ইদানিং অনেক চেষ্টা করেও সময় করা হয়না। আজ হঠাৎ করেই এক বিকেল কর্মহীন সময় চলে এল হাতে। কোথায় যাওয়া যায়? টানা পাঁচ মিনিট হেটে যাবার দিক ঠিক করলাম, আজ মোহনায় যাব। একলা থাকলে যা হয়, উদ্ভট চিন্তা আসে মাথায়, কিন্তু বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে দাড়ায়। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে কয়েকটা নাম্বার ডায়াল করার চেষ্টা করলাম, একটায়ও মন সায় দিল না। কে কি ভাববে, আনঅফিসিয়াল ফোন দেয়া ঠিক হবে কিনা এসব মনে এলে ভাবলাম আমি কি নিজে চিন্তা করার ক্ষমতা হারাচ্ছি? আমি নিজেই ঠিক করব মোহনায় কিভাবে যাব। নদীর পাড়ে চলে আসলাম বিশ মিনিটের মাথায়। বালুভর্তি নৌকাগুলো ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে দক্ষিনে যাচ্ছে। যেন বিকেলের অলসতার ছাপ পড়েছে ওদের উপরও।
দশ টাকার ভাড়ায় উঠে পড়লাম বালুর নৌকায়। প্রায় আধঘন্টা নৌকার লোকজনের সাথে কথাবার্তা বিনিময়ের পর হঠাৎই চোখ আটকে গেল নদীর এক প্রান্তে।রাস্তার সাথে মিশে গেছে নদীর পাড়। একটা সাদা গাড়ী। তার সাথে দাড়িয়ে দু'জন মানুষ। কালো শাড়ি পরনে একটা মেয়ের মুখে আচমকা আঘাত করলো ছেলেটা। আরো কিছুক্ষণ থেকে মোটর সাইকেলে চড়ে চলে গেল সে। একটা গাড়ী, আর পাশে দাড়ানো একটা মেয়ে নদীর দিকে চেয়ে আছে। এরই মধ্যে মাঝি হাঁকল, স্যার এইহানে নাইম্যা পড়েন, নৌকা মোড় নিব।নামলাম। বালুভর্তি চর। মানুষের আনাগোনা থাকায় খুব বেশী পরিস্কার না, তবে দূর থেকে তাকালে বুঝা যায় অসাধারন। চুপচাপ হাটছি। ঘটনাটা বারবার চোখে ভাসছে। উৎসুক মন বারবার উঁকি দিচ্ছে, প্রশ্ন করছে এমনভাবে যেন ঘটনাটা আমিই ঘটিয়েছি।
এক লোককে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সামনের ছোট বাজারে ভাল আদার চা পাওয়া যায়।সে পথে এগুলাম। ছোট ছেলেমেয়ের দল পথের ধারের খাদ সেচে মাছ ধরছে, যতটা না আয়োজন তার চেয়ে দর্শক বেশি। আমিও একটু ঢু মারলাম। তাজা মাছ দেখে লোভই লাগছিল। আহ্ রে, কতদিন দেশি পুটি মাছের ভাজা দিয়ে গরম ভাত খাই না।আফসোস নিয়ে চা আর বাকরখানি খেলাম বাজারে।জায়গাটার নাম বিহারপুর। কেমন যেন বিহারী টাইপ ব্যাপার স্যাপার আছে জায়গার নামের সাথে। কৌতুহলের জবাবে জানলাম, ময়মনসিংহের রাজারা যখন নৌবিহারে বের হতেন তখন এখানে নোঙ্গর করে বিশ্রাম করতেন, তাই এর নাম বিহারপুর।যাক, বিহারপুরেই সন্ধ্যা নেমে এল। নদীর বুকে ডুবো সূর্য দেখার জন্য চশমাটা ভাল করে মুছে নিলাম শার্টের কোনায়।অদ্ভূত সুন্দর এই সূর্যডোবা। উত্তরের বাতাস একটু শীত নামিয়ে দিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে দেখি ঐ মেয়েটি এখনো দাড়িয়ে আছে সাদা কারের গায়ে হেলান দিয়ে। দূর থেকে গাড়ির রং স্পষ্ট হলেও মেয়েটির গায়ের রং চোখে পড়ল না।
আমি যে স্থানে দাড়িয়ে তা থেকে কমবেশি ত্রিশ গজ দূরেই তার অবস্থান। ইচ্ছে করছিল এগিয়ে জানি, ঘটনাটা কি হল? নাহ্।ঠিক হবে না, অচেনা একটা মেয়েকে তার ব্যাক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করাটা সমিচীন হবে কি? মগজ সায় দিল না।মগজ বলল, মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে এমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ইনটিউশনকে পাত্তা দেয়া ঠিক হবে না। এসব নেতিবাচক নিয়মগুলো কেমন করে যে জীবনের সব ইচ্ছা অনিচ্ছার সাথে জুড়ে গেল..টেরই পেলাম না। একটা সময় ছিল যখন বেকার হয়ে ভাবতাম, আমি যদি অনেক ব্যস্ত থাকতে পারতাম কি মজার হতো জীবনটা। আজ সীমানায় পৌছে উল্টো সুরে মনকে গালি দেই। কি আজব মানুষের ভাবনার সমীকরণ।ফিরবো কি করে ভাবছি। বালুর নৌকা এখন আর আমাকে উঠাবে না। রাস্তা ঘাট ভালো, তবে ভ্যান ছাড়া অন্যকোন গাড়ি দেখিনি একটাও এ পর্যন্ত। কাছাকাছি আসলে মেয়েটার সাথে দেখাদেখি হয়ে গেল একবার। কেমন যেন একটা উদাসীন মন নিয়ে আমার দিকে তাকাল সে। আমি একটু অপ্রস্তুতভাবে হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। মনের মধ্যে কয়েক ডজন প্রশ্ন।
অন্ধকারে হাটছি ফেরার পথে। একটু শব্দ শুনলেই পিছনে তাকিয়ে দেখি কোন গাড়ি আসল কিনা। আলোর তীব্রতাই বলে দিল এবার গাড়িই আসছে। ট্রাক, টেম্পু যা-ই হোক, এবার উঠে পড়তে হবে।নইলে আজ আর বাড়ি ফেরা হবে না। হেডলাইটের আলোতে কিছুই দেখতে না পেয়ে চশমা খুলে ফেললাম। হাত নেড়ে লিফট চাইলাম দূর থেকে। গাড়িটা আমাকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেল। এটা সেই সাদা কারটি। আবার সেই মেয়ের কথা মাথায় টোকা দিল। এসব হচ্ছে কি? কালকে মিটিংয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে রাতের মধ্যে। সকাল ১০ টায় সবাই চলে আসবে। টিম ওয়ার্ক হচ্ছে, তবুও আমার ব্রিফিং বাকি। আবার গাড়ি আসছে, তবে সামনে থেকে। এটাকে থামতে বললে কি লাভ, তাই নিজের মত হাটছি আর ভাবছি মেয়েটি কি একাই ছিল গাড়িতে..সেই ছেলেটি কেন তাকে এভাবে আঘাত করলো।সামনে থেকে আসা একটি কার আমার পায়ের কাছে এমনভাবে থামল যে আমি খানিকটা ভয়ই পেলাম। জানালার কাঁচ নেমে গেলে ড্রাইভারের সিটে বসা একটি অসাধারন দেখতে মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি শহরের দিকে যাবেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। সে বলল, উঠে পড়ুন। আমি কোন ভনিতা না করেই চড়ে বসলাম ড্রাইভারের পাশের সিটে। মনের মধ্যে এক গাদা ভয় আর প্রশ্ন। এই মেয়ে গাড়ি চালাতে পারে তো ঠিকমতো? কেন সে ফিরে এলো? মৌনভাব নিয়ে ঘন্টায় ৬৫ কি.মি. বেগে চলন্ত একটি বাহনে অপরূপ সুন্দর একটা মেয়ের পাশে বসে আছি আর এসব ভাবছি। আমার কি কথা বলা উচিত তার সাথে।নাহ্ । থাক। সে হয়তো ভাববে একটু সাহায্য দিয়েছি আর এই লোক ঘাড়ে চড়তে চাচ্ছে।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর দ্বিতীয়বার মুখ ফুটলো মেয়ের। আমি নন্দিতা। বিএসএস শেষ করে মাস্টার্স ভর্তি হয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।ঢাকা থেকে ঘুরতে এসেছিলাম। আপনি কি এখানকার মানুষ? আমি শুধু ঠোঁটের আলোড়নই দেখলাম, কি বলেছে মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। না বুঝেই উত্তর দিলাম, হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হয় না আপনি এখানকার। আমি আবারও হ্যাঁ বললাম। এবার সে হাসল। কি অদ্ভূত সেই হাসি। এরপর আরও কিছু প্রশ্ন করলো নন্দিতা। আমার নাম শেখর জেনে সে ভ্রু কুঁচকে তাকাল যেন বানিয়ে বললাম। বেশ আনকমন নাম আপনার শেখর সাহেব। ধন্যবাদ। কথায় কথায় অনেক কথা হয়ে গেল বিশ মিনিটের যাত্রায়। তার একটা কন্ট্যাক্ট কার্ড দিয়ে বলল, এখানে আমার নাম্বার আছে। আপনি আপনার নাম্বারটা আমাকে পরে জানিয়ে দেবেন, কথা হবে।কার্ডটিতে না তাকিয়েই পকেটে গুজেঁ আমি নেমে গেলাম ঢাকা ময়মনসিংহ বাইপাসে। শুধু বলে দিলাম শুভ যাত্রা। সেই রাতে বারবার মনে হাজার হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম আমি। নিজেকে আবেগী চিন্তাভাবনা থেকে বিরত রাখা আর সেসব প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য আমার মস্তিস্কের হার্ডডিস্কে সংরক্ষিত নেতিবাচক নিয়মকানূনই যথেষ্ট ছিল ।আমি ঘুমিয়ে গেলাম আরো একটি ব্যস্ত দিনের সূচনার প্রতিক্ষায়।
(চলবে...)
আলোচিত ব্লগ
জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?
অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।

১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন
১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন
=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?
যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!
যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।