somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ পর্ব ৩

১১ ই জুলাই, ২০২১ রাত ১০:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অমর ইতিহাসের স্বাক্ষী
অধ্যাপক ইউসুফ আলী
(জন্ম: ১৯২৩ - মৃত্যু: ১৯৯৮)
(১৯৯১ সালের সাক্ষাকারের ভিত্তিতে তৈরি)


প্রায় পাঁচ হাজার লোকের মূহুমূহ করতালিমুখর এক সকালে যখন এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করছিলাম, তখন আমার মধ্যে এক অভূতপূর্ব শিহরণ বোধ করছিলাম। কেন এই শিহরণ সংগত প্রশ্ন। শিহরণ এ কারণে যে, এ ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এক ঐতিহাসিক রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে। সেই ব্রাষ্ট্রের ঘোষণাপত্র পাঠ প্রছি আমি।

“-যেহেতু ১৯৭০ সনের ৭ ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ ই জানুয়ারী পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত করা হইয়াছিল— এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে আওয়ামি লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করিয়াছেন।
-এবং যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩ রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন এবং যেহেতু আহুত এই পরিষদ স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন
-যেহেতু উল্লেখিত বিশ্বাসঘাতকতা মূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
-এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছে এবং এখনো বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা নির্যাতন চালাইতেছে এবং যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হইয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিয়া জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে।
-যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর তাহাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যাণ্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যাটে মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করিষ্যা পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ গঠনের কথা ঘোষণা করছি .....।”
প্রায় পাঁচ হাজার লোকের মূহুর্মুহু করতালিমুখর এক সকালে যখন এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করছিলাম, তখন আমার মধ্যে এক অভূতপূর্ব শিহরণ বোধ করছিলাম। কেন এই শিহরণ? সংগত প্রশ্ন। শিহরণ এ কারণে যে, এ ছিল এক ঐতিহাসিক মুহুর্ত। একটি রাষ্ট্রের দন্ম হচ্ছে। সেই রাষ্ট্রের ঘোষণাপত্র পাঠ করছি আমি। আর ঘোষণা করাই তো শেষ কথা নয়। সামনে লড়াই। এই লড়াইয়ের ওপর সাড়ে সাতকোটি মানুষের বাচা আর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটি প্রথমে রচিত হয়েছিলো ইংরেজীতে। ঘোষণাপত্র রচনা করেছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং খোন্দকার মোশতাক আহম্মদ। পরে মঞ্চে বসেই আমরা এটিকে বালো করে নিই। মনে পড়ে তারিখটি ছিল '৭১ -এর ১৭ ই এপ্রিল। সকাল ন'টায় আমরা কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলায় সমবেত হই। এলাকাটি ছিল বিশাল আমবাগানে ঘেরা। চোকি দিয়ে মঞ্চ বানানো হয়েছে। সবুজ জমিনে লাল সূর্যের মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়ছিল।
আওয়ামী লীগ নেতা, কমী, আশপাশের এলাকা থেকে আগত লোকজন আর দেশী বিদেশী সাংবাদিক মিলিয়ে লোক ছিল প্রায় পাঁচ হাজারের মত। স্বাধীনতার সনদ পাঠ করার জন্যে আমার নাম ঘোষণা করা হলে আমি মাইকের সামনে গিয়ে দাড়াই। তখন শ্লোগান আর করতালিতে আকাশ - বাতাস বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছিল। সনদ পাঠ শেষে মন্ত্রীসভার নাম ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান মনোনীত করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। খোন্দকার মোস্তাক আহমদ আইন, সংসদ ও পররাষ্ট, কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র আর মনসুর আলীকে দেয়া হয় অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব। জেনারেল ওসমানীকে মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নিয়োগ করা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে। এরপরে মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার দেন।
স্বাধীনতার সনদ ঘোষণার পর আমরা অনুভব করলাম বাঙালি উদ্বাস্তুদের একত্রিত করা। প্রয়োজন সশস্ত্রযুদ্ধের তাগিদে। এজন্যে '৭১ -এর মে মাসের শেষের দিকে গঠন করা হয় “বোর্ড অব কন্ট্রোল ইয়ুথ ক্যাম্প। এর অফিস ছিল ৮ নং থিয়েটার রোডে। ইয়ুথ ক্যাম্প ছিল প্রায় ১০৩ টি। এই ক্যাম্পগুলো ছিল সুন্দরবনের কাছাকাছি হাসনাবাদ থেকে সাবরুম পর্যন্ত। এসব ক্যাম্পে প্রাথমিক, তাত্ত্বিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্যে পরে ৩০ টি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। এসব ক্যাম্পের পরিচালক ছিলেন জনাব ডঃ মফিজ চৌধুরী, শ্রী গৌরচন্দ্র বালা, ক্যাপ্টেন করিমউদ্দিন আর সেক্রেটারী ছিলেন নুরুল কাদের খান।
অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আওয়ামী লীগ নেতা, ১৯৭১। লেখাটি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০২১ রাত ১০:১৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দাসত্বের শিকল ভাঙার স্বপ্ন দেখা এক ক্রান্তদর্শী ধূমকেতু ওসমান হাদী।

লিখেছেন মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল), ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তাহলো বিদেশী প্রভুরদের দাসত্ব বরণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের উপর প্রভুত্ব করা , আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×