পত্রিকার পাতাগুলোতে প্রতিদিন ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় গড়ে চার-পাঁচটা ধর্ষণের খবর পড়তে হয় ৷ প্রতিটা ধর্ষণের খবর পড়ি আর অজান্তেই আঁতকে উঠি ৷ চোখ বন্ধ করে নিজেকে একবার ধর্ষক আরেকবার ধর্ষিতা হিসাবে কল্পনা করি ৷ ধর্ষকের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, নিম্ন মানসিকতা, হিংস্রতা, পশুত্বপূর্ন আগ্রাসী মনোভাব আর ধর্ষিতার করুণ আকুতি, চিৎকার- চেঁচামেচি, নিজেকে সুরক্ষিত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, ভয়ার্ত কন্ঠ, কম্পমান দেহ , অসহায় ও অশ্রুসিক্ত মুখমন্ডলের দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে ৷ নিজেকে মানুষ হিসাবে পরিচয় দিতে ঘৃণা হয় ৷ সত্যিই কি আমরা আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব? মনে তীব্র সন্দেহ জাগে !
:
ধর্ষণ নিঃসন্দেহে একটি অমানবিক কাজ ৷ যেখানে এক বা একাধিক পুরুষ কোনো নারীর ওপর তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিনা সম্মতিতে জোর-পূর্বক, ভয়ভীতি প্রদর্শন অথবা ছলনার আশ্রয় নিয়ে সঙ্গমে লিপ্ত হয় । অন্যভাবে বলতে গেলে ধর্ষণ বলতে বুঝায়, “বেআইনী ভাবে কারো মতের বিরুদ্ধে তার শরীরের যৌনাঙ্গ সমূহের ব্যবহার”। মূলত ধর্ষণ হচ্ছে একপ্রকার আগ্রাসন এবং সহিংস অপরাধ। নারীর ওপর পুরুষের চরম আধিপত্যের জ্বলন্ত উদাহরণ ধর্ষণ । মনে রাখতে হবে যে, ধর্ষণ বলতেই সেখানে জোর জবরদস্তি এবং অসম্মতি থাকতে হবে ৷ এই দৃষ্টিতে পরস্পরে সম্মতির ভিত্তিতে সেচ্ছায় যৌন মিলনে লিপ্ত হলে তাকে ধর্ষণ বলেনা বরং যিনা-ব্যভিচার বলা হয় ৷ তবে এসব বিষয়েও ভূক্তভোগীকে ধর্ষণের মামলাই করতে হয়, কেননা যিনা-ব্যভিচার বিষয়ে আমাদের দেশে সুষ্পষ্ট আইন নেই ৷
:
সাধারণ অর্থে ধর্ষণ বলতে আমরা পুরুষ কর্তৃক জোর পূর্বক নারীর দেহ ভোগ করা বুঝি ৷ কিন্তু পুরুষও নারী কর্তৃক ধর্ষিত হতে পারে তা অস্বীকার করার উপায় নেই ৷ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে যদিও নারীরাই ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকেন, তবে পুরুষও ধর্ষনের শিকার হয়ে থাকেন যদিও তাদের পরিমান খুবই নগন্য ৷ ধর্ষিত মানুষের মাঝে অন্তত ৭% থেকে ১০% পুরুষ! কেননা, যৌন আকাঙ্খা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ৷ পুরুষের ন্যায় নারীরাও কখনও কখনও বেপরোয়া হয়ে উঠেন ৷ সঙ্গমে বাধ্য করতে না পেরে নারী যখন পুরুষের বিশেষ অঙ্গের উপর পৈশাচিক আক্রমন করে বসেন এবং তাকে সঙ্গমে বাধ্য করেন, তখন এটাকে আমরা নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণ বলতেই পারি ৷ তবে প্রগতিশীল গন এ বিষয়টা মেনে নিতে অস্বীকার করেন ৷ কেননা, বাংলাদেশী প্রচলিত আইনে নারী কর্তৃক ধর্ষিত হবার মামলা প্রচলিত নেই বললেই চলে ৷ তবে একথা সত্য যে, পুরুষ কিংবা নারী যেই ধর্ষিত হোক না কেন 93% ক্ষেত্রে পুরুষই ধর্ষকের ভুমিকায় দেখা যায়।
:
ধর্ষণ একটি বিতর্কিত বিষয় ৷ সাধারণত নারীর অশালীন পোষাক এবং পুরুষের বিরোপ দৃষ্টিভঙ্গিকে ধর্ষণের কারণ হিসাবে দায়ী করা হয় ৷ আর এ দুটোর যে কোন একটিকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই বিতর্কের সৃষ্টি হয় ৷ অনেকেই মনে করেন ধর্ষণের জন্য নারীর অশালীন পোষাক এবং আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গিই দায়ী, যা ধর্ষনকারীকে অপরাধটি করতে উৎসাহী করে ৷ তারা পুরুষের বিরোপ দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করেন না ৷ অথচ শালীন পোষাক পরিহিতা রমনী , শিশু এমনকি বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষণের স্বীকার হয়েছেন অনেকবার ৷ তাই শুধুমাত্র নারীর অশালীন পোষাককে দায়ী করে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে পাশ কাটিয়ে যাবার সুযোগ নেই ৷ আবার আরেক দল ধর্ষণের জন্য পুরুষের বিরোপ দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করেন, যার ফলে ধর্ষনের মত জঘন্য একটি অপরাধ ঘটে থাকে ৷ তারা নারীর অশালীন পোষাক এবং আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গিকে দায়ী করেন না ৷ অথচ মেডিকেল সাইন্সে এটা প্রমানিত যে , পুরুষের যৌন কামনা অনেকটাই বাহ্যিক কতগুলো যৌন উপকরনের দৃশ্যাবলীর উপর নির্ভর করে ৷ সৃষ্টিগত ভাবে নারীরা তাদের যৌন কামনাকে প্রমশিত করতে পারলেও পুরুষের পক্ষে তা সম্ভব হয়না ৷ তাই শুধুমাত্র পুরুষের বিরোপ মনোভাবকে ধর্ষণের জন্য দায়ী করে নারীর অশালীন পোষাক কেও পাশ কাটিয়ে যাবার সুযোগ নেই ৷
:
উপরের দুটি বিষয়কে সমন্বয় করে আমি বলতে পারি যে, ধর্ষণের জন্য নারীর অশালীন পোষাক এবং পুরুষের বিরূপ মনোভাব কোনোটাই এককভাবে দায়ী নয় ৷ একটা প্রবাদ আছে ," সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস অসৎ সঙ্গে স্বর্বনাশ " ৷ বিবেকবান ব্যক্তি মাত্রই আমার সাথে একমত হবেন যে, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব , যৌনতা বিষয়ে অজ্ঞতা , মাদকের ছড়াছড়ি, বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রসার, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা , সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, প্রশাসনিক দুর্বলতা , রাজনৈতিক শক্তির অপব্যবহার, অশ্লীল নাটক সিনেমার প্রসার সহ পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, ছেলে মেয়েকে উপযুক্ত সময়ে বিয়ে না করানো, আইনের প্রয়োগে বাধা সহ উপযুক্ত বিচারকার্য সম্পাদন না করা , অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, সহ নানাবিধ কারনে আমাদের দেশে ধর্ষণ ব্যাপকতা লাভ করেছে ৷ অর্থ্যাৎ ধর্ষণ সংঘঠিত হবার পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে ৷
:
একটু সচেতন হলেই আমরা ধর্ষক কিংবা ধর্ষিতা হওয়ার হাত হতে নিজেকে রক্ষা করতে পারি ৷ যেমন:
* বিপরীত লিঙ্গের কেউ কোনো নির্জন স্থানে নিয়ে যেতে চাইলে তার কথায় কোনো নির্জন স্থানে যাওয়া যাবেনা ৷
* "কোন নির্জন স্থানে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থাকলে শয়তান তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে হাজির হয়” - তাই কোন গোপন স্থানে দেখা করা থেকে বিরত থাকতে হবে , এমনকি নারী কিংবা পুরুষটি বিস্বস্থ হলেও।
* এমন কোনো ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক রাখা যাবে না, যে চরিত্রহীন এবং সুযোগ সন্ধানী।
* সংযত এবং সচেতন থাকতে হবে , শারীরিক মিলনের প্রশান্তিই জীবনের সবকিছু নয়।
* সন্মান হারালে তা ফেরত পাওয়া যায়না । অন্য কেউ না জানলেও প্রিয়জন দ্বারা ধর্ষিত হবার পর নিজের প্রতি ঘৃনাবোধ কাটিয়ে উঠা যায়না ৷
* কোথাও ঘুরতে গেলে অনেক বন্ধু বান্ধবের সাথে যেতে হবে এবং একজন আরেকজনের প্রতি নজর রাখতে হবে ৷
* আইনী সহায়তা কিংবা লোক লজ্জার ভয়ে নিশ্চুপ থাকা যাবেনা ৷ ধর্ষনের হুমকিতে পড়লে গর্জে উঠতে হবে ৷
* অত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে কারাতে শিখতে হবে ৷
* সাইড ব্যগে বোতল ভর্তি মরিচের গুড়া কিংবা গুড়া মিশ্রিত পানি রাখতে হবে ৷
:
দুর্ভাগ্যবশত ধর্ষনের শিকার হলে নিন্ম লিখিত বিষয়সমুহ অনুসরণ করতে হবে ৷ যেমন:
* শারীরিক আঘাতপ্রাপ্ত হলে দ্রুত হসপিটালে যেতে হবে । অনেক হসপিটালে ধর্ষিতা নারীর বিশেষ সহায়তার জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ডাক্তার থাকেন।
* ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিংবা পরিবারের অন্য কোন সদস্যের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করতে হবে ৷ যাদেরকে নিরাপদ মনে হয় এবং বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনা করতে হবে ।
* আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে হবে ৷
* কোন প্রকার আঘাতের চিহ্ন মুছে ফেলা যাবেনা ।
* ধর্ষিত হবার পর নিজেকে সংযত রাখতে হবে ৷
* ঘটনার যতটুকু মনে পড়ে তা বিস্তারিত লিখে রাখতে হবে ৷
* সীদ্ধান্তহীনতায় ভোগলে নিকটস্থ মানবাদিকার সংঘঠনে যোগাযোগ করতে হবে ৷
:
ধর্ষন প্রতিরোধে আমাদের যা যা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে -
* পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে ৷
* যৌনতা বিষয়ে মানসম্মত পুস্তক পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং সকলকে প্রতিরোধে প্রশিক্ষণ দিতে হবে ৷
* মাদকতা বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি বিজাতীয় অপসংস্কৃতি দূর করতে হবে ৷
* নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করে সর্বত্র সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে ৷
* প্রশাসন কে আরো কার্যকর হতে হবে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে ৷
* চলচিত্রে অশ্লীলতা দূর করতে হবে ও সুস্থধারার চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে ৷
* বেকারত্ব দূর করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে ৷
* উপযুক্ত বয়সে ছেলে মেয়েকে পাত্রস্ত বা কন্যাস্থ করতে হবে ৷
* আইন বিভাগের স্বাধীনতা প্রদান করে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে ৷
:
পরিশেষে বলতে পারি , আমাদের দেশের পুরুষরা যেন কলঙ্কের উর্দ্ধে ! একজন নারীর একমাত্র অবলম্বন তার ইজ্জত! সেই ইজ্জত নষ্ট করে পুরুষটির মনে বিন্দু মাত্র অপরাধ বোধ দেখা যায়না । সব ধর্ষনের খবর হয়তো আমরা শুনিনা বা পড়িনা এবং সঠিক বিচার হয়না । কিন্তু দয়াময় প্রভুর কাছে কি এসব গোপন থাকবে বা তিনি কি একদিন সুবিচার করবেন না ?
আসুক ধর্ষণ প্রতিরোধে আমি আপনি সকলে ঐক্যবদ্ধ হই ৷

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




