অবসর সময় কাটানোর মত কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে এক দিকভ্রান্ত পথিক দম্পতিকে ডেকে পাশে বসিয়ে বললাম, 'ভাই আপনারা মনেহয় অনেক ক্লান্ত। আসেন এই গাছের ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নেন। আর ততক্ষণে আমরা দু'জনে মিলে একটা খেলা খেলি।'
পথিক কিছুটা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, 'কি খেলা ভাই?'
সম্ভবত মনে মনে সে ভীষণ উত্তেজিত। আমি তার উত্তেজনাকে আরো কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, 'দারুণ খেলা! তবে শর্ত হল, খেলায় হেরে গেলে কিন্তু তার প্রতিদান দিতে হবে? আর শর্ত শোনার পরে কিন্তু খেলা থেকে বিরত থাকা যাবে না?'
পথিক উত্তেজিত ভঙ্গীতে মুখের উপরে একবার হাত চালিয়ে নিয়ে তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, 'হুম, আমি রাজি। আপনি খেলা আর শর্ত বলেন!'
পথিকের বউ চোখ বড় বড় করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটাতে সেও যে মনে মনে বেশ আনন্দ পাচ্ছে, সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি পথিকের দিকে তাকিয়ে বললাম-
'খেলাটা হল ডুয়েল। আপনি এবং আমি দু'জনে সামনা সামনি দাঁড়িয়ে একজন আর একজনের দিকে পিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়বো। এটাতে যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবে, সে কোন ধরনের বাঁধা ছাড়াই অন্যজনের বউ'কে নিয়ে চলে যেতে পারবে। রেফারি থাকবে আপনার স্ত্রী!'
ক্লান্ত পথিক কিছুক্ষণ নির্বাক আমার মুখের পানে চেয়ে রইল। আমাকে তার পাগল মনে হচ্ছে কিনা কে জানে? তারপর বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 'তো সেজন্য ডুয়েল খেলার কি দরকার? চাইলে তো আমি এমনিতেই আমার বউরে আপনাকে দিয়ে দিতে পারি। আমি মরতে চাই না, এই থাকলো আমার বউ!'
পথিক আর আমার কাছে বিন্দু পরিমাণ সময় নষ্ট করলো না। উঠে হনহন করে একদিকে চলে গেল। আমি নির্বাক তাকিয়ে থেকে একবার পথিকের বউয়ের মুখের দিকে, আর একবার পথিকের গমন পথের দিকে তাকাতে লাগলাম। পথিক আনন্দচিত্ত্ব মুখে শিষ দিতে দিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার ক্লান্তি দূর হয়েছে কিনা ঠিক বোঝা গেল না।
আমি পথিকের দিকে তাকিয়ে একটা বিদ্রুপাত্মক শব্দ ব্যবহার করে বললাম, 'নিশ্চিৎ পাগল মনেহয়!'
তারপর আনমনা ভাবে তার বউয়ের হাত ধরতে গিয়ে বেশ অবাক হলাম! এখানে তো আসলে কোন বউ নেই। বরং তার পরিবর্তে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার একটা নেড়ি কুত্তা। মানে কি এসবের!
আমি তীব্রবেগে আবারও দূর দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথিকের গমন পথের দিকে তাকালাম। এখনো তার শিষের শব্দ স্পষ্ট আমার কানে আসছে। পথিকের কোন দিকে খেয়াল নেই। সে তার বউয়ের হাত ধরে আনন্দিত মনে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। বউ তো নয়, যেন স্বর্গের অপ্সরী! তার সাথে থাকা সুন্দরী মেয়েটার চেহারা দেখিয়ে আজ সারাদিনে আরো কত যুবককে যে সে পাগল বানাবে তা কে জানে!
- 'আচ্ছা এই পাগল পথিককে কেউ থামাচ্ছে না কেন?'
এমন সময় কানের কাছে মৃদু আওয়াজে কে যেন বলে উঠলো, 'ওরে বোকা, ওটা সুন্দর নয়; মায়া। তোর সত্ত্বাকে ধ্বংস করার জন্যই আবির্ভূত হয়েছিল!'
পুনশ্চঃ- সে আজ বছর দু'য়েক আগের ঘটনা। আমি আজও সেই গাছের ছায়ায় বসে অপেক্ষার প্রহর গুনি পথিক দম্পতি দু'জনের জন্য। কিন্তু তারা আর আসেনি। তার পরিবর্তে অন্যকিছু দিকভ্রান্ত পথিক এই ছায়ায় বসে শরীর শীতল করতে করতে নিজেদের মধ্যে গল্প করে। আমি শুনি তাদের গল্প। তবে মুখে কিছু বলি না। তারা ভাবে, আমি বলি না বলে হয়তো কিছু বুঝিও না। কিন্তু তারা তো জানে না, এই গাছের ছায়ায় বসে তারা নিজেদের মধ্যে যে গল্পের সূত্রপাত করে; সেই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আর কেউ নয়। স্বয়ং আমি নিজে...
তারা আমার গল্প আমার কাছে বসে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বর্ননা করে। শুনতে শুনতে সেটা আমার নিজেরও মুখস্ত হয়ে গেছে! আমি অনেক চেষ্টা করেছি সেদিনের সেই ঘটনাকে ভুলে যেতে। কিন্তু পারি না। যখনই ভুলে যাওয়ার মত কোন পরিবেশ সৃষ্টি হয়, ঠিক তখনই আবারও কোন দিকভ্রান্ত পথিক এসে হয়তো নতুন করে তা মনে করিয়ে দিয়ে যায়। বেশ ভালই লাগে। তবে অনেকদিন থেকে এইসব পথিকের কাছে একটা প্রশ্ন আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা পথিক কি কখনো পথের শত্রু হতে পারে...??
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ- এই গল্পের বিষয়বস্তু সহ যাবতিয় চরিত্র কাল্পনিক। যদি কারো ব্যক্তিগত জীবনের সাথে মিলে যায়, তাহলে সেটা নিতান্তই কাকতালীয় ব্যাপার। সেজন্য লেখক কোন অংশেই দ্বায়ী থাকবে না। তাছাড়া টাইপিংয়ের ভুলের কারনে হয়তো অনেক জায়গায় বানানে ভুল থাকতে পারে। সেটাকে বিবেচ্য বিষয় হিসাবে না ধরে, ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে কৃতার্থ হবো!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:৫৮