-----------------------
" মেঘবালিকা,আমায় তুমি নিবে তোমার সাথে?
জলের ফোটায় ভাসব দু'জন গহীন সমুদ্দুরে। "
জানালার গ্লাসে বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে। আমার হচ্ছে এই এক সমস্যা। মাথায় এ দু'টো লাইন ঘুরঘুর করছে তো করছেই। কিছুতেই বের করতে পারছি না। বাসে করে ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছিলাম।
তখন কেবল দিন কালো হয়ে আসছিল। বাসে উঠা মাত্রই বৃষ্টি। একেবারে ঝুম বৃষ্টি যাকে বলে। জানালার ঝাপসা কাঁচে বৃষ্টি দেখছিলাম। কিছু কিছু জিনিস দেখলে চোখে শান্তি শান্তি ভাব আসে। এই যেমন আজকের বৃষ্টি টা।
ফার্মগেটের মোড়ে আমার মেঘবালিকার সাথে দেখা। ও হুড়মুড় করে আধ ভেজা অবস্থায় বাসে উঠে গেল। বসলো আমার ঠিক পাশের সারিতেই।
ওকে দেখার পর থেকেই কেন জানি মাথায় ওই দুইটা লাইনই বারবার ঘুরছে "মেঘবালিকা,আমায় তুমি.... "
আড়চোখে ওকে দেখে নিয়েছি। চোখে চোখ পড়ে গেলে বিব্রতকর অবস্থা হতে পারে। কি দরকার?? থাকুক না এভাবেই। ওকে কেমন জানি অস্থির অস্থির মনে হচ্ছে। মনে হয় জরুরী কোন কাজ আছে।
আচ্ছা এই বৃষ্টির দিনে কি কাজ থাকতে পারে?? মেয়েটা ছাতা আনতেও ভুলে গেছে। আমার ছাতাটা কি ওর হাতে দিবো?? বাস থেকে নেমে আবার ভিজে যাবে যে। কেন জানি খুব মায়া লাগছিল এই অচেনা অজানা মানুষটার জন্য।
ধূর! এসব কি ভাবছি আমি?চিনি না জানি না এমন একজনকে নিয়ে কি উদ্ভট চিন্তা আমার। আমার মাথাটা নিশ্চয় গেছে। আমি আবার বৃষ্টি দেখায় মন দিলাম। ঝাপসা কাঁচে দেখলাম একটা ছেলে একটা মেয়ে মেইন রোড দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে খালি পায়ে। আনমনে কাঁচে ওদের ঘিরে একটা লাভ সাইন একে দিলাম। তার উপর বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ে। ওরা ভিজে যায়,ভিজে যায় আমার আঁকা সেই ভালবাসার বৃত্ত আর ভিজে যাই আমি।
মেঘবালিকা আবার আমার সমস্ত চিন্তায় ভর করে বসলো। আমি যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম মেঘবালিকা আমার দিকে তাকিয়ে চোখের উপরের চুলটুকু সরিয়ে জিজ্ঞেস করছে -
-কি মশাই, কি ভাবছেন এত? হুম?
সম্মোহিত আমি মনে মনে কথা বলে যাচ্ছি -
-এইতো কিছু না। আপনি দেখি ভিজে গেছেন।
-ছাতাটা ভুলে ফেলে এসেছি। কি যে করি না আমি !
-আপনার হাসিটা অনেক সুন্দর !
-কবি সাহেব আবার এত কিছু লক্ষ্য ও করেন দেখি।
-কবিদের তো রোমান্টিক হতে হয়। আমি না হয় আমার রোমান্সের প্রথম পরীক্ষাটা আপনার উপরেই করলাম।
-এ যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি আমার জন্য।
-জানেন, এই মূহুর্তে আপনাকে নিয়ে দু'টো লাইন মাথায় ঘুরছে অনবরত। কিছুতেই বের হচ্ছে না।
-আমাকে নিয়ে? আমি তো এমন কেউ না যাকে নিয়ে কবি কবিতা লিখতে পারে কিংবা ভাবতে পারে ।
-এত কিছু বুঝি না। বৃষ্টি আপনার কেমন লাগে?
-এমনিতে বেশ ভালো। কিন্তু এই যে দেখুন মাঝে মাঝে কাজের সময় হুটহাট ভিজিয়ে দেয় ! ওই দু'টো লাইন শুনাবেন বলেছিলেন। কই শুনি !
- " মেঘবালিকা, আমায় তুমি নিবে তোমার সাথে?
জলের ফোঁটায় ভাসবো দু'জন গহীন সমুদ্দুরে! "
-হা হা হা ।
-হাসলেন যে !
-এই ফার্মগেটের ব্যস্ত,ময়লা রাস্তায় আপনি সমুদ্দুর খোঁজে নিলেন !
-হা হা হা। ভাবতে দোষ কোথায়?? তা আপনি যাবেন কোথায়?
-যাবো আঁগারগাও।আমার বাসাটা সেখানেই। ছোট একটা ফ্ল্যাট বাড়ি। একটা ছোট বারান্দা ।
-আর কেউ থাকে না?
-থাকে। আমি আর আয়ান। ও আচ্ছা আয়ানের কথা বলতে ভুলেই গেছি। আয়ান আমার ছেলে। এখনো স্কুলে ভর্তি হয় নি সামনের বছর ভর্তি করাবো। যা দুষ্টু হয়েছে। ছোট বাসায় আমাকে সারাদিন দৌড়ানো লাগে ওর পিছনে।
-কিছু মনে করবেন না। আপনি আর আয়ান? আয়ানের আব্বু?
-ও আসলে কিছু দিন আগেই......
চোখের ভাষায় আমি যেন বুঝে নিলাম বাকিটুকু। বুঝতে বাকি থাকলো না পৃথিবী কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে।
বাসের হেলপারের কর্কষ ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো আমার। ঘোর কাটতেই পাশে তাকিয়ে দেখি পাশের সারির ওই সিটটায় অন্য এক ভদ্রলোক বসে আছেন। মেঘবালিকা নেমে গেছে হয়ত।
মেঘবালিকার জন্য কেন জানি আমার খুব বেশি খারাপ লাগছিল। তখনো ঝুম বৃষ্টি পড়ছিল। আমার চোখের কোণায় ও কিছু অযাচিত দু:খ মেঘের জলের মত জমা হচ্ছিল। হাতের উল্টোপিঠটা দিয়ে এমন ভাবে একটু মুছে নিলাম যেন কেউ বুঝতে না পারে।
কি জানি ! মেঘবালিকা হয়ত এতক্ষণে ভিজে একাকার হয়ে আঁগারগাও কিংবা ঢাকার যেকোন প্রান্তে চারকোণা ছোট্ট ফ্ল্যাটটায় গিয়ে পোঁছেছে। তাকে দেখা মাত্রই ছোট্ট আয়ান বাবুটা হয়ত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছে। মেঘবালিকার চোখে মুখে সারাদিনের ক্লান্তির ছাপ হয়ত মুছে গেছে।
ভাবতে ভালই লাগছে দু'টো হাসি মুখকে। পরের স্টপেজে আমাকে নামতে হবে। জানালার কাঁচটায় ফোঁটা ফোঁটা মেঘের জল জমে আছে এখনো। আমি হাতের তর্জনী দিয়ে বড় করে একটা ভালবাসার বৃত্ত এঁকে দিলাম ।
তার ঠিক মাঝখানটায় লিখে দিলাম "মেঘবালিকার জন্য" ।
ভালো থাকুক আমার মেঘবালিকা শহরের কোন একপ্রান্তে। ভালো থাকুক বৃত্ত আঁকা আমার কাল্পনিক ভালবাসা ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৯:৪১