somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আহা শৈশব

২৬ শে অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১২:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। কতদিন পর টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনছি। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। সেই ছেলেবেলার মতন। যখন সন্ধ্যা হলেই ঘরে ঢুকতে হতো বাধ্য ছেলের মত। সারা বিকেল খেলে সন্ধ্যার আযান দেবার সাথে সাথেই ঘরে ঢুকতে হতো হাত পা ভালমত ধুয়ে। তারপর নয়টা অবধি পড়তে হতো মাদুর বিছিয়ে কুপির আলোয়। দুই ভাইবোন পড়তাম সুর করে। পড়তাম বললে ভুল হবে মুখস্থ করে চলতাম। কী পড়ছি মাথায় ঢুকতনা। কোন প্রাইভেট টিউটর ছিলনা। স্কুলের স্যার ম্যাডামরাই ছিল জ্ঞানার্জনের উৎস। প্রতি মঙ্গলবার আটটা দশ বাজতেই পড়ালেখা সব অফ। কারণ , রেডিওতে ধারাবাহিক নাটক হতো সেদিন। আমাদের বাসায় বিদ্যুতই ছিলনা টিভিতো অনেক দূরের বস্তু। সারা গ্রাম জুড়েই মাত্র দুই ঘরে টিভি ছিল। তাও ব্যাটারিতে চলত। একটি ছিল গ্রামের একমাত্র বিল্ডিং ‘বাবু’দের বাসায় আরেকটি বাজারের রেডিও টিভি সারাইয়ের দোকানদার সিরাজ কাকাদের। আমার এখন ভাবতে বেশ অবাক লাগে পৌরসভার মধ্যে একটা গ্রাম সবকিছুই আছে কিন্তু কোন অজানা কারণে বিদ্যুৎ নেই।

আমাদের বাসায় বিদ্যুৎ এসেছিল ২০০৪ সালে। তখন শীতকাল। একদিন বিকেলে আমাদের ঘরে প্রথমবারের মতন জ্বলে উঠেছিল ১০০ ওয়াটের একটি বাল্ব। তারও অনেক অনেক পরে পুরনো কালো রেডিওটি সরিয়ে বিনোদনের জায়গাটা দখল করেছিল একটি ২১ ইঞ্চি সাদাকালো ন্যাশনাল টেলিভিশন। কথা বলছিলাম বৃষ্টি নিয়ে। বৃষ্টির সন্ধ্যাগুলো কেমন উদাস একটা অনুভূতি নিয়ে আসতো মনে। দূরে কোথাও বাজ পড়লে রেডিওটে কেমন অদ্ভুত একটা আওয়াজ হতো। প্রতি রাতে ঘুমুতে যাবার সময় একটা করে বই নিয়ে যেতাম কাঁথার তলে লুকিয়ে পড়ার জন্য । আলোর ব্যবস্থা করতে বেশ সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলাম। বাজারে অল্প আলোর লাল রঙের একধরণের ছোট্ট বাল্ব কিনতে পাওয়া যেত। দাম ছিল দু টাকা। সেগুলোর সাথে আব্বার টর্চের পুরনো অনেকগুলো ব্যাটারী জুড়ে দিতাম। নিরাপদ একটা আলো পেয়ে যেতাম বই পড়ার জন্য। শীত , গরম কোন ঋতুতেই কাঁথা ছাড়া আমার চলত না। কারণ বই ছাড়া আমার ঘুম আসত না। বই পড়ার অভ্যেসটা আগের মত না থাকলেও কাঁথা ছাড়া না ঘুমুতে পারার অভ্যেসটা ঠিকই রয়ে গেছে।

আজকের মতন যে দিনগুলোতে বৃষ্টি হতো কাঁথার তলে শুয়ে থাকতে বেশ আরাম পেতাম। সেদিন খুব কম সময়ই বই পড়তাম । নানারকম কল্পনা করে কাটিয়ে দিতাম। সেই সব কল্পনারা স্বপ্নে এসে পাখা দুলিয়ে যেত। কত কিছু যে ভাবতাম । নিজেকে বইয়ে পড়া চরিত্রগুল ওর মত মনে করতাম । বইয়ের ঘটনাগুলোর সাথজে আরো কত কিছু মেশাতাম। ঝুম থেকে ঝুমতর বৃষ্টি যেদিন হতো সেদিন গলা খুলে গান গাইতাম। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের জন্য আমার হেড়ে গলার গান কারো কানে পৌঁছাত না। বেশ উপভোগ করতাম বৃষ্টিময় সেইসব রাতগুলো।

কোন কোন দিন ঘুম ভেঙ্গে দেখতাম তখনো বৃষ্টি হচ্ছে, কিংবা উঠোন ভরে গেছে পানিতে। বৃষ্টির জন্য স্কুল/ মাদ্রাসা ফাঁকি দিয়েছি বেশ । সারাদিন কোন কাজ করতাম না। আমার একটা ছোট্ট ল্যাবরেটরি ছিল । রাজ্যের যন্ত্রপাতি বোঝাই বড় একটা বাজারের ব্যাগ। ভাঙা ক্যালকুলেটর থেকে শুরু করে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের ভাঙা অংশ সবই ছিল আমার ল্যাবরেটরিতে। কখনো চেয়েচিন্তে দরকার পড়লে চুরি করে সংগ্রহ করতাম এসব। ক্ষেত্র বিশেষে কপালে মারও জুটত । পরম উৎসাহে বারান্দায় বসে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করতাম। আরেকটু বড় হয়ে অবশ্য সত্যি সত্যি একটা কাজ করেছিলাম নিজের হাতে একট অনুবীক্ষণ যন্ত্র বানিয়ে উপজেলা পর্যায়ে বিজ্ঞান প্রজেক্টে সেকেন্ড হয়েছিলাম । বাঁশের চোঙের এক মাথায় আতশ কাঁচ বসিয়ে অন্য পাশে বাইনোকুলারের ভাঙা অংশ জুড়ে দিয়েছিলাম আতশ কাচটাও আমিই বানিয়েছিলাম। দুইটা হাতঘড়ির উপরের কাঁচ দুটোর মাঝখানে পানি ভরে আটকে দিয়েছিলাম। টিনের চালের ফুটো বন্ধ করতে এক ধরণের আঠা ব্যবহার করা হয় , পুডিং নামে। পুডিং দিয়ে ভালমতো আটকে দিয়েছিলাম। বেশ ভালই কাজ করতো আমার তৈরী অনুবীক্ষণ যন্ত্রটা। চারটা বাঁশের চটির সাথে অনেক কসরত করে জুড়ে দিয়েছিলাম যন্ত্রটা। যেই দেখত অবাক হয়ে যেত। সবাই বলত আমি বড় হয়ে ইঞ্জিয়ার অথবা বিজ্ঞানী হবো। অথচ ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ হয়নি আমার।

প্রাইমারি স্কুলের পাঠ শেষ করি ২০০২ সালে। ২০০৩ এ আমার ক্লাস সিক্সে ভর্তি হবার কথা। বেশ ভাল ফল করেছিলাম স্কুলে। কিন্ত আব্বার ইচ্ছা ছিল মাদ্রাসায় পড়াবেন। আমাকে বেশ বোঝালেন একদিন । তাঁর স্বপ্নের কথা বললেন, আমাকে একজন আলেম বানাতে চান। কচি মনে আব্বার আবেগী কথাগুলো বেশ দাগ কেটে গেল। আমার কিছু করার ছিল না। ভেবেছিলাম মাদ্রাসায় ক্লাস সিক্সেই ভর্তি হব।
একদিন দুপুরের পরপর আব্বা আমাকে নিয়ে মাদ্রাসায় গেলেন । মোহনগঞ্জ দাখিল মাদ্রাসা। বাড়ি থেকে বেশ দূরে । আড়াই কিলোমিটার তো হবেই। স্কুল বাড়ি থেকে এক কিলোমিটারের মতন। মাদ্রাসায় যখন পৌছাই তখন কোন ক্লাস চলছিল না। হুজুররা বসেছিলেন ছাত্র ভর্তি করতেই। সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে সব। বিরাট একটা খোলা প্রান্তরে মাদ্রাসাটি একা দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে মাটির একটি সড়ক চলে গেছে অনেক দূরে একটি গ্রামে। এর মধ্যে আর কিছু নেই শুধু ধানক্ষেত। বলা যায় মাদ্রাসাটিই শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে।

মাদ্রাসা লাগোয়া একটি নার্সারি কাম ফিসারি। একতলা একটা বিল্ডিং আর লাগোয়া লম্বা একটি টিনশেড হাফ বিল্ডিং। সামনে একটি পুকুর। বেশ বড়ই পুকুরটি। একটাও গাছ নেই মাদ্রাসা জুড়ে। ছোট্ট এক চিলতে মাঠ আছে। সবুজ ঘাসে ঢাকা। তাতে দুটো গাই ঘাস খাচ্ছে। আমরা যখন মাদ্রাসায় পৌঁছাই ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেছে। খাঁ খাঁ করছে সব। ছুটি হয়ে গেছে বেশ আগেই।

বড় একটি রুমে ঢুকলো আব্বা। বেশ কয়েকজন হুজুর বসে ছিলেন। আব্বা ঢুকেই সালাম দিলেন। আব্বার দেখাদেখি আমিও। গোলগাল চেহারার পান খাওয়া একজন হুজুর বসতে বললেন। আব্বা একটা চেয়ারে বসলেন। আমিও বসতে গেলাম আরেকটা চেয়ারে। পাশ থেকে একজন হুজুর বলে উঠলেন ,” এটা তোমার জন্য নয়। এটা শুধু শিক্ষকদের জন্য।“ আমি তো অবাক! স্কুলে তো স্যারদের চেয়ারে কতই বসেছি। কেউ তো কিছু বলেনি।

যাইহোক, ভর্তি হবার পালা। হুজুরেরা আমার কিছু পরিক্ষা নিলেন। আব্বা বললেন আমাকে সিক্সে ভর্তি করার জন্য। দুজন হুজুর সায় দিয়েছিলেন । কিন্তু যিনি আমাকে বসতে নিষেধ করেছিলেন তিনি বললেন, “আপনার ছেলে সাধারণ ধারার শিক্ষায় ভালো। কিন্তু আমাদের এখানে আরবীটার গুরুত্ব বেশী। সে হুট করে এত উচু ক্লাসে মানাতে পারবেনা। তাকে বরং ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করে দিই।“ শুনে আমার কান্না চলে আসলো। কমপক্ষে ক্লাস ফাইভ তো বলতে পারতো। একদম ক্লাস থ্রি। কীভাবে জানি আব্বাও রাজি হয়ে গেলেন। আমি একবুক ব্যথা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। এই আমার মাদ্রাসা জীবনের শুরু। নতুন একটা অধ্যায়। অন্যরকম একটা অধ্যায়। এখন ঠিকই বুঝতে পারি আসলে সেদিনের সিদ্ধান্তটা খুব যে খারাপ ছিল মোটেও তা না । তারপর কত নতুন নতুন গল্প সৃষ্টি হলো। শোনাব আবারো......

ছবিটা তুলেছিলাম দুর্গম এক হাওর থেকে। সোনারথাল নাম হাওরের।

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১২:৫১
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×