তখন ইরাক এমন রূক্ষ ছিলো না। ইউফ্রেতিস-তাইগ্রীসের আশীর্বাদে উর্বরা জমিতে জব-রাইনের চাষে সবার মুখে হাসি লেগে থাকতো। রাতের বেলা উচ্ছিষ্ট জবে মধু মিশিয়ে গেজানো হতো নেশাতুর মদ। শীত চলে গেলে পাহাড়ের গা বেয়ে হেসে উঠতো দিগন্ত বিস্তৃত সুমিষ্ট আঙ্গুরের বাগান। সেই পাঁকা আঙ্গুর ঘরে উঠলেই ওক কাঠের ড্রামে জমতো লাল, সাদা সুরা। বলা হয়ে থাকে ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী ওয়াইনের স্বাদে দোশোয়ালি মসলার স্বাদের চল এখান থেকেই। তা হবে ৬-৭০০০ বছর আগের কথা। ইউফ্রেতিসের মিষ্টি পানি এতটাই দিয়েছিলো যে তারা আসমানের সেসব ঈশ্বরদের কাছে হাত পাততো যারা যৌনতা, ভালোবাসা, যুদ্ধ, ক্ষমতার আধার। ইনানা-ইশতার আরাধনায় নামে মন্দির তৈরী করতো। ইরাকী, সিরিয়ান, সাসানিদদের প্রাচুর্য্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে স্থানিয়দের ধর্মেও ইনানার প্রভাব পড়তে শুরু করে, মিশরের আফ্রোদিতি তো তারই ছায়া।
জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্ষমতার পালাবদলে মেসোপটেমিয়ার সুদিন স্থায়ী হয়নি, ইনানা-ইশতারও প্রভাব হারায়। তখন ইন্দো-ইরানীয়ানরা ভালো করতে শুরু করলে জুরুস্থ্রু ধর্মের প্রভাব বাড়তে থাকে। সেদিকের অঞ্চল কিছুটা রুক্ষ হওয়ায় আনাহিতা নামের দেবীর জন্ম হয়। বিশ্বাসীরা বলতো সর্বশক্তিমান আজুরা মেহতা পৃথিবী সৃষ্টির পরপরই এক নদীর সৃষ্টি করেন যিনি সকল নদীর মা। সেই নদী ভাগ হয়ে আশীর্বাদ পৃথিবীর প্রতন্ত অঞ্চল করেছে উর্বর। আর ঐ আদি নদী যার হতে তৈরী সেই আদি দেবী হলো আনাহিতা। তখন কাবুলের নাম ছিলো হারাহ্ভতি: অর্থ নদীর শহর। কাবুলে কখনো যাইনি, সেখানে কি সত্যি এত নদী ছিলো? নাকি বরফ গলা পানি ইরানের মাঝে বইয়ে যেতো নদী হিসেবে, তাই জুরুস্থ্রু অনুসারী পারসিয়ানরা তাকে এই নাম দিয়েছিলো এটা জানতে হলে ঐতিহাসিকদের পিছে ধর্না দিতে হবে।সময় গড়িয়ে গেলে যখন ভারতবর্ষে আফগানিস্থান, মঙ্গোলীয়ান, চৈনিক কানিস্ক এবং পারসীয়ানদের নজর পড়ে তখন স্থানীয়দের আচারেও এর প্রভাব পড়ে।
বলা হয়ে থাকে আমাদের পূর্বপুরুষ নাকি আর্যরা। আর্যরা মূলত খ্রিস্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগে ভারতে আসে, এবং ঠিক তখনই সনাতনী ধর্মের উদ্ভব হয়। তাদের আনাহিতার আদলে পার্শ্ববর্তী কাবুলের মতো স্যাতস্যাতে নদী জলাভূমি বনভূমি পূর্ন এলাকায় তার নাম হয়ে যায় স্বরস্বতী। কাবুলের দিকে যে দেবী ছিলো নদী, ফসল, উর্বরা, ক্ষমতা, শক্তির প্রতীক, সনাতনী ধর্মে সে হয়ে গেলো শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, সংগীত, প্রজ্ঞার প্রতীক।
দুটো ব্যাপার লক্ষনীয়: মানুষ বেঁচে থাকার প্রয়োজনে দেব দেবীর ক্ষমতার বিবর্তন ঘটায় এবং সভ্যতা কখনো এক স্থানে স্থির থাকে না। যখন কেউ বলে আমাদের পূর্ব পুরুষ এটা করেনি, সেটা করেছে তখন প্রশ্ন জাগে আমাদের পূর্ব পুরুষ কে? কারা? তারা কি ভূমিপুত্র?
বাবা আমাকে বলতেন দাদা প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন। দাবা খেলায় চ্যাম্পিয়ন হলে বিলেতের অনেকে তার ছবি তুলেছিলেন। কলকাতায় খেলার আমন্ত্রন পেয়েছিলেন। হঠাৎ করে তিনি পাল্টে গেলেন। বিয়ে শাদী করে পুরোদস্তুর ধার্মিক। নিজের ছবি সব পুড়িয়ে ফেলেন দাবার সাথে। জীবন জীবিকার একটা নেশা তার মধ্যে ছিল। তবে তার চোখে কখনো সুখ ছিলো না, স্থিরতা ছিলো না। তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে গেলে এক অজানা হতাশা গ্রাস করে। বাবাকে তিনি চেয়েছিলেন তার মতো করেই মানুষ করতে। ভারতবর্ষ ভাগের পর ঢাকা পাঠান উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে। সবসময় বলতেন কিছু একটা করতে।বৃদ্ধ দাদার পাগলামো দেখে যখন বিরক্ত হতাম তখন বাবা কাছে ডেকে বলতেন এই মানুষটার অর্জন নিয়ে, বলতেন আমরা যতই নিজেকে বাঁধতে চাই, নিজের সত্বা বিদ্রোহ করবেই। জীবন অর্থহীন হবে।
আমার সত্বার জন্ম কোথা থেকে? এই সত্বার সাথে আমাদের পূর্বপুরষদের চাপিয়ে দেয়া ঐতিহ্য কতটুকু মিশে আছে? আমার তো মনে হয় আমাদের পূর্বপুরুষ বলতে নির্দিষ্ট কিছু নেই। কনিস্ক নামের এক মহারাজা ছিলেন যিনি আফগানিস্থান, ইরান, পুরো ভারতবর্ষ দখল করে পুরো চীনও তার আয়ত্বে ছিলো। তার ন্যায়পরায়নতা, সর্বজনবিদিত এবং তাকে রাজাদের রাজা বলা হতো।তার অর্থনীতি ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ন, স্থানীয় মুদ্রার প্রচলনে সোনা ব্যাবহার করতেন। কয়েক দশক পর তার রাজত্বের পতন ঘটে। কনিস্কের সময়কাল শুরু হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব দেড়শো বছর আগে। তার আগে ইরানিয়ানরা এসেছিলো, আর তার আগে? কেউ না কেউ নিশ্চয়ই? প্রশ্ন জাগতে পারে আমাদের স্থানীয় পূর্বপুরুষরা কখনোই কি নিজেদের শাসন করেননি?
আমাদের ধর্ম সংস্কৃতি তাদের চিহ্নই বহন করে। হালে আমরা ইসলামী সভ্যতায় মশগুল তারপরও আমরা পুরোনো সেই নবান্নের উৎসব থেকে শুরু করে, বাংলা ক্যালেন্ডারের পহেলা বৈশাখ সহ নানা কিছু পালন করছি। বাংলা ক্যালেন্ডারের গোড়াপত্তনও তো আমরা করিনি। তার মানে এটাও আমাদের সংস্কৃত ছিলো না। বিজাতীয় শাসক খাজনা তুলবার জন্য এবং কৃষিকাজের সুবিধার্থে এর প্রচলন করেছেন। তারও আগে আমাদের সংস্কৃত আচার ঐতিহ্য অন্যরকম ছিলো।
এরকম মূল খুজতে গেলে ডারউইনের সেই বিবর্তন নিয়ে বসতে হবে। আজ হতে ৫০-৬০ হাজার বছর আগে যখন নিয়েনডার্থালরা দুনিয়া কাপিয়ে বেড়াতো তাদের কথা বলতে হবে। ৪৫ হাজার বছর আগে নিয়েনডার্থালরা ছড়িয়ে পড়লে তাদের মধ্যে থাকা বিবর্তিত বর্তমান হোমোস্যাপিয়েন্সরা নিজেদের মধ্যে গোত্র তৈরী করে বিদ্রোহ শুরু করলো, একের পর এক ব্যার্থ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে লাগলো, সেটাই ছিলো আধুনিক সভ্যতার কারিগর মানুষের ইতিহাসের গল্প।
২০২০ সালটা আমার কাছে এজন্যই গুরুত্বপূর্ন যখন আমরা বুঝতে পারি আমরা কি হারিয়েছি, কি অর্জন করছি এবং এই অর্জনের পেছনে কতটা উৎসর্গ করতে হয়েছে। দিন শেষে আমরা হিসাব করছি যা হারালাম আসলেই কি তা ঠিক ছিলো। যারা মনে করেন যা হারিয়েছি তার মূল্য শোধ করা যাবে না, তারা রাস্তায় নেমেছে। কখনো ভাস্কর্য্যের নামে, কখনো ধর্ষনের অপসংস্কৃত রুখবার নামে, কখনো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। সবখানেই বিপরীতমুখী দলগুলো মুখোমুখি ছিলো। বিশৃঙ্খলার সৃষ্টির সুযোগ ছিলো। নানা কারনেই হোক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েনি।
পদ্মা সেতু, অবিশ্বাস্য দ্রুততম সময়ের সাথে বিচার সম্পন্ন হবার সংস্কৃতি, কোরোনার মহামারীতে শতভাগ সফলতার সাথে গার্মেন্টস কর্মীদের ডিজিটাল উপায়ে প্রনোদনা আমাদের মনে আশা জাগায়। বড় বড় টাকার কুমির হওয়া ঘুষখোররা যখন একে একে ধরা পড়ছে, তখন আমরা সোচ্চার হচ্ছি পালের গোদাকে কখন পাকড়াও করবে। এসব সুখবরও যেনো ঢেকে যায় ভয়ংকর খারাপ খবরে। কোরোনার কারনে লক্ষ কোটি মানুষ কর্মহীন। দেশের স্বাস্থ্যব্যাবস্থা দু একটা মানুষের কারনে ধ্বসে পড়লো তারা শাস্তি পাবার বদলে পুরস্কৃত হলো, ধরা পড়লো চুনোপুটি। সরকারী ছত্রচ্ছায়ায় পর্বতসম দুর্নীতির ছড়াছড়ি সেখানে মানুষ দুটো চালের জন্য রাস্তায় নামছে। দেশের জিডিপি বিশ্বের শীর্ষস্থানে: এই খবরটি যেন এক অশ্লীল কৌতুক।
তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে। আজ থেকে হাজার বছর আগে মানুষ যে কারনে দেশান্তরী হতো, আসমানী সাহায্যের আশায় বিভিন্ন নামে ঈশ্বরের আরাধনা করতো, এখনও মানুষ তাই করছে। হতে পারে ঠিক এ কারনেই ২০২১ সাল হবে সম্ভাবনায়, হাজারটা খারাপ খবরের ভীড়ে আরও বেশী বেশী ভালো খবর শুনবো। এমনও হতে পারে একটা বিশাল পরিবর্তন, আর তার পরেই হয়তো বাস্তবায়িত হবে ইউটোপিয়ান আকাঙ্খা!
এতটুকু বিশ্বাস রাখতে সমস্যা কি বলেন? সংগ্রামী মানুষের জেদ আর বিশ্বাসটাই হলো সুপার পাওয়ার।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫৫