somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুখো স্বীকৃতি

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১০:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


২৫শে জানুয়ারি, ২০১৯; শুক্রবার। শুক্রবার মানেই অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাবো সবসময় এইরকমই প্ল্যান থাকে আমার। আমরা যারা শহুরে—প্রাইভেট চাকরি করি, তাদের জন্য শুক্রবার মানে ঘুমের আয়েশের দিন। ছুটির দিন। অথচ, বরাবরের মতো আজও সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যায় আমার। বিগত রাতের জল আর জলের পাতাল থেকে পৃথিবীর পরিচ্ছন্ন প্রাতে—প্রগাঢ় বায়ুমন্ডলে উঠে আসে আমার নাসিকা। আমি শ্বাস নিই। আমি চোখ খুলি। দেখি যে, ঘন-ঘোর অন্ধকার হঠাৎ-ই মিশে যায় এসে—প্রসন্ন ভোরে—প্রচ্ছন্ন আলোয়।

মাথার পাশেই সেলফোনে জ্বলে-ওঠা মেসেঞ্জার নটিফিকেশান। প্রিয় বন্ধু এমদাদ রহমান। বারান্দায় বাজিগারের কিচিরমিচিরে মনে পড়লো আরও একটা পাখি আছে আমার। মাঝেমাঝে ডানা ঝাপটায়। মিষ্টি গলায় ডাকে। রাজ্যের ঔৎসুক্য তার চোখে ও চলনে। আমি সেই পাখির দিকে মাথা উঁচু করে একবার তাকাই; তারপর মেসেঞ্জার ওপেন করি।

'ফেসিয়াল রিকগনিশান’। প্যারিস রিভিউ থেকে রানা দাসগুপ্তের একটি ক্ষুদে-গল্পের লিংক পাঠিয়েছেন এমদাদ। বললেন অনুবাদ করে দিতে হবে। রানার কোনো গল্প আগে পড়া ছিল না আমার। নামও শুনিনি। নামটা বাঙাল বাঙাল কিন্তু লিখা ইংলিশে! এমদাদ বললেন, ‘বাঙাল, তবে, অভিবাসী লেখক। তাঁর ভাষা ইংরেজি।’ জেনে খুব একটা ভালো লাগলো না আমার। বললাম, ’ঠিক আছে, ঘুম থেকে উঠি অাগে—মানে বিছানা ছেড়ে আর-কি..।’

অভিবাসী হয়ে নিজের মাতৃভাষাকে কেন ভুলে যেতে হবে আমার বোধগম্য হয় না। যে ভাষার জন্য জীবন দেয়ার গৌরব আছে আমাদের সে আমি কেন অন্য ভাষায় লিখতে যাবো! আর এক সপ্তাহ পর শুরু হবে ভাষার মাস। শুরু হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। তবে কি আন্তর্জাতিক রিকগনিশান পেতে চেয়ে এই ইংরেজি? ভাবছিলাম মধুসূদন দত্তের কথাও। এমদাদ বললেন, ’না, ও ঝুম্পা লাহিড়ীর মতো।’ পরক্ষণে মনে হলো একেবারে অজানা কারও বিষয়ে এভাবে ভাবাটা বোকামির পর্যায়ে পড়ে। পড়তে হবে আগে। আসুন পড়ি—পাঠ করি—

মুখো স্বীকৃতি

মূল ইংরেজি: রানা দাসগুপ্ত
বাংলায় ভাষান্তর: আমি,—ঋতো আহমেদ


শেষ পর্যন্ত অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে খুব বেশি ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছিল শহরটায়। কেউ কেউ বাজে আর দুঃখজনক কাজেও জড়িত হয়ে পড়েছিল। বলতে গেলে, তখন সময়টাই ছিল অস্বাভাবিক। মজুরি আর বিনোদন-কে সুন্দর এক পদ্ধতি বানিয়ে বদলে দিয়েছিলাম আমরা; যেসব মানুষ পুরোনো মুদ্রায়‌ অভ্যস্ত ছিল—তাদের চেহারা লাল দেখতে পাচ্ছিলাম । কিন্তু তারপরও কেউ কেউ হয়তো ঈর্ষান্বিত হয়েছিল।

২.
আমাদের এই মুখো স্বীকৃতি প্রক্রিয়ায় সবচে বেশি যারা উপকার পাচ্ছিলেন তাদের মধ্যে, অন্তত উল্লেখযোগ্য বলা যায় প্লাস্টিক সার্জনদের। শুরুতে যেসব রোগী ক্যামেরাকে ফাঁকি দিতে চাইতো তাদের জন্যেই মন্ড-প্রোথিত-করণ তৈরি করা হোতো প্রকৃতপক্ষে। তারপর, পরবর্তীতে এটা ফ্যাশনে পরিণত হয়—যখন রাতের খাবারের আগে মানুষ তার মুখের ছাঁচ তৈরি করে নিতো, ঠিক যেমন চুলের বিন্যাস আর নাকের আকৃতির পরিবর্তন করতো সময়ের সাথে সাথে, সেইরকম।

৩.
এদিকে প্রজনন ক্ষমতার আশঙ্কাজনক হ্রাস বিষয়ে অবগত হয়ে, যারা যন্ত্রের সাথে যৌনসঙ্গম করবে তাদের উদ্দেশ্য শাস্তির বিধান আরোপ করলেন শহরের কাউন্সিলর মহোদয়। তবে, সে যাই হোক, যন্ত্র আর মানুষের আলাদা থাকার আচরণগত পরীক্ষা বিষয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন অবগত ছিল না, যার মাধ্যমে হাতে নাতে ওইসব জুড়িকে ধরবে। তারা অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করতে গিয়ে নির্বিচারে বহু মানুষের অঙ্গহানি করে ফ্যালে। ওইসব ধর-পাকড়ে কিছু মানুষ মারাও যায়। তারপরও তা চলতে থাকে, এক‌ইভাবে। আর বেচারা নিরপরাধ যন্ত্রেরা গরাদের পেছনে আটক থেকে থেকে একের পর এক সময় অতিবাহিত করে।

৪.
অতঃপর যখন প্রত্যেকটি ঘটনার সত্যতা উদঘাটিত হয়—সম্পূর্ণভাবে আর পর্যানুক্রমিক, সবার কাছেই এবং সবখানে—তখন সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় মিথ্যে। ফলশ্রুতিতে সমাজ‌ও একসময় শেষ হয়ে যায়।

৫.
হুইস্কি-দোকানের ইতিহাসবিদদের কোনো একজনের মতে, চলচ্চিত্র শিল্পে মনুষ্য শিল্পীর বিলুপ্তির পর থেকেই আসল পরিবর্তনের শুরু। সাধারণ মানুষ‌ও যে উচ্চতার শিখরে পৌঁছাতে পারে, অভিনয় শিল্পীরাই ছিলেন এর শেষ প্রমাণ; তাঁদের ছাড়া, আমাদের সম্পূর্ণ কৃতিত্বই অচল। সমস্ত কীর্তি হতাশায় রূপান্তরিত হয়—কিছুটা সঞ্চারিত হয় ক্রীড়ায়—আর কিছুটা থেকে যায় আমাদের হৃদয়কে এলোমেলো করতে। যদি চাও তো, হঠাৎ মুক্তি কিংবা উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতা—এইসব‌ই দেখতে পাবে আজ মানুষের চেহারায়।

***
গল্পটা শেষ করে নামটার দিকে আর একবার তাকালাম। ফেসিয়াল রিকগনিশান : রানা দাসগুপ্ত। কী অদ্ভুত গল্প! গল্পের চরিত্র ও ঘটনাগুলো কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমাকে স্তম্ভিত করে। দেখার ও কল্পনার আলাদারকম চোখ আছে লোকটার। অথচ, কি-কি-ই-না ভাবছিলাম আমি। শিরোনামের কী বাংলা করা যায় তবে? ফেস তো চেহারা আর রিকগনিশান? স্বীকৃতি? নাকি চেনা? বাংলায় তো একেকবার একেক রকম করে বলতে হয় একে। পাঁচটি অংশে বিভক্ত এই গল্প। ফিকশান। বুঝতে পারছি গতানুগতিক চিন্তায় ফেলে একে ভাবতে গেলে ভুল হবে আমাদের। গল্পটা একটা শহরের। যে শহরে মানুষ অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। বাজে আর জঘন্য কাজে লিপ্ত ছিল। অপরাধ ছেয়ে যাচ্ছিল সর্বত্র। মানুষ ছিল অসুখি। কিন্তু এগুলো তো অন্যরকম কিছু না। আমাদের অতি পরিচিতই সব।

হ্যাঁ, এর পরপরই আসছে চেহারা রিকগনিশানের কথা। নতুন এক পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ। অাসছে রোবটের কথা। নিঃসঙ্গ মানুষ যন্ত্রকে বেছে নিয়েছে সঙ্গি হিসেবে। আমরা সেক্স-রোবটের কথা জানি। কিন্তু এখনও জানি না এর পরিণতি। গল্পকার দাসগুপ্ত আমাদের কী ইঙ্গিত দিচ্ছেন তাহলে। মানব সভ্যতার কোন ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি কাড়ছেন?

আমরা মুখোশের কথা জানি। কবি মন্দাক্রান্তা সেনের মুখোশ নিয়ে দারুণ একটা কবিতা আছে। কবিতাটির নাম ‘অতিথি’।

এইমাত্র আমার ড্রয়িংরুমে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন।
কিছুক্ষণ গল্প করার পর
তিনি আমার হাতে একটা মুখোশ খুলে রেখে
জানালার ধারে গিয়ে দেয়ালে থুতু ফেললেন।
বাথরুমে গিয়ে হিসি করলেন, তবে দরজা না দিয়ে
তারপর হাতমুখ ধুয়ে মুখ মুছলেন পর্দায়—মানে,
যেটা মুছলেন তাকে আমি মুখই ভেবেছিলাম, কিন্তু
ভদ্রলোক এবার সেটাও খুলে রেখে
সোজা চলে গেলেন আমার শোয়ার ঘরে।
বিছানার চাদর উল্টে, খাটের তলায়, আলমারির পাল্লা খুলে
কী সব যে খুঁজতে লাগলেন তিনিই জানেন।
আমি সবে জিজ্ঞেস করতে যাবো ভাবছি,
তখনই তিনি খুলে ফেললেন তৃতীয় মুখোশটাও।
মেঝেতে বসে পড়লেন হাঁটু ভেঙে, দু’হাতে মুখ ঢেকে।
তাঁর শরীর কাঁপছে থরথর করে...কোনওক্রমে মুখ, হ্যাঁ, মুখ—
মুখ তুলে বললেন : ক্ষমা করো।
আমি স্পষ্ট দেখলাম সেই মুখ কান্নায় ভেসে যাচ্ছে…

কিছুক্ষণ কাঁদার পর বিদায় নিলেন তিনি।
হাতে তিনতিনটে মুখোশ নিয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম
ভদ্রলোক হেঁটে যাচ্ছেন রাস্তা দিয়ে,
তাঁর মাথার পিছন দিকে অন্য একটা মুখ,
নাকি
মুখোশ...

যন্ত্র;—যন্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা অনুর্বর করে তুলছে মানুষকে। মানুষ আর যন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য করা যাচ্ছে না। গল্পটির ৩য় অংশে দেখতে পাচ্ছি এই ভয়াবহ পরিণতির কথা বুঝতে পেরে আইন করে ব্যবস্থা নেয়া হলেও শৃঙ্খলা বাহিনীর মূর্খতায় তা ভেস্তে যায়। তারপর আসে ৪র্থ অংশ। কী অদ্ভুত কথা—সত্যের উদঘাটনে মিথ্যের অন্তর্ধান। আর মিথ্যের অন্তর্ধান মানেই মনুষ্য সমাজের বিলুপ্তি। তাহলে কি সমাজে মিথ্যের উপস্থিতিটাও প্রয়োজনীয়?

সত্য আর মিথ্যের সহাবস্থান— '-নয়’ আর ’অভিনয়’—এইসবের মধ্য দিয়েই মানুষের সত্যিকার প্রতিভার উৎকর্ষ সাধন হয়। গল্পের সমাপ্তিটা সুন্দর। লেখক একটি আশার কথা বলেন আমাদের। উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতা আর মুক্তির কথা বলেন। অল্প কিছু বাক্যে কী চমৎকার গল্পের পাঠ! আরও পড়তে হবে রানা দাসগুপ্ত-কে। যদি বাংলায় লিখতেন কী ভালোই-না হোতো।

আমার পাখিটা ডাকছে। দারুণ মিষ্টি গলা। ভাবছি কথা শেখাবো ওকে। বাংলায়।।

ছবি : সালভাদর দালি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:৪৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×