দেয়ালে কান পেতে আমি শুনার চেষ্টা করছি। কেমন জানি একটা শব্দ আসছে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
এই মাত্র আমি একটা ভয়াবহ কাজ করে ফেলেছি। গল্প শুরুর আগের গল্পটা একটু বলে নেই। আমি নিতান্ত সাধরণ একটা ছেলে। বলতে পারেন আর সব মধ্যবিত্ত ছেলের মতই। দশটা পাঁচটা ইচ্ছা থাকলেও আমার জীবনটা ছকে বাঁধা দাবার গুটির মতই। কেউ অদৃশ্য হাতে যেন উপর থেকে কলকাঠি নাড়ছে আর আমি পুতুল খেলার পুতুলের মত অভিনয় করে চলেছি।
মাথার উপর একমাত্র ছায়া বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার মধ্যে একটা ভয় ঢুকে যায়। মৃত্যু ভয় বলা যায়। হাঁটতে গেলে মনে হয় পিছন থেকে এসে কেউ একজন চেপে ধরবে গলায় কিংবা ছুড়ি মেরে দৌড়ে পালাবে।
ভয়টা বাড়তে থাকে আমার। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে মাথার তীব্র ব্যাথাটা। মা'র কাছে শুনতাম তখনকার অবস্থাটা। আমাকে যেন মানুষ মনে হত না। মনে হত কোন অশুভ আত্মা আমার উপর ভর করেছে। ডায়াজিপাম ট্যাবলেট গুলো ছিলো আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। একসাথে ৪/৫ টা খেয়ে তলিয়ে যেতাম ঘুমের রাজ্যে। পরের দিন সকালে উঠে আমি দিব্যি ভুলে যেতাম গতরাতের কথা।
কলেজে থাকতে একজনকে খুব ভালবাসতাম। ভালবাসতাম কিনা জানি না। তবে মনে হত ওকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ থেকে যাব। বাবার মৃত্যু ভয়টা অনেকটা কেটে উঠেছিল ওর সাথে কাটানো মূহুর্ত গুলোর জন্য। কার্জন হলের ঘাসগুলো ও হয়ত বুঝে গিয়েছিল কতটা ভালবাসি আমি ওকে। উৎসবের দিনগুলো বাদে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চলে যেতাম কার্জন হলে। ও আচ্ছা নাম তো বলা হয় নি। নাম ছিলো প্রিয়তী। প্রিয়তী ছিলো আমার থেকে ২ বছরের বড়। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি কোনদিন ওকে বড় মনে করিনি। ভাবতাম আমার মতই হয়ত। কিন্তু প্রিয়তী আমাকে কিভাবে দেখত আমি জানি না।
সামাজিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ ছিলাম আমরা। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম প্রিয়তী নিজেও আমাকে খুব করে চায়। কিন্তু এই তথাকথিত সমাজ আমাদের মেনে নিবে না বলে কোনদিনও আমাকে বুঝতে দিতে চাইতো না।
কোন এক ছুটির দিনের বিকেলে ও আমাকে কার্জনে ডাকলো। আমি ছুটে গেলাম ওর কাছে। ও আমার হাতে একটা বিয়ের কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললো, "আসিস কিন্তু । শেষবার তোকে দেখতে চাই আমি "
আমি নির্বাক ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না আমার কি করা উচিত এই মূহুর্তে। পৃথিবীর সব লজ্জা ভুলে আমি কি প্রিয়তীকে কাছে টেনে বলবো, "তুমি আর কারো নও। তুমি শুধুই আমার "। এই নিকৃষ্ট সমাজ ব্যবস্থা অসম আমাদের মেনে নিবে না হয়ত। তারপরও প্রিয়তী যদি একবার বলতো আমার সাথে যাবে তবে আমি ওকে নিয়ে সত্যি অনেকদূর চলে যেতাম। এই সমাজ আমাকে কিচ্ছুটি দেয় নি। বরং আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক বেশি।
দিনগুলো কর্পূরের মত উড়ে গেল। তার ঠিক দেড় বছর পর আমিও ভুলে গেলাম আমার কৈশোরসুলভ প্রেমকে। এখন অনেক খানি কন্ট্রোল আছে নিজের আবেগের উপর। একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে বিবিএ করছি আমি।
ডায়েরীটাতে এটুকুই লেখাছিল। পুলিশ ব্যাগ ঘেঁটে আর কিছু পায় নি। রিমান্ড রুমের ১০০ ওয়াট পাওয়ারের লাল লাইট টা ঠিক মাথার উপর ঝুলে আছে। লাঠির খোঁচায় পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাস করলো কেন আমি এই কাজটা করেছি। রক্তমাখা মুখে আমি একটা হাসি দিলাম। আমার এই হাসি কেউ কোনদিন দেখেনি। আমি নিজেও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমার এই নির্লিপ্ততায়। আমি শুরু করলাম বলা -
বিবিএ শেষ সেমিস্টারে আমার আবার দেখা হয় প্রিয়তীর সাথে। নিউমার্কেটের সামনে দিয়ে ভীড় ঠেলে হাঁটার সময় পায়ে পা লেগে যায়। আমিমি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি প্রিয়তী। আমাকে দেখে এতটা চিনতে পারে নি। কৈশোর এ পা দেয়া বালক এখন পুরোদস্তর যুবক।
আমি একটু সময় নিয়েই বললাম ইটস ওকে। প্রিয়তী আমাকে ঠিক ঠিক চিনে ফেললো পরের মূহুর্তেই। আমরা একসাথে সিনেট ভবনের সামনের রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সিনেট ভবনের দিকে যাচ্ছিলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম কাকা-কাকী কেউ বেঁচে নেই। ওর বিয়েটাও টিকে নি। কিছুদিন পরই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ওর হাজব্যন্ড নেশাখোর ছিল। প্রায় প্রতিরাতেই ওকে মারধর করতো। আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পাচ্ছিলাম না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওর চোখ দিয়ে তখন বৃষ্টি ঝরছিল অবিরত।
সেই রাতে আমি আর ঘুমাতে পারে নি। চলে যাওয়ার আগে ওর হোস্টেলের ঠিকানা টা নিয়েছিলাম। ও এখন হোস্টেলে থাকে। আমরা আবার দেখা করতে লাগলাম,কথা বলতে লাগলাম আগের মত।
আস্তে আস্তে প্রাণ ফিরে পাচ্ছিল প্রিয়তী। একদিন সাহস করে হাতটা চেয়ে বসলাম ওর কাছে। ও কিছু বলে নি সেদিন। হাতটাও ধরে নি। হয়ত মনে ভয় ছিলো দ্বিতীয় বার ভুল করার। কিন্তু একসময় তো সেও আমাকে চায়তো। ও বেশিদিন না করে থাকতে পারে নি। একদিন সমস্ত আকাশ কাঁপিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো ও। মুহুর্তেই কিছু সময়ের জন্য থেমে গিয়েছিল আমাদের পৃথিবীটা।
আমরা কাজী অফিসে যেয়ে বিয়ে করলাম। বিয়ের রেজিস্ট্রেশন এর সময় কাজী আমাদের বয়সের পার্থক্য দেখে একবার ভ্র কুচকে তাকালো। সেদিকে আমাদের থোরাই কেয়ার। আমার দুইটা কাছের বন্ধু ছিলো স্বাক্ষী।
আমি একটা ছোটখাট বিজনেস খুলে বসলাম বন্ধুর সাথে পার্টনারশিপে। আমাদের দিন চলে যাচ্ছিল কোন একভাবে। এই মাসে ধার তো, অন্যমাসে শোধ। অভাব ছিলো সাথে ভালবাসাও ছিলো।
গল্পের এ পর্যন্ত শুনে হয়ত মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আমি পুলিশ স্টেশনে বসে কি করছি? আমাকে রিমান্ডেই বা নেয়া হল কেন? কারণ টা বলছি..
আমাদের বিয়ের আট মাসের মাথায় আমাদের ছোটখাট কোম্পানির সাথে একটা বড় আকারের ডিল করে অন্য একটা ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি। আমি আমার মূলধনের সবটা দিয়ে ডিলিং টা নিয়ে নেই। আমার বন্ধু এতে রাজি ছিলো না। তাই ও শর্ত দিয়ে সরে যায় এই ডিলিং থেকে।
ভালই চলছিল সময়টা। একদিকে ঘর, অন্যদিকে কোম্পানি । একদিন জানতে পারলাম আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আমার সাথে ধোঁকাবাজি করেছে। সেই কাহিনীটাও বলছি।
কোম্পানীর ইনভেস্টমেন্টে যে টাকা দেয়া হয়েছিল টোটাল সেটা অন্য একটা একাউন্টে ট্রান্সফার হচ্ছিল রেগুলার। ধরতে পারার পর কেঁচো খুঁজতে যেয়ে কেউটে বের হয়ে আসলো।
জানা গেল যার সাথে আমি আমার কোম্পানির ডিলিং ছিলো সে ছিলো প্রিয়তী র সাবেক হাজবেন্ড। এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। আমাকে ব্ল্যাক মেইলিং করে,আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে পথের নি:স্ব বানালো। এটুকু বলে আমি থামলাম।
পুলিশ আমাকে প্রশ্ন করছে একের পর এক-
- আপনি কেন খুন টা করলেন??
-আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই। ( গোঙানির শব্দে)
-অপরাধ টা কি ছিলো উনার?
-আপনি জানতে চান অপরাধ?? সত্যি জানতে চান?
-হুম, আমি আইনের লোক। সত্যিটা আমি জানতে চায়। আপনি বলুন।
-তাহলে শুনুন..
সেই রাতে আমি বাড়ি ফিরে দেখি আমার বাসায় বসে আছে প্রিয়তী আর তার সাবেক স্বামী। হাসাহাসি করছে ওরা আমাকে নিয়ে। ঠিক এই আপনার মত আমিও ভড়কে গিয়েছিলাম কি হচ্ছে।
প্রিয়তীই আমাকে জানালো তাদের মাস্টার প্ল্যানের কথা। শবছিল তাদের ছক করা। অনেকদিন থেকে আমাকে ফলো করছিল প্রিয়তী। একদিন নিউমার্কেটে মিথ্যামিথ্যি নাটকটা করে। যে কাজী অফিসে আমাদের বিয়েটা হয়েছে সেটাও ভুয়া। প্রতিনিয়ত আমার থেকে ইনফরমেশন জেনে পাচার করছিল তার হাজবেন্ডের সাথে। আমার বন্ধুর দেয়া ইনভেস্টমেন্ট আর আমার ঘরবাড়ি, জমিজমা বেঁচে সব ইনভেস্টমেন্টটা অনেক বড় অংকের ছিলো।
তারা অপেক্ষা করছিল আজকের দিনটার জন্য। সমস্ত টাকা অন্য একাউন্টে ট্রান্সফার করে আমাকে ধোকা দিয়েছে। নি:স্ব করেছে আমি আরর আমার বন্ধুকে। প্রিয়তীর কথা শুনে কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছিল না এই সেই প্রিয়তী?? যাকে একদিন আগেও আমার পৃথিবী ভাবতাম ! ওরা ছককেটে গুটির চাল চেলেছে আমার উপর। আমি আজো জানি নি প্রিয়তী কেন এমন করলো আমার সাথে। সত্যিই কি ও করেছে নাকি ওকে দিয়ে করানো হয়েছে এসব?? সবই ছিলো একটা অভিনয় প্রিয়তীর । হয়ত ও এমন কিছু চেয়েছিলো।
-তারপর??
তারপর আমার মাথায় খুন চাপে। আমি জানি না ওয়ারড্রোবের উপর কে একটা ২ টা বুলেট ভরা লোডেড পিস্তল রেখেছিল। হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে আমি গুলি ছুঁড়লাম ওদের দিকে। মুহুর্তেই দুইজনের লাল রক্তে ভিজে যায় ঘরের মেঝে।
প্রিয়তী মারা যাবার আগে আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে ছিলো। বলেছিল "ভালবাসি সবসময়।" পাশে পড়ে থাকা নিথর দেহের বিপরীতে হাত দিয়ে কি জানি দেখাচ্ছিল ও।
আমি ছুটে গিয়ে দেখি একটা চিরকুট। প্রিয়তীর হাতের লেখা এতে।
আমি পকেটে হাত দিয়ে চিরকুটটা পুলিশের হাতে দিলাম।
-এই নিন।
-কি এটা?
-পড়েই দেখুন
"ওয়ারড্রোবের উপর লোডেড পিস্তলটা আমিই রেখেছিলাম। ওই কুলাঙ্গারটা আমাকে দিয়ে এসব করিয়েছে। তোমাকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দিয়েছে। আমি বেঁচে থাকতে এটা সম্ভব না। তাই তোমাকে রাগিয়ে দিয়েছি। আমি মুক্তি চাচ্ছিলাম। জানি তুমি অত্যন্ত ঘৃণায় হলেও আমাকে মুক্তি দিবে। জানি না আর কোনদিন তোমাকে পাব কিনা। ভাল থেকো।
"তোমার প্রিয়তী "
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:৩৩