সময়টা তখন কেমন জানি ছিল। ছাত্র রাজনীতির জয়জয়কার। কেউ কাউকে একবিন্দু ছাড় দিতে রাজি না। রাষ্ট্রপতি এরশাদ সবে ক্ষমতায় এলেন। ক্ষমতায় এসেই তিনি পুরোনো সব নিয়ম ভাঙতে শুরু করলেন।
দেশ তখন অন্যরকম। এমনই এক অস্থির সময়ে বোকা আমি প্রেমে পড়ে যাই। সে আজকালকার প্রেম নয় যে একদিন পরিচয়, পরের দিন প্রেম নিবেদন, এর পরে হয় বিয়ে না হয় কোন একদিন বিচ্ছেদ।আমাদের সময়ের প্রেমটা ছিলো কবিতার মত। কিছুটা সাদামাটা আর কিছুটা খুবই কারুকার্য ময়।
ও ছিল সেই সময়ের পাড়ার বেশ নামকরা সুন্দরী। মেট্রিক পাশ করার আগেই বাড়িতে ডজনখানেক বিয়ের প্রস্তাব। আমি তখন ছাত্র রাজনীতি করি। রাজনীতি থেকে বড় ভাইদের ফরমাইশ পালন করি। এটা বলা বোধ হয় বেশি ভাল।
কলেজে উঠে আমি কেন্টিনে চা,বিস্কিট আনার নাম করে ওকে দেখে নিতাম। এক ক্লাসে থেকেও কোনদিন কথা বলতে পারি নি। একটু ভীতু ছিলাম এই ব্যাপারে। নীল রঙ ছিলো ভীষণ প্রিয়। কি জানি হয়ত এজন্যই ওর নাম 'নীলা' । প্রায়ই দেখতাম কলেজ লাইব্রেরীতে কি যেন নোট করতো ও। আমি কোনদিন সাহস পাই নি।
ওকে নিয়ে কলেজে তখন তুমুল কান্ড। সিনিয়র ভাই থেকে শুরু করে ব্যাচ মেট সবাই নীলা বলতে অজ্ঞাণ। একবার কি হয়েছিল ও তার বান্ধবীদের সাথে হেঁটে বাসায় ফিরছিল। কলেজের বদরুল ভাই আর তার কিছু বন্ধু পথ আগলে দাঁড়ায়। একটা কাগজ দিয়েছিল। আমি দূর থেকে দেখছিলাম। খুব সম্ভবত প্রেমপত্র ছিলো। ও ছূঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।
সেটা নিয়ে কলেজে তার পরের কয়েকদিন সে কি তুলকালাম কান্ড। ওকে পছন্দ করার অপরাধে বদরুল ভাই আর তার কয়েকটা বন্ধু কে অন্য এক বড় ভাই ডেকে সেই ঝারি দিলেন।
এতকিছুর পর আমি সত্যিই আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। যেখানে উনাদের মত এত বড় নেতা গোছের মানুষ ওকে জয় করতে পারে নি সেখানে আমি তো কোন ছার।
ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু সাহস হারাই নি। আমি তখন কলেজের রেগুলার ছাত্র। আগে গড়িমসি করলেও এখন আর গড়িমসি করি না। কয়েক কিলোমিটার পথ সাইকেল মাড়িয়ে ঠিক ঠিক চলে আসি।
ক্লাসনোটের নাম করে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব টা হয়ে যায় ঠিকই কিন্তু আর আগায় না সম্পর্ক। প্রতিদিন কলেজ শেষে ওর বাড়ি পর্যন্ত আমি সাইকেল হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে ওকে সঙ্গ দিতাম। সেটা কেবলই সঙ্গ ছিলো। বন্ধুত্বের বাইরে একটা কথাও কোনদিন হয় নি।
ওই সময়টাতে মানে আশির দশকের কথা বলছি। ওই সময়ের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষরা প্রেম-বিয়ে এগুলো একদম মেনে নিতো না। অনেকটা নিষিদ্ধ কাজ মনে করা হত। ভুল করে কেউ প্রেম করে ফেললে তাকে একঘরে করে দেয়া হত।
এর মধ্যেই ওর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এল। ছেলে ঢাকার সুপ্রীম কোর্টের ব্যারিস্টার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা। যোগ্যতার বিচারে অনেক উপরে আমার থেকে। আমি এখন পর্যন্ত ওকে মনের কথাটা বলতেই পারলাম না।
বুদ্ধি আটালাম একটা মনে মনে। তখন ঢাকাইয়া সিনেমাকে বই দেখানো বলা হত। একদিন আমি ওকে নিয়ে গেলাম একটা বই দেখাতে। উদ্দেশ্য ছিলো সিনেমার রোমান্টিক দৃশ্যের শেষে ওর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিবো। আমি জানি না এটাকে প্রেমপত্র বলে কিনা। শুধু জানি এখন আমাকে কিছু করতেই হবে।
যেভাবে ভেবেছিলাম সেভাবেই কাজ করলাম। রাজ্জাক- ববিতা যখন প্রেমে মশগুল তখন আমিও সুযোগ বুঝে ওর ইমোশনের ফায়দা নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিলাম।
ও কিছু ধারণাও করতে পারে নি। পরদিন কলেজে এসে শুধু একটা কথাই বলেছিল -
"ভালবাসলে বাসায় প্রস্তাব পাঠাতে বল। হাতে বেশি সময় নেই"
আমি কি বলবো ওই মূহুর্তে বুঝতে পারছিলাম না। একে তো বাড়ির বড় ছেলে। আমার ছোট দুইটা ভাই একটা স্কুলে পড়ছে আর অন্যটা সবে হাঁটা শিখেছে।
বাবা মরা ছেলে মানুষ হয়েছি মার কাছেই। মাকে কিভাবে কথাটা বলবো। ভয় ছিলো খুব। যদি ওকে হারিয়ে ফেলি। আমি কোনভাবেই এই মুহুর্তে বলতে পারছিলাম না। কিভাবে বলবো?? অভাবের সংসার। মা একা হাতে সামলাচ্ছেন। বাবার বাড়িতে পড়ে আছেন তিন ছেলেকে নিয়ে। এই মুহুর্তে যদি গিয়ে বলি মা বিয়ে করবো ! কি অবস্থাটা হবে? পায়ের নিচে মাটি নেই। মাথার উপর বাবার ছায়া নেই। ছোট দুই টা ভাই।
আমি যেন মরে যাচ্ছিলাম। একদিকে চোখে ভাসছিল নীলার নীচু মুখে বলা কথাগুলো অন্যদিকে ভাসছিল মা'র অভাবের সংসার। কি করা উচিত আমার এই মুহুর্তে??
-সে কি দাদু ভাই! তুমি কাঁদছ??
- না দাদু ভাই। এই চোখে কি জানি পড়েছে তাই।
-তারপর কী হল বল না। বল না।
-কাল স্কুল নাই বুঝি?? রাত কত হল??
-আছে। তো? আমি শুনেই যাব।
-তোমার মা আসবে একটু পর। তখন??
-মাকে না করে দিবো। বলবো আজ দাদু দিদার সাথে ঘুমাবো।
-হা হা হা। আচ্ছা দাদুভাই, কাল বলবো বাকি টা। কেমন?
-না, না, না। আমি আজই শুনবো।
-কালকের পরের দিন থেকে তোমার সামার ভেকেশন না? কাল সবটা বলবো।
-সত্যি তো? প্রমিজ কর।
-ওকে। প্রমিজ,প্রমিজ, প্রমিজ।
-আচ্ছা, গুড নাইট। হ্যাভ এ নাইস স্লিপ।
-হা হা হা। গুড নাইট দাদুভাই। ইউ টু।
শ্রেয়া। আমার নাতনী । ক্লাস টু তে পড়ে। অনেক পাকনামি শিখে গেছে। আমার কাছে গল্প শুনতে চলে আসে। আচ্ছা কয়টা বাজে??
চশমাটা পড়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। ১২ টা বাজতে ৫ মিনিট বাকি। শ্রেয়ার দিদা ঘুমিয়েছে একটু আগেই। এসির ঠান্ডা বাতাসে একটু যেন কাঁপছে। আমি গুটি গুটি পায়ে চাদর টা এনে জড়িয়ে দিলাম ওর গায়ে। বয়স হয়ে গেছে মানুষটার। আমারও হয়েছে অনেক।
কি জানি?? বয়সের ভারে নাকি আমার সাথে রাগ করে ঘুমিয়ে গেছে কে জানে !! ওর কি ধারণা আমি ভুলে গেছি??
হাতের কাছে একটা কাগজ ছিলো। আমি তাতে লিখে দিলাম কিছু কথা। তারপর ভাজ করে টেবিলের উপরে গ্লাসের নিচটায় রেখে দিলাম।
ভোরের আযানের শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙলো। অন্যদিন উঠে গেলেও আজ আমি শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম। ওর ঘুম থেকে উঠে পানি খাওয়ার অভ্যাস।
কাগজটা হাতে নিলো এই মাত্র। আমি আড়চোখে দেখছিলাম। চোখ মুখ দেখে বোঝা গেল ও নিজেও খুব অবাক হয়ে গেছে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো। আমি তখন ঘুমের ভান করে শুয়ে আছি। এতটা বয়স পরেও ওর হাসিটা আমার বুকে এসে লাগে।
আপনাদের খুব ইচ্ছা হচ্ছে জানার কি ছিল সেই কাগজে লেখা?? তবে শুনুন -
"বাশীঁর লহরে ডোবা পরানের ঘাসের ভিতর,
মানুষ কি জানে কেন মোচড়ায় মানুষের মন?
শুভ জন্মদিন প্রিয়তমা 'নীলা'। তোমার এই নামটা আর কেউ জানে না। আজ আমাদের নাতনী শ্রেয়াকে আমাদের ভালবাসার গল্পটা বললাম। জানো আমি যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই সময়টাতে। সেই তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম আমার চোখের সামনে। নীল শাড়িতে আমার নীলা।
ভালবাসি আমৃত্যু "
- তোমার 'আমি'
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৩:২৪