মাত্র সাত মাসের ব্লগ জীবনে আমার বেশীরভাগ পোস্টই কবিতা নিয়ে। বর্তমানে ২৮ টি পোস্টের ২৭ টিই কবিতা। কবিতাগুলোর দুর্বোধ্যতা নিয়ে প্রচুর মন্তব্য এসেছে।
গুপ্তমুদ্রা কবিতাটি নিয়ে একটি মন্তব্য--
স্মৃতির নদীগুলো এলোমেলো... বলেছেন: রু আদের অনেক কবিতাই আমি অর্ধেক অর্ধেক বুঝি। পুরো বুঝতে অল্প একটু মাথা ফাটাতে হয়, কিন্তু লাইনগুলো ভালোলাগে। আর ভালোলাগে, এটাই সবকিছু।
অণুঘটনার আওয়াজ-২ কবিতাটি নিয়ে আরেকটি মন্তব্য এরকম--
ঘুমন্ত আমি বলেছেন: বুঝিনাই উচ্চমর্গীয় কথাবার্তা
অণুঘটনার আওয়াজ-১ কবিতায় নীরব 009 বলেছেন: এটা মনে হয় আপনার লেখা না কিংবা আপনার লেখা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।
জিসান শা ইকরাম বলেছেন:
কিছুটা কঠিন আমার জন্য........
লেখকের কয়েকটি লেখা পড়তে হবে....... তাহলেই আর কঠিনতা থাকবে না।
ভালো লাগা দিলাম .....
এই দুর্বোধ্যতা প্রসঙ্গে খুব ভালো কোন ব্যাখা কখনোই দেয়া হয়নি। কিন্ত বিষয়টা নিয়ে প্রচুর ভাববার সুযোগ হয়েছে। প্রথমেই খুঁজেছি কবিতার কাছে আমি কী চাই? কোন ব্যাপারগুলি আমার নিজের কী পছন্দ। কখনো কোন দৃশ্যকল্প বা চিত্রকল্প ভালো লেগে যায়।
ভাবনা যখন হরিণ, মাথার ভেতর বন
মরার পরেও শেষ হবে না হরিন ধরার পণ। (ছায়ামায়াকায়া হরিণ, মারজুক রাসেল)
কোন সাধারন কথার এমন অদ্ভুত সুন্দর উপস্থাপন বা বর্ণনা থাকে যে ভালো লেগে যায়। যে কথা এই প্রথম শুনলাম পৃথিবীতে কেউ আগে কখনো বলেনি। যেমন:
দুপুর সূর্যের মেজ মেয়ে
মুখে হাত দিয়ে হাসে
হাত ছাড়া হাসলে খুন হয়ে যাতাম। (মধ্যাহ্না, মারজুক রাসেল)
কবিতার ভেতরের যেখানে কবির কোন ভাবনার বা সুগঠিত অন্তদৃষ্টি খুব বেশী ভালো লেগে যায়। যেমন:
আমার ভাষা তৈরি হয় সেই নির্জনতায়,জেব্রা যেখানে তার শাবকদের নিয়ে খেলা করে। বহু খুঁজে, পেয়েছি পেজমার্কার, একটি উজ্জ্বল বিয়োগচিহ্ন আর ডালিমফুলের ছায়া। বন্ধ দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে, লিখতে শুরু করি। একদিকে অসানোগ্রাফির ক্লাশ, অন্যদিকে তোমার সঙ্গে সাঁতার কাটার ইচ্ছে। তাসের ঘরে এলেই প্রশ্ন করো, আমি কি তুলোরাশির জাতক? ঘর অন্ধকার করে শুধাই, তুমি কি কাননবালা? প্রশ্নেরা আজ হাসির কারাগার যেন। তোমার শরীর থেকে তখন ঘাসের গন্ধ আসে। জানালা খুলে দেই অতঃপর শান্ত হাতে। পাখিবাজার থেকে ফেরে লাঞ্ছিত লোকজন, নক্ষত্রের আলো আসে আমাদের তাসের ঘরে।
(ভাষা, মজনু শাহ)
এখানে জেব্রা নিয়ে কবির দীর্ঘ ভাবনা রয়েছে, পর্যবেক্ষন রয়েছে। পেজমার্কার ডালিমফল কিংবা বিয়োগচিহ্ন নিয়ে কবির স্মৃতি কিংবা অর্ন্তঃদৃষ্টি রয়েছে। সেটি হতে পারে ব্যক্তিগত হতে পারে সার্বজনীন। দেয়ালঘড়ি, ক্লাস বা সাঁতার নিয়ে তিনি হয়তো একটি গল্প বলতে চান অথবা চান না। এরপর তিনি আমাদেরকে তুলোরাশি, কারাগার ও কাণনবালার কথা শুনিয়েছেন। এসব কথা তিনি বলেছেন চমৎকার শব্দের বুননে। এই শৈলী তিনি রপ্ত করেছেন দেড়-দুই যুগের সাধনায়।
আরেকটা কবিতায় তিনি বলেছেন:
যখন তুমি মেয়েমানুষ থেকে দূরে আছ, পড়তে পার চিহ্নবিজ্ঞান, চাঁদের নিচে ডিগবাজি খেতে পার কিছুক্ষণ বা বানাতে পার চাবুক। আসলে তোমার জন্যে কোথাও অপেক্ষা করে আছে কাঠবেড়ালি, তার বগলে এ বছরের রাশিফলের বই, আর অন্য হাতে সেক্স-পিস্তল।
.
যখন তুমি পুরুষমানুষ থেকে দূরে আছ, খাও যত ইচ্ছে পপকর্ণ, নিজের ভয়ংকর গোপন কথাগুলো নিজেকেই আরেকবার শোনাও ফিসফিস করে। একখানা জ্যান্ত কবিতার বই সঙ্গে রেখ, তোমার দিকে এগিয়ে আসা বিচ্ছুগুলো পিটিয়ে মারার জন্য ওটা লাগবে। খবরদার, ভুলেও বেড়াল কোলে নিও না, যা দিনকাল পড়েছে, স্তনে আঁচড় দেবার ঘটনা গত পরশুও ঘটেছে ভূতের গলিতে। এ সময় ইউক্লিডের উপপাদ্যগুলো মনে আছে কিনা, সেটা আঙুল দিয়ে লিখে দেখতে পার বালিতে। (জেব্রামাস্টার, মজনু শাহ)
অথবা একটা দৃশ্যের খুব অসাধারন বলার ভঙ্গিতেও কবিতা হয়ে উঠতে পারে। যেমন:
আমার বিছানা থেকে আমি তিনটা পাখিকে দেখি, টেলিফোনের তারের উপর বসা।একটা পাখি উড়ে যায়,তারপর আরেকটি। একটি পাখি বসে থাকে, এবঙ কিছু সময় পর সেও উড়ালপঙ্খী হয়।আমার টাইপরাইটার
শশ্মানফলকের মতোই স্থির থাকে আর আমি অবশেষে একজন নিবিষ্ট পাখিপরিদর্শকে পরিণত হই।
হঠাৎ মনে হল, এই কথাগুলি তোমাদের জানাই, ফাকার!
(চার্লস বুকোস্কির কবিতা)
এরকম আরেটি কবিতা:
এই দুপুর এক ঘুমহীন জাহাজের ছদ্মবেশে আমার নিকটে আসে। ইচ্ছে করে: ওর সব নাটবল্টু খুলে রেখে দিই সকালের বুকপকেটে। রোদহীন বাতাসের ঝাপটা দেখে মায়া লাগে। স্বসম্মতিতে আমি তাকে উড়ে যেতে দেই-- সে সন্ধার ডালে গিয়ে বসে অতঃপর রাত্রির সাথে নিষিদ্ধ প্রেমালাপে লিপ্ত হয়। এইসব ঘটনা নিলমলাটের দিনলিপিতে লিখে রাখে যে কাক তার কোন নাম নেই। (গ্যাব্রিয়েল সুমনের কবিতা)
দুবোধ্যতা বিষয়ে সরকার আমিনের খুব চমৎকার একটি লেখা এসেছে ইত্তেফাক সাময়িকীতে। লেখাটি হুবহু দিয়ে দিলাম।
কবিতা চা বা নুডলস নয়
সরকার আমিন
আমার কবিতা নিয়ে একটা নালিশ শুনেছি। ‘ভাই আপনার কবিতা কোথা থেকে যে কোথায় চলে যায়। মাঝে মাঝে বুঝি না! কবিতায় পারম্পর্য নাই।’ এ নিয়ে আমি ভেবেছি। বলেছি কথা সত্য। আমি যে ভাই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কবিতা লিখি। কবিতা ভর করলে ঘুমন্ত হই। স্বপ্নের দেশে চলে যাই। স্বপ্নে আগামাথা থাকে না। এক্ষণ আপনি দর্পনারায়ণপুর, তক্ষণ হয়তো পিরামিডে নাক ঘষছেন। স্বপ্নে আপনার মনে হতে পারে তাজমহলের আশেপাশেই বঙ্গোপসাগর। সাপ আপনাকে তাড়াচ্ছে। ওসামা বিন লাদেনের বাম পাশে বসে চা খাচ্ছেন ডব্লিউ বুশ। পৃথিবীতে স্বপ্ন ও কবিতা জন্মসূত্রে স্বাধীন।
কবিতা বোঝার ব্যাপারটা এখন একটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কবিতা বুঝতে চান কিন্তু কবিতা তাঁদের কাছে বড়ই কঠিন মনে হয়। তাঁদের কাছে তরুণদের কবিতা পাথরের মতো কঠিন লাগে।
ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ কাঁচি দিয়ে কেটে ইনস্ট্যান্ট চা বা নুডলস বানানোর মতো করে কবিতা লেখা বা বোঝা সম্ভব নয়। কবিতা চা বা নুডলস নয়। কবিতা আত্মার খাদ্য।
কবিতা ব্যাখ্যাতীত শিল্প, লজ্জাবতী লতা। একটি কবিতার সেই অংশটা নিয়ে সমালোচক কামড়াকামড়ি করে মরেন—যা কবিতাটির মাংশল দিক, আত্মার খণ্ডাংশও নয়। কবিতার রুহ বা আত্মাকে বাক্য দিয়ে কি ধরা যায়? কেউ কি তা ধরতে পেরেছে?
সবশেষে একই প্রসঙ্গে একই ব্যক্তির আরেকটি উক্তি শেয়ার করছি।
কবিতা বোঝার বিষয় না। যেমন চুম্বন বোঝার বিষয় না, সূর্যউদয় বা অস্ত যাবার বিষয় বোঝার বিষয় না, বোঝার বিষয় না পাখির উড়াল, শিশুর হাসি, সমুদ্রের ঢেউ! গরু বোঝা যায় গোধূলি বোঝা যায় না।অতএব তুমি কিছু বোঝ নাই। বেশ। আমিও কিছু বুঝি নাই।বেশ। কবিতা হচ্ছে না বোঝার মামলা। পতিতা বোঝা যায়, প্রেমিকা তো বোঝা যায় না।
-সরকার আমিন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



