somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লাদাখ ভ্রমনঃ(৮ম পর্ব) – লেহ এর পথে-স্বপ্নযাত্রার পূর্ণতা

১১ ই জুন, ২০১৭ রাত ৮:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লাদাখ ভ্রমনঃ(৭ম পর্ব) – হিমাচলের ছোট কিলং শহরে

লাদাখ ভ্রমণ - সবগুলো পর্ব

ঘুম থেকে যখন উঠলাম ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। বারান্দায় গিয়ে দাড়িয়ে ডানে পাহাড়ের দিকে তাকাতেই চোখ ধাধিয়ে গেল। সূর্যের আলো পাহাড়ের চুড়ার উপর পরে পর্বতচূড়া ঝলমল করছে। ভিতরে অন্যরকম এক উত্তেজনা কাজ করছিল। কারণ আজ লেহ শহরে পৌঁছে যাব, যেতে হবে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার এর বেশি। ড্রাইভার আগের রাত এ বলছিল যে যদি সকাল ৭ টার মধ্যে রওনা দেই তাহলেও লেহ পৌঁছাতে রাত ৯ টা বাজবে। তাই বাকি দুইজন সকাল থেকে এমন তাড়াহুড়ো করা শুরু করল যে, ৭ টার আগে রওনা না দিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আমি ব্যাগ গুছিয়ে ওদেরকে রেডি হতে বলে নিচে গেলাম, খাবার কিছু পাওয়া যায় কি না খোঁজ নিতে। কিন্তু এত সকালে কোনও দোকানপাট খোলা নাই। এদিকে হোটেল এর রেস্টুরেন্ট ও খুলে নাই। অতএব নাস্তা না করেই আমরা রওনা দিলাম। সকালে নাস্তা না করার পরিণতি আমরা পরে টের পেয়েছিলাম।

কিলং কে বিদায় বলে আমরা সকাল ৭ টায় লেহ এর উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলাম। রৌদ্রোজ্জ্বল সকালের পুরো ফায়দা ড্রাইভার নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে, অর্থাৎ প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে লেহ এর উদ্দ্যেশ্যে। যদি আবার আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়, এই জন্য আমরাও কিছু বললাম না, কারণ যেতে হবে ৩৫০ কিলোমিটার।

গাড়ির সামনের সিট এ কে বসবে এটা নিয়ে আমার আর সোহাগ এর মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি ছিল, দুই ঘণ্টা আমি সামনে বসলে পরবর্তী ২ ঘণ্টা সোহাগ এর জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হত। সেই হিসেবে আমি এবার বসলাম পিছনে ডান দিকে। ফলাফল আমি সব থেকে ভাল ভিউ পেলাম। কারণ রাস্তার বাম পাশে ছিল পাহাড়, ডানে ভাগা নদী, আর পাহাড় একসাথে। ৩০ মিনিটের মধ্যে আমরা জিস্পা পৌঁছে গেলাম, ওদেরকে বললাম এখানে নাস্তা করে নেই, কিন্তু কেউ ই নাস্তা করতে রাজি হল না। অগত্যা গাড়ি না থামিয়ে আমরা চলতে থাকলাম। জিস্পা তে কেন থাকার জন্য সবাই বলতেছিল তা বুঝতে পারলাম। এখানে নদীর পাশে সমতল একটা জায়গায় টুরিস্টদের থাকার জন্য অনেক তাবু আছে। আর স্রোতস্বিনী একটা নদীর পাশে তাবুতে রাত এ থাকার অনুভূতি অন্য আর দশটা রাত এর থেকে আলাদা হবে, এটাই স্বাভাবিক।








দারচাতে ভাগা নদীর আশেপাশে

যতই সামনে আগাই ততই মুগ্ধ হই। আরও আধা ঘণ্টা পর আমরা একটা ব্রিজ এর কাছে পৌঁছে গেলাম। ব্রিজ পার হলেই দারচা জনপদ। ব্রিজ এ উঠার আগে দেখলাম কয়েকটা তাবু এবং অস্থায়ী খাবার এর দোকান। জানতে পারলাম যে অনেকে এই তাবু গুলোতেও রাত কাটায়। বিশেষ করে যারা মোটর বাইক এ করে এই পথ এ যায়। আমি আবার সবাইকে নাস্তা করার জন্য বললাম, কিন্তু এবার ও কেউ রাজি হল না। তাই আমি একাই নাস্তা করতে নামলাম, কিন্তু কোনও দোকানেই নাস্তা পেলাম না, সবাই বলল যে আধা ঘণ্টা দেরি হবে। আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না। তাই আবার রওনা দিলাম।

দারচা পার হয়ে আমরা আবার পাহাড়ের উপরে উঠতে থাকলাম। এসময় রাস্তা খুব খারাপ ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তা এতই খারাপ ছিল যে দেখলাম রাস্তায় একটা ট্রাক এর চাকা ফেসে গেছে। তাশি নেমে অনেকক্ষণ দেখে তারপর ঐ অংশটা পার হল। কিছুদূর পর আমরা পাতসিও নামে একটা সুন্দর লেক এর পাশে এসে পউছালাম। এখানেও দুইটা খাবার দোকান দেখতে পেয়ে আবার নাস্তার কথা বললাম, কিন্তু কেউ ই আগ্রহ না দেখানোয় মেজাজ বিগড়ে গেল। আমিও আর নামলাম না। ওদের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যে নাস্তা করলেই দেরি হয়ে যাবে আর সন্ধ্যার আগে লেহ পৌঁছানো যাবে না।


পাতসিও তে ছোট একটা লেক

পাতসিও এর পরে রাস্তা আবার ভাল হওয়া শুরু করল। তাশিও মনের সুখে গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিল। এখানে এসে আবার আঁকা বাঁকা রাস্তা শুরু হল। দূরে কিছু পাহাড়ের চূড়ায় অল্প বরফ জমে আছে, আমি মনে মনে ভাবতেছিলাম যে কখন আমরা রাস্তার দুই পাশে বরফ দেখতে পাব। যখন আমরা রাস্তার এক বাঁক থেকে উপরের বাঁক এ উঠছিলাম নিচে তাকালে ফেলে আসা রাস্তা দেখতে পারতেছিলাম, যেন স্বপ্নের কোনও রাস্তা। এই সময় সোহাগ এর খারাপ লাগতেছিল এবং বারবার তাশি কে বলতেছিল গাড়ি ধীরে চালাতে। এরকম প্রায় পাঁচ-ছয় বার বলতে হইছিল তাশি কে। একটা সময় হঠাৎ করে আমি রাস্তার পাশে একটা চেকপোস্ট দেখে তাশিকে জিজ্ঞেস করলাম যে এইটা কি? ও বলল যে এটা বারালাচা পাস। কখন যে এত উঁচুতে চলে এসেছি বুঝতেই পারি নাই। বারালাচা পাস এর উচ্চতা ১৫৯০৮ ফুট। কিন্তু আমি খুব ই হতাশ হলাম, কারণ রাস্তায় বরফের কোন চিহ্ন ও নাই, এমনকি দূরে পাহাড়ের চূড়ায় অল্প বরফ বাদ এ আর কোনও বরফ এর দেখাও পেলাম না। অথচ ওদেরকে বলেছিলাম যে পথে অনেক বরফ এ ঢাকা রাস্তা থাকবে।










বারালাচার পথে


পিছনে ফেলে আসা রাস্তা

আমি গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলতে গেলাম। আমার পিছনে সোহাগ ও নামলো প্রকৃতির ডাক এ সাড়া দিতে। কিন্তু প্রকৃতির ডাক এ সাড়া দেয়ার পর ও বমি করল। একে তো সকাল থেকে না খেয়ে আছে, তার উপর গাড়ি এই পাহাড়ি রাস্তায় এত উচ্চতায় দ্রুত চলার কারণে অর শরীর খারাপ লাগছিল। এখানে আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। আমরা সাথে করে কিলং থেকে খুবানি নিয়ে এসেছিলাম, একটু টক জাতীয় ফল। এটা খাওয়ার পর সোহাগ একটু সুস্থ হল। আমরা তখন কয়েকটা ছবি তুলে রওনা দিলাম। সামনে আগালে বরফ পাওয়া যাবে এই আশা নিয়ে গাড়িতে উঠলাম।






বারালাচা পাস

সোহাগ আর খোকন মাথা ব্যাথা নিয়ে দুইজন ই চোখ বন্ধ করে ছিল, আমি একাই দুই পাশের দৃশ্য দেখতে থাকলাম। আপাত দৃষ্টিতে সেই একই পাহাড় আর রাস্তা মনে হলেও প্রতিটি পাহাড়ের ভিন্ন ভিন্ন একটা রুপ আছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখলেই এর ভিন্নতা চোখে পরে। কিছুদূর পর আমরা ক্রমান্বয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। এভাবে এক সময় কিলংসারাই নাম এ একটা সমতল ভুমিতে পৌঁছে গেলাম। উপর থেকে নিচের এই সমতল টা দেখতে ছবির মত মনে হচ্ছিল। নামার সময় অবশ্য আরও একটা দৃশ্য দেখেছিলাম, যা ভয় পাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট। একটা গাড়ি দুমরে মুচরে পরে ছিল রাস্তার পাশে। এবং গাড়িটাকে বেশি পুরনো মনে হয় নাই। এটা দেখে আমি একটু আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম, কিলংসারাই এর সমতলে নামার পর সেই আড়ষ্টতা কমেছিল।











কিলংসারাই থেকে সারচু পর্যন্ত রাস্তা প্রায় একই লেভেল এ চলে। অর্থাৎ পাহাড়ি কোনও পথে উঠতে বা নামতে হয় না। ফলাফল আবারও তাশির নিড ফর স্পীড খেলা শুরু। তাশি যে কতটা স্পীড এ গাড়ি চালিয়েছে টা শুধু একটা তথ্য দিলেই বুঝা যাবে। আমরা এই রাস্তায় প্রায় ২০-৩০ টার মত গাড়িকে ওভারটেক করে ফেলেছি এতক্ষণে। আমরা যখন সারচু গিয়ে পৌছালাম তখন প্রায় পৌনে ১২ টা বাজে। সেখানে গিয়ে দেখলাম যে গাড়ি ঘুরিয়ে দিচ্ছে। কারণ ছিল এখানে চু নদীর উপর একটা ব্রিজ আছে আর ঐ ব্রিজ এ একটা ট্রাক নষ্ট হয়ে রাস্তা আটকে গেছে। প্রথমে ভাবলাম হয়ত যেতে দিবে না, পরে তাশি কথা বলে আসল যে, একটু ঘুরে নদীর উপর দিয়ে পার হতে হবে। আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে যখন অন্য পথে নদীর পাড়ে আসলাম, ততক্ষণে ঐখানে যানজট লেগে গেছে। আমরা দূর থেকে দেখতেছিলাম এক একটা গাড়ি নদীর উপর দিয়ে কিভাবে পার হচ্ছে। নদী বললে আসলে ভুল ধারণা হতে পারে। আসলে পাহাড়ি নদী মানেই একটা তীব্র স্রোতধারা। আর এটা মুল নদী ছিল না, একটা ছোট শাখা।




আমরা এইটা পার হতে গিয়েই আটকা পরেছিলাম

আমাদের গাড়ির ঠিক তিনটা গাড়ি আগে একটা হোন্ডা সিটি গাড়ি সেই স্রোতের মাঝে পাথরে আটকে গেল। অবশ্য মিনিট দুই এর মধ্যে গাড়িটার বারোটা বাজিয়ে নদী ক্রস করতে সক্ষম হল। আমাদের গাড়ির পালা এল, কিন্তু যা ভয় পাচ্ছিলাম তাই হোল। স্রোতের মাঝে গাড়ি আটকে গেল। তাশি একবার সামনে যায় আবার পিছনে যায় কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। এর মধ্যে অনেকেই এসেছে সাহায্য করতে। আমরা তিনজন ও জুতা মোজা খুলে প্যান্ট গুটিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। পানি এতই ঠাণ্ডা ছিল যে পানিতে নামতেই মনে হল কেউ চাবুক দিয়ে পায়ের উপর মারতেছে। এরপর আমরা তিনজন সহ আরও ৫-৬ জন মিলে গাড়ি পিছন থেকে পাশ থেকে ধাক্কা দিতে থাকলাম। কিন্তু তাতেও কিছু হয় না। এর মধ্যে দুই জন দুইটা বড় পাথর এনে পিছনের চাকার সামনে দিল। আমরা সবাই আবার ধাক্কা দিতে শুরু করলাম। এভাবে প্রায় ১৫ মিনিট এর প্রচেষ্টার পর আমরা সফল হলাম।

আমি এ পর্যন্ত অনেক জায়গায় ঘুরতে গিয়ে অনেকবার গাড়ি ঠেলেছি। কিন্তু সকাল থেকে কিছু না খেয়ে সারচু এর মত এত উচ্চতায়(সারচুর উচ্চতা ১৪০৭০ ফুট) কনকনে ঠাণ্ডা পানির উপর দাড়িয়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে গাড়ি ঠেলার এই অভিজ্ঞতা আজীবন মনে থাকবে। গাড়িতে উঠে পরে এটা নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতেছিলাম যে, এই ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যেও গাড়ি ধাক্কা দিতে হলো।






সারচু পার হয়ে লাদাখ এ প্রবেশ করলাম

সারচু হলো হিমাচল এর শেষ স্থান এবং এখান থেকেই জম্মু-কাশ্মীর এর লেহ এলাকা শুরু। একটা দোকানে আমি আর সোহাগ নুডলস, ডিম টোস্ট আর চা খেলাম। তখন দুপুর প্রায় সাড়ে ১২ টা, সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাবার মিলে এক হয়ে গেল। খোকন কে খেতে বললাম, কিন্তু কিছুই খেল না। না খাওয়ার ফলে সারাদিন ও নিস্তেজ হয়ে ঝিমাচ্ছিল। আমরা খেয়ে দেয়ে আবার রওনা দিলাম। এবার আমরা সারচু নদীর পাশ দিয়ে চলতে থাকলাম। রাস্তা সমতল হওয়াতে আবার আমরা নিড ফর স্পীড এর বেগ এ চললাম। একটা সময় আমরা পৌঁছে গেলাম গাটা লুপস এর শুরুর অবস্থানে। আমরা বিখ্যাত গাটা লুপ বেয়ে ওঠা শুরু করলাম। তাশি কে আবার সতর্ক করা হল গাড়ি ধীরে চালানোর জন্য। কিন্তু ব্যাটাকে বলার পর কিছু সময় ধীরে চালায় এবং ক্রমাগত স্পীড বাড়াতে থাকে। গাটা লুপ এও ৩ টা গাড়িকে ওভারটেক করেছিল।








বিখ্যাত গাটা লুপ


গাটা লুপ পার হওয়ার কিছুদূর পর ওনাদের ওভারটেক করেছিলাম, তারা স্কুটি নিয়ে এই পথে লেহ যাচ্ছিল

এক সময় আমরা গাটা লুপ এর চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। এখানে আমি আর সোহাগ গাড়ি থেকে নামলাম। কয়েকটা ছবি তোলার জন্য একটু হাঁটলাম। হঠাৎ করে আমার মাথা চক্কর দেয়া শুরু করল এবং নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি দ্রুত গাড়িতে গিয়ে বসলাম এবং দুইটা খুবানি, পানি, চকলেট খেলাম। মাথা চক্কর দেয়া একটু কমলো, কিন্তু মাথা ঝিম ধরে রইল। হঠাৎ করে এরকম হওয়ার কারণ পর অনুমান করলাম যে, গাটা লুপ এ ২১ টা লুপ অতিক্রম করে প্রায় ১৪০০ ফুট উপরে উঠতে হয়েছে। আর তাশি খুব দ্রুত উঠে যাওয়ায় শরীর নিতে পারে নাই। এছাড়া আমি গাড়ি থেকে নেমে একটু দ্রুত হেঁটেছিলাম ১৫০০০ ফুট উচ্চতায়। অবশ্য এগুলো আমার ধারণা, কিন্তু এই সাময়িক মাথা ধরা আমাকে দুই ঘণ্টা ভুগিয়েছিল। গাটা লুপ থেকে রওনা দেয়ার পর কতক্ষণ চোখ খুলে থাকি তো আবার কতক্ষণ ঝিমাই, এভাবে কখন যে নাকিলা পাস আর লাচুংলা পাস পার হয়ে গেছি তা টের পাই নাই। এরপর প্যাং নামক আর একটা অস্থায়ী জনপদ এ আসার পর তাশি আমাকে ডেকে তোলে।


প্যাং

প্যাং এর উচ্চতাও ১৫২৮০ ফুট, পথে মিস করেছি নাকিলা এবং লাচুং লা পাস। একে তো মাথা উঠাতে পারতেছিলাম না, তার উপর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এরপর যেন আর কোনও কিছু মিস না হয় এই জন্য অক্সিজেন এর সিলিন্ডার পাওয়া যায় কি না খুঁজলাম। কিন্তু পেলাম না। মেজাজ তখন অনেক খারাপ, সেই সাথে মাথা ঝিম করে বসে আছি, সাথে বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস তো আছেই। কি মনে করে যেন এক কাপ চা খেলাম। চা খাওয়ার পর মনে হলো একটু চাঙ্গা হলাম। ফলে আরও দুই কাপ চা নিলাম। মোট তিন কাপ চা খেয়ে মনে হল মাথা ঝিম অবস্থা ধীরে ধীরে কমতেছে। প্যাং থেকে আমরা রওনা দেই বিকাল পৌনে চার টার দিকে।





প্যাং হলো দুই পাহাড়ের মাঝের একটা উপত্যকা। এখান থেকে আবার আমাদের উপরে ওঠা শুরু হল। মিনিট পনের প্যাঁচানো রাস্তা বেয়ে উপরে ওঠার পর এই রাস্তার সব থেকে আকাংক্ষিত জায়গা মোর প্লেইন্স এ চলে আসলাম। এই জায়গায় আসলে আশ্চর্য হতে হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬০০০ ফুট উচ্চতায় ৪০ কিলোমিটার এর বেশি সোজা রাস্তা, যার কোথাও এতটুকু ভাঙা নাই। আমার জীবনে দেখা প্রথম মালভূমি, সে এক অসাধারণ অনুভূতি। তিন কাপ চা এর প্রভাব বেশ ভালই কাজ দিয়েছে, মাথার ঝিমঝিমানি বন্ধ হয়ে গেছে, সেই সাথে মনে হচ্ছে শক্তি ফিরে পাচ্ছি। তখন হঠাৎ মাথায় এল কোনও এক বইতে পড়েছিলাম যে, যখন এই রকম অবস্থা হবে তখন বেশি করে কথা বলতে হবে, হাসতে হবে। আমি খোকন আর সোহাগ কে খোঁচাতে শুরু করলাম। ব্যস সবার মুখে কথা ফুটে উঠল, একে অপরকে পচাতে শুরু করলাম এবং হাসি যে কত বড় ঔষধ তা সেদিন বুঝতে পারলাম।


নাম কি বলা লাগবে B-)

মোর প্লেইন্স এর রাস্তা টাকে স্বপ্ন মনে হতে লাগল। আমি স্বপ্নের ভিতর এক সোজা রাস্তায় ছুটে চলেছি, যার কোনও বাঁক নেই, যার কোনও শেষ নেই। দুই পাশে অনেক দূর সমতল থাকার পর পর্বতের চূড়া প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। সেই সাথে শ্রদ্ধা সেই সকল লোকদের প্রতি যারা এত কষ্ট করে এই রাস্তা তৈরি করেছেন। গাড়ির গতির কথা আর নাই বা বললাম, অনেক প্রথম এর মত ১০০ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলার অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল আর কি। এত গতির ফলেও মনে হলো যে রাস্তা শেষ হচ্ছে না। এক সময় রাস্তা পার করে আবার উপরে ওঠা শুরু করলাম। হাতের ডান পাশে পর্বতের গা ঘেঁষা রাস্তা, ডানে গিরিখাদ, পিছনে ফেলে আসা মোর প্লেইন্স এর মালভূমি, আমাদের স্বপ্নযাত্রা চলছে।


তাংলাংলা পাস- পৃথিবীর ২য় সর্বোচ্চ গাড়ির রাস্তা

আমরা সকল রাস্তা অতিক্রম করে তাংলাংলা পৌঁছাই বিকাল সাড়ে চার টার দিকে। আমি আর খোকন নিচে নামলাম না, সোহাগ গাড়ি থেকে নেমে ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে আবার ফিরে এল। তাংলাংলা থেকে নিচের দিকে নামার রাস্তাটাও আমার কাছে চমৎকার লেগেছে। এরপর রুমসে নামে একটা গ্রাম এ আমি চা বিরতি নেই। রাস্তার পাশের একটা রেস্টুরেন্ট এ হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ চা খেয়ে নিজেকে একদম সুস্থ মনে হলো এবং গাড়িতে গিয়ে আবার বকবক শুরু করলাম।


তাংলাংলা থেকে নিচে নামছি

আমরা একে একে রুমসে, জিয়া, মিরু এবং নাম না জানা আরও অনেক গ্রাম অতিক্রম করে চলে এলাম। এই গ্রাম গুলো অসম্ভব রকমের সুন্দর। এতক্ষণ যে পাহাড়গুলো ছিল তা ছিল ধূসর রঙের, কিন্তু এখানের কিছু পাহাড় আবার লাল রঙের। তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ি নদী যা প্রচণ্ড গর্জনে ছুটে যাচ্ছে সিন্ধু নদের সাথে মিলিত হতে। আমরা এক একটা গ্রাম পার হয়ে যাচ্ছিলাম আর প্রতিনিয়ত অবাক হচ্ছিলাম যে, পৃথিবী এত সুন্দর কেন? যখন উপসি নামক গ্রাম এ চলে এলাম, তখন ভিতরে অন্য রকম রোমাঞ্চ অনুভব করতে লাগলাম। কারণ যে সিন্ধু নদের গল্প এতদিন গল্প-উপন্যাস এ পড়েছি, সেই সিন্ধু নদের সামনে আমরা দাড়িয়ে আছি। আমি আরও শিহরিত হলাম যখন সিন্ধু নদের উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম।










উপসি যাওয়ার পথে গ্রামগুলো


শিহরণ জাগানো সিন্ধু নদ


উপসি থেকে লেহ পর্যন্ত রাস্তা প্রায় সমতল। তাশি মনের আনন্দে ১০০ কিলোমিটার এর উপরে গাড়ি চালানো শুরু করল। আমরা খুব দ্রুতই একে একে উপসি, কারু, থিকসে পার হয়ে লেহ শহরের প্রবেশদ্বার এ চলে এলাম।



ঐতো দেখা যাচ্ছে স্বপ্নের লেহ শহর!!!!!

লাদাখ ভ্রমনঃ(৯ম পর্ব) – লেহ শহরের অলস দিনগুলো এবং জীবনের অন্যতম একটা আনন্দের সংবাদ
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৭ রাত ১১:১৮
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×