somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তেল বাজদের দখলে সব

২৪ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বর্তমান জমানায় তেল ছাড়া সবকিছু অচল। তেল আছে তো সব আছে, তেল নেই তো কিছু নেই। তেল ছাড়া কোনো কাজ হয় না। ভাজি-ভর্তা-ঝোল, জ্বালা-জ্বলা-উত্তাপ আর উন্নতি-অগ্রগতি-পদোন্নতি— সবকিছু নির্ভর করে তেলের ওপর।
বাদ আছে, কম তেলে মুচমুচে ভাজি হয় না। কিন্তু আমাদের এই তেল মারা, তেল দেওয়ার দেশের মানুষের স্বভাব হচ্ছে মুচমুচে ভাজি খাওয়া। কিন্তু তেল তো বাজার থেকেই হাওয়া। এ অবস্থায় মুচমুচে ভাজি কী করে হবে? নাকে তেল দিয়ে যে ঘুমাবেন, তেমন তেলেরও আকাল!
এদিকে ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল, চুলে বা শরীরে মাখার তেল, সব তেলেরই দাম চড়া। সরিষার তেলের দেখাদেখি সয়াবিন তেলও ডাবল সেঞ্চুরি করে বসেছে। পাম তেলেরও দাম বেড়েছে। সূর্যমুখী তেল, এমনকি নারকেল তেলেরও দাম বেড়েছে।
দেশে সামগ্রিক তেলসংকটে সমস্যায় পড়েছে সাধারণ মানুষ। অনেক বাড়িতেই ভাজাভুজি পদ কমিয়ে ফেলা হয়েছে। আনাজ বা মাছের ঝোলেও যতটা কম পারা যায়, তেল ঢালা হচ্ছে। মধ্যবিত্ত ভোজনরসিকেরা পড়েছেন বিপাকে।
শুধু তা-ই নয়, স্নানের আগে শরীরে খাঁটি সরিষার তেল মাখা যাঁদের স্বভাব, তাঁরাও এখন তেল ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন। আলুভর্তায় সরিষার তেল চটকানো যাঁদের অভ্যাস, তাঁরা এখন সরকারের পিণ্ডি চটকাচ্ছেন। তেল নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। ক্ষোভ, দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। নানা কারসাজি করে, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে যাঁরা লাভ করার, তাঁরা তা ঠিকই করছেন।
তেলের এত যে মূল্যবৃদ্ধি, সংকট, তাই বলে আমাদের দেশের মানুষের তেলবাজি, তেলমালিশ, তেলচর্চা কিন্তু থেমে নেই। তেল মারা, তেল দেওয়া চলছে বিরামহীনভাবে। এর কারণও আছে। এখন তেল ছাড়া কাজ হয় না। স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে তেল দেওয়া খুব জরুরি! নইলে প্রতিযোগিতামূলক ‘তেলের বাজারে’ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
যাঁরা বুক চিতিয়ে জোর গলায় বলেন, আমি তেল পছন্দ করি না, তেল মারতে পারি না, তাঁরা আসলে সত্য বলেন না। আসল ব্যাপার হলো, তিনি তেল মারা খুবই পছন্দ করেন, গোপনে তিনি তেল ঠিকই মাখেন, কিন্তু অন্যের তুলনায় তা যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয় না; কিংবা কোনো কারণে তেলে কাজ হয় না। তেলে কাজ না হলে আমরা খামোখাই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠি। তেলের ওপর ঝাঁজ মেটাই। তেলদাতাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করি। ‘তেল মারতে পারি না’ বা ‘তেল মারা পছন্দ করি না’−এ কথা বলা আসলে তেল মারার সুযোগ না পাওয়া বা তেল মেরেও কাজ না হওয়ার ব্যর্থতাজনিত ক্ষোভ বা রোষ। এটা আমাদের বুঝতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে। কাজেই মুখে যে যা-ই বলুক, আসলে আমরা প্রত্যেকেই কম-বেশি তেলবাজ। দক্ষতা আর কার্যকারিতার ঘাটতি থাকতে পারে। তাই বলে তেলবিমুখ কেউই নই।
চিররঞ্জন সরকারবর্তমান জমানায় তেল ছাড়া সবকিছু অচল। তেল আছে তো সব আছে, তেল নেই তো কিছু নেই। তেল ছাড়া কোনো কাজ হয় না। ভাজি-ভর্তা-ঝোল, জ্বালা-জ্বলা-উত্তাপ আর উন্নতি-অগ্রগতি-পদোন্নতি—সবকিছু নির্ভর করে তেলের ওপর। তেল ছাড়া বাতি জ্বলে না, গাড়ি চলে না, বিমান ওড়ে না, উনুন জ্বলে না, জীবনও চলে না। তেল বেঁচে থাকার অনিবার্য উপাদান, জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। তেলচর্চা, তেলের ব্যবহার ও পর্যাপ্ত তেল সংস্থানের ওপর নির্ভর করে মানুষের সাফল্য। তেল আছে বলে জীবন আছে। তেল ফুরিয়ে গেলে জীবনপ্রদীপও নিভে যায়।
তেল এখন শুধু আর রান্নার অনুষঙ্গ নয়, এটি আমাদের দেহ ও সমাজের একটি অঙ্গ। সময়টাই এখন তেলের। চারদিকে শুধু তেল আর তেল। একটু ভালোভাবে তাকালেই দেখা যায় সবার গা থেকে এখন ঘাম নয়, ফোঁটায় ফোঁটায় তেল ঝরছে। আমরা সবাই এখন একেকটি তেলের বিশাল বিশাল আধার। আর কিছু নয়, সর্বোৎকৃষ্ট জায়গায় কীভাবে এই তেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়, তা জানার জন্যই আমরা সবাই এখন হন্যে হয়ে ছুটছি। তেল মারতে মারতে একেকজনের গায়ের চামড়া তুলে ফেললেও আমরা ক্ষান্ত হই না। উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত খুঁজতে থাকি আর কাকে তেল মারা যায়। বর্তমানে তেলবিদ্যা যে যত বেশি আয়ত্ত করতে পারি, জীবনে সে ততটাই উন্নতি করি। আমরা বিশ্বাস করতে শিখি: তেলহীন বিদ্যা ফুটো পয়সার মতোই অচল।
আমাদের বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, অস্তিত্ব, সমাজ, সংসার, আকাশ, বাতাস, চাঁদ, জ্যোৎস্না, সূর্য এখন তেলনির্ভর হয়ে পড়েছে। অন্যকে ‘খুশি’ করতে কীভাবে তেল মারা যায় তার কায়দাকানুন জানতেই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তেলখেকো বাজারি কুকুরের গায়ে যেমন লোম থাকে না, সর্বত্র এভাবে তেল মারামারির ফলে আমাদের সমাজ-সংসারও আজ লোমহীন হয়ে পড়েছে। আমাদের বিচার-বুদ্ধিতে জট লেগেছে, মরিচা ধরেছে। তবু চলছে এই ‘খুশি করা’র বিদ্যার সর্বোচ্চ চর্চা।
এ প্রসঙ্গে একটি প্রাচীন উপকথা উল্লেখ করা যেতে পারে।এক গুরু আর তার শিষ্য। দুজনে মিলে ঘুরতে ঘুরতে এক অচেনা দেশে এসে হাজির। হঠাৎ গুরুর চটি ছিঁড়ে গেল। কাছেই এক চর্মকারের কাছে গিয়ে হাজির গুরু-শিষ্য। চর্মকার তখন ঘুমোনোর জোগাড় করছেন। মালপত্র তুলে ফেলেছেন। গুরু বললেন, ‘ভাই, চটিটা একটু সেলাই করে দাও। তোমাকে আমি খুশি করে দেব।’ চর্মকার সেই কথা শুনে মন দিয়ে ছেঁড়া চটি সেলাই করে দিলেন। গুরু তাঁকে একটা টাকা দিলেন। চর্মকার বললেন, ‘ওই যে বললে খুশি করে দেবেন। খুশি তো হলাম না।’ গুরু দুই টাকা দিলেন। চর্মকার বললেন, ‘না ভাই। হচ্ছে না।’ গুরু হেসে ১০ টাকা দিলেন। চর্মকার বললেন, ‘খুশি খুশি ফিলিংসই তো হচ্ছে না!’ গুরু ১০০ টাকা দিলেন। চর্মকার মাথা নাড়েন। গুরু ২০০ দিলেন। চর্মকার করুণভাবে বলেন, ‘বুঝতে পারছি, আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু স্যার, আমার মোটেই খুশি খুশি লাগছে না।’ গুরু তখন হতাশ হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে ওগুলো ফেরত দাও। আর আমাকে এক সপ্তাহ সময় দাও। আমি ঠিক তোমায় খুশি করে দেব।’ চর্মকার হাতজোড় করে গুরুকে বিদায় দিলেন। এর দু-তিন দিন বাদে এক গভীর রাতে গুরু-শিষ্যের বাড়িতে এসে রাজার পেয়াদা কড়া নেড়ে দরজার বাইরে থেকে চিৎকার করে বলল, ওহে বিদেশি, রাজার ছেলে হয়েছে ‘তুমি খুশি?’ শিষ্য কী যেন বলতে যাচ্ছিল। গুরু তার মুখ চেপে ধরে, চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ খুশি।’ পেয়াদা চলে যেতেই গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে চর্মকারের বাড়ি গেলেন গুরু। তার পর পেয়াদার মতো গলা করে বললেন, ‘ওহে চর্মকার ভাই, রাজার ছেলে হয়েছে তুমি খুশি?’ চর্মকার বলল, ‘হ্যাঁ আমি খুশি।’ গুরু ফের বললেন, ‘শোনো চর্মকার ভাই, রাজার ছেলে হয়েছে তুমি কি খুব খুশি?’ চর্মকার ঘরের ভেতর থেকে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি খুব খুশি।’ গুরু আবার চিৎকার করে বললেন, ‘ঠিক করে বলো, রাজার ছেলে হয়েছে তুমি কি ভীষণ খুশি?’ চর্মকারের তাৎক্ষণিক উত্তর, ‘হ্যাঁ, আমি ভীষণ খুশি।’ এবার গুরু চর্মকারকে বললেন, ‘ভাই, একটু বাইরে এসো তো দেখি!’ চর্মকার বাইরে আসতেই গুরু বললেন, ‘প্রথম খুশিটা রেখে খুব খুশি আর ভীষণ খুশিটা ফেরত দাও দেখি ভাই।’
এই ‘খুশি’ হওয়া এবং ‘খুশি’ করার ব্যাপারটা এখন আমাদের রাজনীতিতে বেশ জেঁকে বসেছে। ক্ষমতাকে খুশি করার ঝোঁক আদি অনন্তকালের। চর্মকার শুধু তার একটু ভাগ পেতে চেয়েছিল। কিন্তু হয়নি। রাজা-রানিরা চলে গেছেন। কিন্তু আজকের গণতন্ত্রের যুগেও খুশি-পলিটিকস একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। উপকথার যুগে চলে গিয়েছিলাম। ফের ফিরে আসি বাংলাদেশে। রাজধানীতে বিভিন্ন পোস্টার-ফেস্টুন দেখুন। অমুক নেতা কিংবা তমুক নেত্রীর বন্দনা। এসবের একটা সাদা বাংলা নাম আছে। তেল দেওয়া। তেলের সমস্যা হলো, যতক্ষণ সেটা বাঁশে দেওয়া হয়, পাটিগণিতে দেখেছি, অসুবিধা বাঁদরদের। কিন্তু যখন সেটা গিয়ে পড়ে নেতা-নেত্রীর পায়ে, অনেকে বলেন, তাতে নাকি তাঁদের চোখের ‘কোলেস্টোরেল’ বেড়ে যায়। তখন দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে—মানে অনেক কিছু, যা দেখা জরুরি, তখন আর দেখা যায় না। যেমন দেখা যাচ্ছে না বর্তমানে ভোজ্যতেলের দাম কারা, কীভাবে বাড়াচ্ছে, এতে কার কতটা সমস্যা হচ্ছে। দেখবেনই বা কীভাবে? নতুন যুগে সমাজের আদর্শই হচ্ছে: যদি তুমি তেলবাজ হও, তবে তুমি বেশ!
এখন তেল বাজদের দখলে সকল জায়গা।
যদি তুমি ত্যাগী হও, তবে তুমি শেষ!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৫১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নেতৃত্ব না ‘পূজার আসন’? বিএনপির ভেতরেই কি এক নতুন ‘ফেরাউন’ উঠে আসছে?

লিখেছেন স্পর্শ, ১৫ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ৩:১৫






নেতৃত্ব না ‘পূজার আসন’? বিএনপির ভেতরেই কি এক নতুন ‘ফেরাউন’ উঠে আসছে?

সম্প্রতি কওমি ভিশনের একটি পোস্টার সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে বিএনপি-সংশ্লিষ্ট কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের শাহেদ জামাল- ৮১

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৫ ই জুলাই, ২০২৫ সকাল ৯:৫৭



শাহেদ। শাহেদ জামাল। আমার বন্ধু।
বড় ভালো ছেলে শাহেদ। অথচ তার চাকরিবাকরি নেই। চাকরিবাকরি তার দরকারও নেই। যার ঘরসংসার নেই সে চাকরি দিয়ে কি করিবে? অবশ্য টাকা এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি ভিক্ষা দিচ্ছেন মানে আপনি জাতিকে পঙ্গু করছেন

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই জুলাই, ২০২৫ দুপুর ১:০৫


ভিক্ষা হলো একটি সংস্কৃত শব্দ এর অর্থ হলো চাওয়া বা প্রার্থনা করা যা ভারতীয় ধর্ম যেমন জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্মে ভিক্ষাকরা বা চাওয়ার কাজকে বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। প্রাচীনকালে ভিক্ষা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ভাল্লাগে না কোনো কিছু=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৫ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৫:২৩


ভাল্লেগা না কোনো কিছু
মন বসে না কাজে,
কোন সে দুঃখ জমা হলো
বুকের ভাঁজে ভাঁজে।

ভাল্লাগে না আজকে আমার
মন যে উদাস হলো,
দু'চোখ আমার নীল বেদনায়
জলে টলোমলো।

বৃষ্টি এলো বৃষ্টি গেলো,
আনমনা হই আরও,
মন জমিনে কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। পদ্মার ইলিশ বিখ্যাত গোটা পৃথিবীতে , কেন ??[/sb

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১২









Padma Hilsa- বিশেষজ্ঞদের একাংশ দাবি করেন, পদ্মার জলে পুষ্টিগুণ ভাল। সেখানে কাঁকড়া, ঝিনুক, শৈবাল ইলিশের খাবার। আর তা থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় ইলিশ। ফলে মাছের স্বাদও হয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×