সকল প্রশংসা মহান আল্লাহপাকের জন্য । একমাত্র উনি ই জানেন কি সঠিক এবং কি ই বা ভুল । আসুন দেখি কুর'আন এ কি বলা হয়েছেঃ
“হে নবী! তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মু’মিনদের নারীদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের চাদরের প্রান্ত তাদের ওপর টেনে নেয়৷ এটি অধিকতর উপযোগী পদ্ধতি, যাতে তাদেরকে চিনে নেয়া যায় এবং কষ্ট না দেয়া হয়৷ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময় ৷” (সুরা আহযাব, ৫৯)
আরবী ভাষায় জিলবাব বলা হয় বড় চাদরকে ৷ আর ইদন শব্দের আসল মানে হচ্ছে নিকটবর্তী করা ও ঢেকে নেয়া৷ কিন্তু যখন তার সাথে আলা অব্যয় বসে তখন তার মধ্যে ইরখা অর্থাৎ ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেয়ার অর্থ সৃষ্টি হয়৷ বর্তমান যুগের কোন কোন অনুবাদক ও তাফসীরকার পাশ্চাত্য ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে এ শব্দের অনুবাদ করেন শুধুমাত্র "জড়িয়ে নেয়া" যাতে চেহারা কোনভাবে ঢেকে রাখার হুকুমের বাইরে থেকে যায়৷ কিন্তু যা বর্ণনা করছেন আল্লাহর উদ্দেশ্য যদি তাই হতো, তাহলে তিনি বলতেন৷ যে ব্যক্তিই আরবী ভাষা জানেন তিনি কখনো একথা মেনে নিতে পারেন না যে,মানে কেবলমাত্র জড়িয়ে নেয়া হতে পারে৷ তাছাড়া শব্দ দুটি অর্থ গ্রহণ করার পথে আরো বেশী বাধা হয়ে দাঁড়ায়৷ একথা সুষ্পষ্ট যে, এখানে মিন শব্দটি কিছু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷ অর্থাৎ চাদরের এক অংশ৷ আর এটাও সুস্পষ্ট যে, জড়িয়ে নিতে হলে পুরো চাদর জড়াতে হবে, নিছক তার একটা অংশ নয়৷ তাই আয়াতের পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, নারীরা যেন নিজেদের চাদর ভালোভাবে জড়িয়ে ঢেকে নিয়ে তার একটি অংশ বা একটি পাল্লা নিজেদের ওপর লটকিয়ে দেয়, সাধারণভাবে যাকে বলা হয় ঘোমটা৷
নবুওয়াত যুগের নিকটবর্তী কালের প্রধান মুফাসসিরগণ এর এ অর্থই বর্ণনা করেন৷ ইবনে জারীর ও ইবনুল মুনযিরের বর্ণনা মতে মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন (রা )হযরত উবাইদাতুস সালমানীর কাছে এ আয়াতটির অর্থ জিজ্ঞেস করেন৷ (এই হযরত উবাইদাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালালামের যুগে মুসলমান হন কিন্তু তার খিদমতে হাযির হতে পারেননি৷ হযরত উমরের (রা ) হযরত উমরের (রা ) আমলে তিনি মদীনা আসেন এবং সেখানেই থেকে যান৷ তাকে ফিকহ ও বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে কাযী শুরাইহ- এর সমকক্ষ মনে করা হতো৷ তিনি জবাবে কিছু বলার পরিবর্তে নিজের চাদর তুলে নেন এবং তা দিয়ে এমনভাবে মাথা ও শরীর ঢেকে নেন যে তার ফলে পুরো মাথা ও কপাল এবং পুরো চেহারা ঢাকা পড়ে যায়, কেবলমাত্র একটি চোখ খোলা থাকে৷ ইবনে আব্বাসও প্রায় এই একই ব্যাখ্যা করেন৷ তার যেসব উক্তি ইবনে জারীর, ইবনে আবি হাতেম ও ইবনে মারদুইয়া উদ্ধৃত করেছেন তা থেকে তার যে বক্তব্য পাওয়া যায় তা হচ্ছে এই যে, "আল্লাহ মহিলাদেরকে হুকুম দিয়েছেন যে, যখন তারা কোন কাজে ঘরের বাইরে বের হবে তখন নিজেদের চাদরের পাল্লা ওপর দিয়ে লটকে দিয়ে যেন নিজেদের মুখ ঢেকে নেয় এবং শুধুমাত্র চোখ খোলা রাখে"৷ কাতাদাহ ও সুদ্দীও এ আয়াতের এ ব্যাখ্যাই করেছেন৷
সাহাবা ও তাবে'ঈদের যুগের পর ইসলামের ইতিহাসে যত বড় বড় মুফাসসির অতিক্রান্ত হয়েছেন তারা সবাই একযোগে এ আয়াতের এ অর্থই বর্ণনা করেছেন৷ ইমাম ইবনে জারীর তাবারী বলেনঃ ভদ্র ঘরের মেয়েরা যেন নিজেদের পোশাক আশাকে বাঁদীদের মতো সেজে ঘর থেকে বের না হয়৷ তাদের চেহারা ও কেশদাম যেন খোলা না থাকে৷ বরং তাদের নিজেদের ওপর চাদরের একটি অংশ লটকে দেয়া উচিত৷ ফলে কোন ফাসেক তাদেরকে উত্যক্ত করার দুঃসাহস করবে না৷ (জামেউল বায়ান ২২ খন্ড, ৩৩ পৃষ্ঠা)৷
আল্লামা আবু বকর জাসসাস বলেন, "এ আয়াতটি প্রমাণ করে, যবুতী মেয়েদের চেহারা অপরিচিত পুরুষদের থেকে লুকিয়ে রাখার হুকুম দেয়া হয়েছে৷ এই সাথে ঘর থেকে বের হবার সময় তাদের সতর ও পবিত্রতা সম্পন্না হবার কথা প্রকাশ করা উচিত৷ এর ফলে সন্দেহযুক্ত চরিত্র ও কর্মের অধিকারী লোকেরা তাদরকে দেখে কোন প্রকার লোভ ও লালসার শিকার হবে না"৷ (আহকামুল কুরআন, ৩ খন্ড,৪৫৮ পৃষ্ঠা)
আল্লামা যামাখশারী বলেন, অর্থাৎ তারা যেন নিজেদের চাদরের একটি অংশ লটকে নেয় এবং তার সাহায্যে নিজেদের চেহারা ও প্রান্তভাগগুলো ভালোভাবে ঢেকে নেয়"৷ (আল কাশশাফ, ২ খন্ড, ২২ পৃষ্ঠা )
আল্লামা নিযামুদ্দীন নিশাপুরী বলেন,অর্থাৎ নিজেদের ওপর চাদরের একটি অংশ লটকে দেয়৷ এভাবে মেয়েদেরকে মাথা ও চেহারা ঢাকার হুকুম দেয়া হয়েছে৷ (গারায়েবুল, কুরআন ২২, খন্ড ৩২ পৃষ্ঠা)
ইমাম রাযী বলেনঃ "এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, লোকেরা যেন জানতে পারে এরা দুশ্চরিত্রা মেয়ে নয়৷ কারণ যে মেয়েটি নিজের চেহারা ঢাকবে, অথচ চেহারা সতরের অন্তরভুক্ত নয়, তার কাছে কেউ আশা করতে পারে না যে, সে নিজের সতর অন্যের সামনে খুলতে রাজী হবে৷ এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি জানবে, এ মেয়েটি পর্দানশীল, একে যিনার কাজে লিপ্ত করার আশা করা যেতে পারে না"৷ (তাফসীরে কবীর, ২ খন্ড, ৫৯১ পৃষ্ঠা)
এ আয়াত থেকে পরোক্ষভাবে আর একটি বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যায়৷ অর্থাৎ এখান থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কয়েকটি কন্যা থাকার কথা প্রমাণিত হয়৷ কারণ, আল্লাহ বলছেন, "হে নবী! তোমার স্ত্রীদের ও কন্যাদেরকে বলো"৷এ শব্দাবলী এমনসব লোকদের উক্তি চূড়ান্তভাবে খন্ডন করে যারা আল্লাহর ভয়শূন্য হয়ে নিসংকোচে এ দাবী করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কেবলমাত্র একটি কন্যা ছিল এবং তিনি ছিলেন, হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা৷ বাদ বাকি অন্য কন্যারা তাঁর ঔরসজাত ছিলেন না, তারা ছিলেন তার স্ত্রীর পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত এবং তার কাছে প্রতিপালিত৷ এ লোকেরা বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে একথাও চিন্তা করেন না যে, নবী সন্তানদেরকে তার ঐরসজাত হবার ব্যাপারটি অস্বীকার করে তারা কতবড় অপরাধ করছেন এবং আখেরাতে এ জন্য তাদেরকে কেমন কঠিন জবাদিহির সম্মুখীন হতে হবে৷ সমস্ত নির্ভরযোগ্য হাদীস এ ব্যাপারে ঐকমত্য ব্যক্ত করেছে যে, হযরত খাদীজার (রা ) গর্ভে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কেবলমাত্র একটি সন্তান হযরত ফাতেমা (রা ) জন্ম গ্রহণ করেননি বরং আরো তিন কন্যাও জন্মলাভ করে৷ নবী করীমের (সা ) সবচেয়ে প্রাচীন সীরাত লেখক মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক হযরত খাদীজার সাথে নবী করীমের (সা ) বিয়ের ঘটনা উল্লেখ করার পর বলেনঃ "ইবরাহীম ছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্ত ছেলে মেয়ে তারই গর্ভে জন্ম নেয়৷ তাদের নাম হচ্ছেঃ কামেস, তাহের ও তাইয়েব এবং যয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা৷ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ খন্ড, ২০২ পৃষ্ঠা) প্রখ্যাত বংশতালিকা বিশেষজ্ঞ হিশাম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনুস সায়েব কালবির বর্ণনা হচ্ছেঃ "নবুওয়াত লাভের পূর্বে মক্কায় জন্ম গ্রহনকারী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথম সন্তান হলো কাসেম৷ তারপর জন্ম লাভ করে যয়নব, তারপর রুকাইয়া, তারপর উম্মে কুলসুম৷ (তাবকাতে ইবনে সাদ, ১খন্ড, ১৩৩ পৃষ্ঠা)ইবনে হাযম জাওয়ামেউস সিয়ারে শিখেছেন, হযরত খাদীজার (রা ) গর্ভে নবী করীমের (সা) চারটি কন্যা জন্ম গ্রহণ করেন৷ এদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন হযরত যয়নব (রা ), তার ছোট ছিলেন হযরত রুকাইয়া (রা), তার ছোট ছিলেন হযরত ফাতেমা (রা ) এবং তার ছোট ছিলেন উম্মে কুলসুম (রা ) (পৃষ্ঠা ৩৮-৩৯) তাবারী, ইবনে সা'দ আল মুহাব্বার গ্রন্থ প্রণেতা আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনে হাবীব এবং আল ইসতি আব গ্রন্থ প্রণেতা ইবনে আবদুল বার নির্ভরযোগ্য বরাতের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে হযরত খাদীজার (রা ) আরো দু'জন স্বামী অতিক্রান্ত হয়েছিল৷ একজন ছিলেন আবু হালাহ তামিমী, তার ঔরসে জন্ম নেয় হিন্দ ইবনে আবু হালাহ৷ দ্বিতীয় জন ছিলেন আতীক ইবনে আয়েদ মাখযুমী৷ তার ঔরসে হিন্দ নামে এক মেয়ের জন্ম হয়৷ তারপর তার বিয়ে হয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে৷ সকল বংশ তালিকা বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে একমত যে তার ঔরসে হযরত খাদীজার (রা ) গর্ভে ওপরে উল্লেখিত চার কন্যা সন্তানের জন্ম হয়৷ (দেখুন তাবারী,২ খন্ড , ৪১১ পৃষ্ঠা তাবকাত ইবনে সা'দ,৮ খন্ড, ১৪-১৬ পৃষ্ঠা, কিতাবুল মুহাব্বার,৭৮,৭৯ ও ৪৫২ পৃষ্ঠা এবং আল ইসতি'আব, ২খন্ড,৭১৮ পৃষ্ঠা ৷) এ সমস্ত বর্ণনা নবী করীমের (সা ) একটি নয় বরং কয়েকটি মেয়ে ছিল,কুরআন মজীদের এ বর্ণনাকে অকাট্য প্রমাণ করে ৷
Source: http://www.islam.net.bd
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১০ বিকাল ৪:৫৫