-বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দিবে। কিছু কর তাসনোভা।
-বিয়ে করে ফেল। মেয়ে ভাল। উচ্চ শিক্ষিত। খাওয়া পড়ার সমস্যা হবে না তোমার।
-কি বলছ এসব?? আমি বাসা থেকে পালিয়ে আসবো তোমার কাছে। তুমি কিছু কর।
-আমার এখনো চাকরি বাকরি হয় নি। আমি কিভাবে কি করব ধ্রুব??
এটুকু ছিল শেষ কথা। ধ্রুবের সাথে আমার সম্পর্ক চার বছরের। প্রথম যেদিন ধ্রুবকে দেখি সেদিনই ওর প্রেমে পড়ে যাই। কতদিন ওর পিছনে পিছনে ঘুরেছি ! ছেলেটা এমন যে পাত্তাই দিলো না। আমার ফ্রেন্ডদের দিয়ে চিঠি পর্যন্ত পাঠিয়েছি। একদিন সাহস করে গোলাপ ফুল হাতে দাঁড়িয়েই গেলাম তার সামনে। ভয় হচ্ছিল ধ্রুব যদি না করে বসে?? তখন কি হবে?
সেদিন ও গোলাপী কালারের শার্ট পড়ে এসেছিল। কি যে সুন্দর লাগছিল ! একদম ক্লীন শেভড। ওর পারফিউমের মাতাল করা গন্ধ আমাকে অন্য এক জগতে নিয়ে গিয়েছিল। আমি ওর সামনে গিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বলেছিলাম, গোলাপের মত নিষ্পাপ যে মানুষটা, তাকে অনেক ভালবাসি। এই গোলাপটা তোমার জন্য ধ্রুব।
ধ্রুব কিছুটা লজ্জা পাচ্ছিল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। ভালবাসি শব্দটা না শুনেই ও গোলাপ হাতে দৌড় দিল বন্ধুদের সাথে।
তারপরের দিন ও ভার্সিটি আসে নি। কিছুদিন পর করিম চাচার টঙ দোকানে ৫ টাকার চায়ের সাথে ৩ টাকার টোস্ট ভিজিয়ে লাল চা খাচ্ছিলাম। ধ্রুবকে হঠাৎ দেখে উঠে দাঁড়ালাম।
-কি ব্যাপার ধ্রুব, তুমি?
-তাসনোভা আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল।
-হ্যা বল। আমি তো তোমার কথা শুনার জন্যই অপেক্ষা করছি।
-এই হাত যে ধরতে চাচ্ছেন ধরে রাখতে পারবেন তো?
-পারবো বলেই ধরতে চেয়েছি ধ্রুব।
-আমার না খুব ভয় করছে। বাবা, মা কে কি ভাববে। প্লিজ আপনি আমাকে কথা দিন আমাকে ছেড়ে যাবেন না কোনদিন।
-কথা দিলাম ধ্রুব। তোমাকে ছেড়ে যাব না।
একটু থেমে ধ্রুব কাঁপাকাঁপা গলায় জানালো সেও আমাকে ভালবাসে। বিশ্বাস করুন আমার যে তখন কেমন লাগছিল ! এভাবেই আমাদের প্রেমের শুরু।
বুড়িগঙ্গার তীরে ও আমার হাত ধরে ঘুরেছে। ফুচকা ছিলো ওর অনেক প্রিয়। টক দিয়ে ফুচকা। ওর সাথে থেকে থেকে আমিও ফুচকা খাওয়া শিখে গেলাম। যদিও টক আমার প্রিয় না। আমি ঝালটাই পছন্দ করতাম। রিকশায় উঠেই ধ্রুব বলতো হুড তোলে দিতে। তার নাকি লজ্জা লাগে ! আমি কোনদিন কোন ছেলে ফ্রেন্ডের সাথে রিকশায় হুড তোলে বসিনি। ব্যাপারটা কেমন জানি অস্বস্তি লাগে আমার। তাও ধ্রুব যেহেতু বলেছে না করে কি থাকা যায়?
আমি প্রায় প্রতি সপ্তাহে ওকে গিফট দিতাম। গোলাপি কালার প্রিয় ছিল বলে সবকিছুতে গোলাপি একটা ভাব ছিলো। আমাদের প্রথম হাত ধরার সিনটাও মনে রাখার মত। ও তো ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। কি আর করা? মেয়েদেরই নাকি প্রথম হাত ধরতে হয়। আমি সাহস করে ওর হাতটা ধরেই ফেললাম। বুকটা একটু কেঁপে উঠলো আমার। এত নরম, মিহি হাতের স্পর্শ যে একবার পেয়েছে তার কাছে এটা অন্য জিনিস। সারাজীবন মনে রাখার মত।
টাইমের ব্যাপারে ও ছিল খুব আনাড়ি। এত লেইট করতো ! তারপর এসে হাজারটা অযুহাত। কিছু বলাও যাবে না। বললে আবার মুখ ফুলিয়ে রাগ করে বসে থাকবে ধ্রুব।
সেদিনের সন্ধ্যাটার কথা না বললেই না। আমরা বসে আছি পার্কে। ধ্রুব আমার কাধেঁ মাথ রেখে বসেছিল। আমি ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। ও অনেক আবেগ নিয়ে আমাকে বলেছিল এভাবেই সারাজীবন আমার কাঁধে মাথা রাখতে চায়। আমি মাথা নেড়ে সাই দিয়েছিলাম। নি:স্তব্ধতার সবকটা ক্ষণ আমরা উপভোগ করছিলাম। ঝিরঝির বাতাসে ওর সিল্কী চুল আমার মুখে এসে লাগছিল। আমি যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম কোন এক রূপকথায়।
মাঝে আমাদের অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে। ধ্রুবের বাবা ওকে বিয়ে দিতে চেয়েছে। মেয়ে পক্ষ এসে ছেলে দেখে আংটি পরিয়েও দিতে চেয়েছে। বারবার ধ্রুব এড়িয়ে গেছে। এই বেকার জীবন নিয়ে আমি হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম।
মাস্টার্স,এমবিএ করে কি লাভ টা হল যদি একটা চাকরি জুটাতে না পারি? ধ্রুবকে যে বিয়ে করবো, ওকে খাওয়াবো কি?? পরাবো কি?
একদিন একটা চাকরির ইন্টার্ভিউ থেকে ডাক পেলাম। সৃষ্টিকর্তা যেন মুখ ফিরে তাকালেন। চাকরিটা হয়ে গেল আমার। অন্যদিকে ধ্রুবের বাবা ধ্রুবের ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ঘরের চারদেয়ালে বন্দী ও।
মাকে পাঠালাম ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। ধ্রুবের বাবা প্রথমে রাজি হন নি। ছেলেকে এমন মেয়ের হাতে তুলে দেয়াটা ঠিক হবে কি না !!
যাই হোক অনেক খড়কুটো পুড়িয়ে আজ আমাদের বিয়ে। সকাল থেকে ধ্রুবকে জেন্টস পার্লারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিকাল হয়ে যাচ্ছে তাও আসার নাম নাই।
কনে পক্ষ মানে আমি চলে এসেছি সেই কখন। জায়গায় জায়গায় গেইট ধরা হয়েছে। পিচ্চি গুলো এত পাজি। বলে ভাবির থেকে টাকা লাগবে আরো। আজকালকার পিচ্চি বলে কথা।
এখন আমি বসে আছি আমার বরের পাশে। আড়চোখে ওকে দেখে নিয়েছি। কি যে সুন্দর লাগছে। লাল টুকটুকে একটা শার্ট,ব্ল্যাক স্যূট। মনে মনে ভাবছিলাম,"আহ! আমার বর কি সুন্দর। "
আমি মনে মনে ভাবি এতবছর প্রেম করার পরও কান্না না জানি অপরিচিত কারো হাতে ছেলেকে তুলে দিলে কি হত! আমি ওর হাত ধরে হালকা চাপ দিলাম। এত কষ্টের মধ্যেও ও ফিক করে হেসে উঠলো।
আমরা গাড়িতে যেয়ে উঠলাম। ও বসলো আমার বাম পাশে। ছেলেরা নাকি বাম পাশে বসে মেয়েদের। কারণ ও আছে। হৃদয়ের সাথে সম্পর্কিত। কান্না করে ধ্রুব চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ও পরম মমতায় আমার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো।
ক্রিং....ক্রিং....ক্রিং...
-হ্যালো, ধ্রুব তুমি কই? এখনো ঘুমাচ্ছো??
-তাসনোভা !
-কি ব্যাপার? আকাশ থেকে পড়লে মনে হয়? ভার্সিটি আসবা না আজ??
-হুম আসবো তো। কেন বলতো।
-বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। প্লিজ কিছু কর। প্লিজ। ভার্সিটি আসো । সব বিস্তারিত বলছি।
আমি ১০ মিনিট ভ্যাবলাকান্তের মত বসেছিলাম। ভাগ্যিস এটা স্বপ্ন ছিলো !!!