৬০ এর দশকে কানাডিয়ান নৃতত্ববিদ এন্ড্রু ওয়ালেস উচ্ছ্বাসের ভঙ্গিতেই আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রসরতার কারনে অলৌকিক শক্তির ওপর বিশ্বাস বিদায় নেবে বলে জানিয়ে দিলেন। তখনকার আমেরিকা কেবলি যৌবনে পা দিয়েছে। মিত্রশক্তির সহায়তায় জার্মানদের হারিয়ে বিশ্বযুদ্ধে আটম বোমার চমক দেখালো। আর তার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নকে নতুন শত্রু হিসেবে দাড় করিয়ে পৃথিবী জুড়ে আমরিকান গনতন্ত্রের নামে কার্পেট বোম্বিং চালানো শুরু করলো। কেউ কেউ পকেট ভর্তি ডলারে লালে লাল শাহজালাল, কিছু দুর্ভাগা বারুদের গন্ধে প্রান হারাবার সময় ইয়া নফসি ডাকারও সময় পেলো না।
সময় গড়িয়ে ঊষালগ্নে আমেরিকান ক্যাপিটালিজম এখন। চীনা মোড়কের ক্যাপিটালিজম দোড়গড়ায় কড়া নাড়ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি একসময়ের ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রগতিশীল সরকারী পদ জাতিয়তাবাদি ডানপন্থিরা গিলে খাচ্ছে। ভারত মঙ্গলে যান পাঠানোর আগে গোমাতা দিয়ে পূজা করাচ্ছে। এন্ড্রু ওয়ালেস যে ভুলেছেন সেটা ধর্মবিরোধিরা অস্বীকার করে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত দেখালেও সামগ্রিক পরিস্থিতি ভয়ংকর। পোল্যান্ডের মতো দেশ ইউরোপের কেন্দ্রে বসে ইতালি, হাঙ্গারি, বেলারুশদের চোখ রাঙ্গাচ্ছে ইউরোপীয়ান মূল্যবোধকে চ্যালেন্জ্ঞ দুড়ে তখন বুঝতে বাকি থাকে না অলৌকিক বিশ্বাসের ওপর মানুষের আস্থা কোকেনের নেশার মতো জেকে বসে থাকবে ভালোভাবেই আগামী কয়েক দশক।
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু ভেবেছিলেন তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ভারত চালাবেন যুক্তি ও বিজ্ঞানের ওপর ভর করে যেখানে হিন্দুদের ভেদিক গ্রন্থ ও মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে একীভূত করে একটি সহবস্থানমূলক সমাজ ব্যাবস্থা গড়ে তোলা হবে। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক আবার এক কাঠি সরেস ছিলেন। মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে তার সাহসী পদক্ষেপ অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলো বৈকি। কিন্তু ২০২০ সালের জুন মাসে স্কুল কলেজের পাঠ্যবই থেকে বিবর্তনবাদকে বাদ দেয়াটা তার চেতনার ভুলন্ঠনের ইঙ্গিত দেয়।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কলমপেষা দার্শনিক পিটার হ্যারিস অবশ্য ব্যাপারটাকে অন্যভাবে দেখেন। তার মতে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা ধর্মের ওপর প্রভাব ফেলে না। মানুষ ধর্মকে আকড়ে ধরে যখন সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করে। রাষ্ট্র জনগনের মৌলিক চাহিদার পূরনে অক্ষম হয় তখন জীবনমান কমতে থাকে। এরকম অনিশ্চয়তায় সমাজের অধিকাংশ মানুষের মনে হতাশার জন্ম দেয়, অনিশ্চয়তা আকড়ে ধরে। তখন ধর্মের বিস্তার ঘটে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়াড়ের মতো। আলজেরিয়া, তুর্কির মতো দেশ সমুহে ধর্মনিরপেক্ষতার পেছনে জনগনের সমর্থন ছিলো কারন সেসময় ঐ দেশগুলোর অর্থনীতিতে জোয়ার এসেছিলো। সবার চোখে মোহ লেগেছিলো উন্নত জীবনের আহ্বান। মানুষের আত্মবিশ্বাস তাদের করে তুলেছিলো বাস্তবিক, যৌক্তিক। আর তাই পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে উন্নয়নের ধারার ধারাবাহিকতা দীর্ঘস্থায়ী হবার ফলে জনগোষ্ঠির বিশাল অংশ ধর্মহীনের দলে নাম লেখায়। ভাগ্যের চাকা বদলাবার জন্য আকাশ পানে হাত তুলে সময় নষ্ট করে না। সরকার মাথা ঘামায় জনগনের জীবনমান উন্নততর করার পিছে। সেখানে বাংলাদেশের সরকার চেষ্টা করছে খাতা কলমের উন্নয়নে জনগনকে ভুলিয়ে রাখতে। দিনশেষে সবাই দেখে এগুলি মেকি, অন্ধকার ভবিষ্যত আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যায়। একটু ঠান্ডাতেই রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষগুলো মরে পড়ে থাকে অথচ আলিশান মসজিদ গুলো ফাঁকা পড়ে থাকে। কেউ কেউ দামী মাইকের দোহাই দেবে- উলামায়ে শূ/উলামায়ে গুগলদের কাছে দরিদ্র মানুষের জীবনের চাইতে এই মাইকের দাম অনেক!
ধর্মভিত্তিক রাস্ট্রের করাল থাবার ভয়াবহ রূপ ইরানে দেখতে পারি। সেদেশের সরকারের ভাবমূর্তি ফ্যাসিষ্টরূপকেও হার মানায়। নিজেদের নাগরিকদের আকাশপথে ক্ষেপনাস্ত্র দেগে হত্যা করে। নিজেদের পরমানু বিজ্ঞানীকে খুন করে ইসরাইলের জুজুর ভয় দেখায়, স্যাটেলাইট দিয়ে নিরিখ করে মারা হয়েছে-এমন আজগুবি গল্প আবারো শোনায়।জনগন এখন অষুধের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে কারন ঘাড়ে ঝুলছে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা। অথচ তাদের রেভ্যালুশনারী ফোর্সের পেছনে কোটি কোটি রাষ্ট্রিয় অর্থ খরচা করে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে হামাস সহ নানা সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহায়তা প্রদান করছে যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। তারা এতটাই হিংস্র যে খোদ সুইডেনের বুকে তারা হত্যাকান্ড চালানোর চেষ্টা করে। তাদেরকে রুখতে সৌদি আরব জোট বেধে অসহায় ইয়েমেনীদের ওপর বোমা মেরে লক্ষ লক্ষ মানুষের লাশ ফেলে দেয়। তারা যে অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করছে সেখানে লেখা থাকে মেড ইন আমেরিকা, জার্মান, চায়না, রাশিয়া।
সরকারের খুব বেশি কিছু দরকার নেই জনগন কে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বি করে তোলা। কিছুদিন আগে চিনিকল গুলো বন্ধ হলো, গোল্ডেন হ্যান্ডশেক ও বেতন পাওনা মিলিয়ে ৫০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলো। অথচ জাইকাকে দিয়ে করানো জরিপে বলা হয়েছিলো চিনিকলগুলোর আধুনিকায়নে মোট দরকার ১০০০ কোটি টাকা এবং তা করলে চিনির উৎপাদন খরচ কমবে, কমবে ভারত নির্ভরতা। লাভবান হতো আমাদেরই শ্রমিক পরিবার, দেশীয় শিল্প, জনগন।
বিদ্যমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন করতে যে টাকার প্রয়োজন তার চে কয়েকগুন বেশী টাকা যাচ্ছে ভাড়ায় খাটা বিদেশী কর্মকর্তা ও কনসালট্যান্টদের পেছনে।
এদিকে যারা সমাজের উন্নয়নের কথা বলবেন তারা যুক্তিবাদী ও শিক্ষিত সমাজব্যবস্থার সাথে ধর্মহীনতার সংযোগ দেখিয়ে বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা সবাই ব্যাস্ত ইসলামের সাথে বিজ্ঞান কতটা সাংঘর্ষিক এই কুতর্কে, অথচ আমরা যতই এ নিয়ে তর্কে করবো ধর্মপ্রান মানুষ মুক্তমনাদের ততই ঘৃনা করবে। তাদের এই ঘৃনার বিষবাষ্পের আবাদের সুবিধার্ধে তৈরী করা হয়েছে ৫৭ ধারার আইন। অথচ এই আইনে বেশিরভাগ জেল-গুমে হারাচ্ছে বিরোধী চিন্তার লোকজন। সলিমুল্লার মতো বহুরূপী মুখোশধারী বুদ্ধিজীবি ইনিয়ে বিনিয়ে প্যান-আরবের স্বপ্ন আমদানী করে তার সাফাই দেবে।
এটা এমনই এক দুষ্টচক্র যা থেকে সহসা মুক্তি মেলবে না। কারন আপনি আমি যতদিন অর্থনৈতিক মুক্তি না পাবো ততদিন এই ফ্যাসিবাদী চিন্তাভাবনার সমালোচনা চায়ের কাপের ধোয়ার সাথেই মিলিয়ে যাবে। তারপর ঘরে এসে ফেসবুকে ভাস্কর্যের পক্ষে স্বপক্ষে হাদিস কোরানের আয়াত নিয়ে কামড়া কামড়ি শুরু করে দেবো। আমদের জীবনমান আরো কমতে থাকবে!
তাই বলা যায় বিজ্ঞান দিয়ে ধর্ম দূর করা যেমন একটা ভ্রান্ত ধারনা তেমনি উন্নত সমাজ ব্যাবস্থা মানেই যে ধর্ম হীনতা সেটাও ভুল। কদিন আগে কোথায় যেন দেখেছিলাম কল্যানমূলক রাষ্ট্রের তালিকায় ইসরাইল শীর্ষের দিকে। আমাদের পেটে পীড়া হলেই ভারতে লাইন দেই, যাদের একটু টাকা আছে তারা এখন যাচ্ছি থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর। কদিন আগেই তো কোরোনার মধ্যে আমাদের এক পরিচিত থাইল্যান্ড ঘুরে আসলেন। অথচ নামের সাথে আলহাজ্ব, নিজের দুটো ক্বওমী মাদ্রাসা ও এতিমখানা।
এটাই তো হৃষ্টপুষ্ট চেতনা!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ১:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




