্যা দিবসে হলেও এর কারণ ছিলো: ৩১শে অক্টোবর দুপুরে জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে খুনিরা চলে যায়। তার ঘন্টাখানিক আগেই শুদ্ধস্বর প্রকাশনির মালিক আহমেদ রশীদ টুটুল ও তাঁর সাথে আরও দুজন লেখক তারেক রহিম ও রণদীপম বসুকে কুপিয়ে মৃত ভেবে দরজায় তালা লাগিয়ে চলে যাবার ঘন্টা দুয়েক পরে হাসপাতালে নেয়া হয়। এদের দুই প্রকাশকের অপরাধ এরা অভীজিত রায়ের বইগুলো প্রকাশ করতো। সরকারসহ সবাই জানে এটি তালেবান বা আইসেসের অনুসারী উগ্রপন্থীদের কাজ। মানুষ এটাও জানে এই খুনিদের কোনদিন সরকারের পুলিশ, গোয়েন্দা, সেনাবাহিনী কেউ ধরতে পারবে না। বিচার তো দূরের কথা। তাই দীপনের বাবা কোন বিচার চান না। বরং বলেন শুভবুদ্ধির উদয় হোক। গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে দুই একজন সাধারণ মানুষ ও দুই একটি বামপন্থী মানুষ অতি ক্ষুদ্র পরিসরে ৩রা নভেম্বর অর্ধদিবস হরতালের আহ্বান করে। কোথাও কোন আগুন, জ্বালাও পোড়াও বা কোন রকম ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ছাড়াই, এই হরতাল পালিত হলো। যেসব জেলা শহরে মিছিল সংগঠিত হয়েছে সেসব মিছিলের আকার ছিল ১০ থেকে ২৫ জন। ঢাকার মিছিলগুলোর আকারও তেমনি এবং পুলিশি প্রহরায় তা সম্পন্ন হয়েছে। সকাল থেকে যান চলাচলে কোন বিঘ্ন ছিলো এমন খবর প্রকাশিত হয়নি।
এমতাবস্থায় চলতে থাকলে আজ থেকে আট বছর পর আনিস সাহেবের এক শারদীয় বিকেল হবে এরকম:
আনিস সাহেব কলেজ ছুটি হলে বিকেলে বাজারে যান। মাগরিবের নামাজটা ওখানেই আদায় করে বাজার সেরে, কলিমের দোকানে পত্রিকা পড়ে চা খেয়ে তবে বাসায় আসেন। পাশেই ব্যাংকের উপর তেতলায় বৌটা ঘরে পাঁচ বছরের মেয়ে নাজিয়াকে নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকেন। আজ বের হবার সময় নাজিয়া বাবার কোলে উঠে বাজার থেকে ক্যাটবেরি মিল্ক চকলেট আনতে বায়না ধরলো। আনিস সাহেব হেসে হ্যাঁ আনবেন বলে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন। আজ দুপুরে মা ওর জন্য একটা গোলাপি ওড়না আনতে বলেছে বাজার থেকে।
আনিস সাহেব ওড়না কিনতে মতিচুর ট্রেডার্সের ভিতর ঢুকতেই মালিক আশরাফ তাঁকে সালাম জানিয়ে বসতে বললেন। পাশেই কলিমের চায়ের দোকান। আশরাফ চেঁচিয়ে স্যারের জন্য চা দিতে বলে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। পাশেই পড়েছিল পত্রিকা ‘আত তামকীন’। আজ ২০২৩ সালের ৩রা নভেম্বর। প্রথম পাতায় হেডলাইন: কুফরি শিক্ষাদানকারি সব প্রতিষ্ঠান ঈদের পর থেকে বন্ধ ঘোষণা করেছেন বায়তুল মুকারর্মের ঈমাম আবদুর রহিম বাগদাদী। আনিস সাহেব পত্রিকার পাতা থেকে চোখ তুলে আশরাফকে গোলাপি ওড়নার কথা জানালেন। নাজিয়ার দ্রুত বড় হয়ে ওঠা ও দুষ্টুমি নিয়ে আলাপ হচ্ছিল ওদের। এরই মধ্যে কলিম চা নিয়ে এসে পাশে রেখে স্যারকে সালাম দিলো। আশরাফ তিনটে ফুটফুটে গোলাপি ওড়না স্যারের দিকে পাটাতনে মেলে দিলেন। হঠাত বাইরে একটা গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকালেন সবাই। দেখলেন এই বাজারেরই কাপড়ের দোকানদার এরশাদ, রফিক; মাছের আড়তদার ইমরুলসহ আরও গোটা দশেক লোকজনকে দড়ি বেঁধে সারি দিয়ে মসজিদের পাশে খোলা জায়গাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আনিস সাহেব উঠতে যেয়েও আবার বসে ওড়না দেখায় মনোযোগ দিলেন। হাজার হলেও মেয়েটা আগামী বছর প্রথম স্কুলে যাবার আগে ওড়নাটা পরা শেখাতে হবে।
: চা খেতে খেতে ওড়ানাটা কিনে দাম মিটিয়ে দিলেন আনিস সাহেব। তারপর উঠতে যাবেন এমন সময় আশরাফ তাকে এই আরেকটু বসার জন্য অনুরোধ করলেন।
: বন্দিরা এই বাজারের সবার পরিচিত। আনিস সাহেব বসার টুলটা সরিয়ে দেয়ালের কাছে নিয়ে হেলান দিয়ে বসলেন। এখান থেকে সবাইকে পুরোপুরি দেখা যায়।
: বাজারের মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেব সাইফুল্লাহ’র সাথে আরও চার-পাঁচজন রফিকদেরকে ঘিরে রেখেছে। সবার কাঁধে একে ৪৭ রাইফেল এবং কোমরে চাপাতি। ওদেরই একজন হাবিবুল্লাহ। পাশের মাদ্রাসার নাইট গার্ড। ওর রাইফেলটা সাইফুল্লাহ’র কাছে দিয়ে কোমর থেকে চাপাতিটা বের করলো। বাম হাতে চাপাতিটা মুছে নখের উপর ছুঁইয়ে ধার পরীক্ষা করে আবার কোমরে গুঁজে রাখলো। তারপর সাইফুল্লা’র সাথে কী যেন আলাপ করতে থাকলো।
: এদিকে আমজাদ কশাইয়ের দোকান থেকে মাংসকাটা কাঠটা তুলে নিয়ে ওদিকেই আসছে আরও দু'জন মুজাহিদ। তাঁদের একজন আবার আটক বন্দী ইমরুলে আপন ভাই।
: আনিস সাহেব এক গ্লাস পানি চাইলেন। সন্ধ্যে বেলাতেই কেমন যেন একটু শীত শীত লাগছে তাঁর।
: হাবিবুল্লাহ আটক এরশাদকে এক পা সামনে এগিয়ে দাঁড়াতে বলল। রফিক, ইমরুল সহ অন্যান্যরা নির্বিকার দাঁড়িয়ে এরশাদের এগিয়ে দাঁড়ানো দেখছে।
: মুয়াজ্জিন সাইফুল্লাহ এরশাদের দিকে এগিয়ে এসে শরিয়া আইন মোতাবেক তাঁর অপরাধের জন্য রায় উচ্চারণ করছে। আরবী, উর্দু বাংলা মিশিয়ে এমন এক ভাষায় সে কথা বলছে, আনিস সাহেব সব কথা ঠিক ধরে উঠতে পারছেন না। তবে ৩রা নভেম্বর ২০১৫, গণজাগরণমঞ্চের মিছিল, খেলাফায়ে ইসলাম শব্দগুলো বুঝতে পারলেন।
: সাইফুল্লাহ’র কথা শেষ হতেই হাবিবুল্লাহ এরশাদকে কাঠের সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বলল। তারপর এরশাদের মাথাটা মাংস কোপানোর কাঠের উপর ভালো করে বসিয়ে ঘাড় উচু করিয়ে দিলো। তারপর এক পা পিছিয়ে এসে চাপাতিটা বের করে দুই হাতে শক্ত করে ধরে দাঁড়ালো।
: সাইফুল্লাহ তখন মুজাহিদদের তাকবীর বলার জন্য ইশারা করলেন। হাবিবুল্লাহ ডান পা এগিয়ে দিয়ে নিচু হয়ে এরশাদের ঘাড়ে হাত দিয়ে টান টান করে নিলো। আর পেছন থেকে সাইফুল্লাহ চেঁচিয়ে বললেন তাকবীর! সবাই বললেন: আল্লাহ অকবার। এর ভেতরেই হাবিবুল্লাহ এক কোপে ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেললো। এরশাদের গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত চারদিক ভিজিয়ে দিচ্ছে। মাথাটা গড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘুরছে আর আলাজিহ্বাটা সাদা শক্ত একবার বের হয়ে আছে, আবার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।
: দু’জন মুজাহিদ এগিয়ে এসে মাংস কাটার কাঠটা সরিয়ে হাত চারেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। এর ভেতর শ'খানেক মানুষ ঘিরে ফেলেছে জায়গাটা। এখন বাকি নয় জনের পালা।
আনিস সাহেব জানে পুলিশ আসবে রাতে। মাথাগুলো বস্তায় ভরে লাশগুলো ভটভটিতে তুলে নিয়ে পুতে আসবে বিলের ধারে পুরোনো শশানের দক্ষিণ পাশের কুয়োটায়। কাফেরদের লাশ যে ছোঁবে সেও তো কাফের হয়ে যাবে। আনিস সাহেব ভাবে তাহলে পুলিশরা কেন কাফের হয় না?
গোলাম রব্বানী
৩রা নভেম্বর ২০১৫
গ্রামের নাম সেলসডন।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২১