‘আম্মাজান ট্রেন ধইরবেন?’
‘জী চাচা।’
‘ট্রেন আইতে অহনও ম্যালা দেরী আছে আম্মাজান। হে আইবে তিনঘণ্টা লেটে। ট্রেনের ধর্ম হইতাছে পুরাতন জামাইয়ের মতো। জামাই পুরাতন হয়া গেলে যেমন সময়জ্ঞান হারায় ফেলে, ট্রেনও তেমন।’
বৃদ্ধের কথা শুনে নিধি হেসে ফেললো। বৃদ্ধ পরিস্থিতির অনুকূলতা উপলব্ধি করে বললেন, ‘আম্মাজান আমার কাছে আইশ্চর্য রকমের একটা চিরুনি আছে। অ্যাই দেহেন। চিরুনির মইধ্যে বাত্তি। কারেন্ট চইলা গেলে চিরুনি অটোম্যাটিক জ্বইলা উঠবে। অন্ধকারেও চুল আঁচড়াইতে পারবেন। দাম বেশি না, মাত্র ত্রিশ টাকা। একটা চিরুনি নিয়া যান।’
নিধির ভ্যানিটি ব্যাগে আছে চল্লিশ টাকা। ট্রেনের ভাড়া দশ টাকা। ত্রিশ টাকায় চিরুনি কিনলে তার ভ্যানিটি ব্যাগ এতিম হয়ে পড়বে। সে অপরাধীর মতো হেসে বললো, ‘না চাচা, লাগবে না।’
বৃদ্ধ হার মানলেন না। বললেন, ‘আপনি চিরুনিটা একবার ধইরা তো দেহেন আম্মাজান। দেহেন কতো সুন্দর চিরুনি। চীন দেশের চিরুনি। ত্রিশ টাকায় চীন দেশের চিরুনি পাওয়া যাইতাছে। এইটা কি চারটিখানি কথা আম্মাজান।’
নিধি হেসে বললো, ‘চীন দেশের চিরুনি আমার লাগবে না চাচা। আমার কাছে দেশি চিরুনি আছে। হাতির দাঁতের চিরুনি।’
‘তা তো থাইকবে আম্মাজান। দেশি চিরুনির লগে একটা বিদেশি চিরুনিও থাইকলো। বিদেশি জিনিস ঘরে থাইকলেই ঘরের সৌন্দর্য বাইড়া যায়।’
বৃদ্ধ নাছোড়বান্দা। নিধি বাধ্য হয়ে বললো, ‘না চাচা ঘরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য আমার কাছে আজ টাকা নেই। অন্য একদিন নেবো আপনার চীন দেশের চিরুনি।’
বৃদ্ধ হতাশ হয়ে বললেন, ‘ও আইচ্ছা টাকা নাই।’
নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়ে আরও এক ঘণ্টা হয়ে গেছে কিন্তু ট্রেনের কোন পাত্তা নেই। বৃদ্ধ স্টেশনে বিরক্তিমাখা মুখে বসে থাকা ললনাদের কাছে তাঁর চীন দেশের চিরুনির গুণকীর্তন করেই চলেছেন একইভাবে। তাঁর চীন দেশের চিরুনি কেনার আগ্রহ অবশ্য কেউ দেখাচ্ছে না। বাতি দেখে ললনারা ভাবছে চীন দেশের এই চিরুনি তাদের চুলের জন্য ক্ষতিকর হবে।
এক ঘণ্টা পর ব্যর্থ বৃদ্ধ আবার নিধির কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর মনে এখনো ক্ষীণ একটা বিশ্বাস উঁকি দিচ্ছে যে এই মেয়ে তাঁর একটা চিরুনি নিতে পারে। নিধি বললো, ‘চাচা, কয়টা চিরুনি বিক্রি হলো।’
বৃদ্ধ মুখ কালো করে বললেন, ‘অহনো একটাও হইলো নারে আম্মাজান।’
বৃদ্ধের করুণ মুখের দিকে চেয়ে নিধির ভেতরটা আর্দ্র হয়ে গেলো। কিন্তু তার করারও কিছু নেই। ভ্যানিটি ব্যাগ স্বাস্থ্যহীন। তার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো।
ট্রেন পুরাতন জামাইয়ের মতো হেলেদুলে চলে এলো এমনসময়। নিধি ট্রেনে উঠে পড়লো। বৃদ্ধের করুণ আশান্বিত মুখের ক্ষীণ বাতিটা নিভে গেলো নিমেষেই। জানালায় বসে নিধি দেখলো বৃদ্ধ করুণ চোখে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছেন। সে চেঁচিয়ে বললো, ‘চাচা এদিকে আসেন।’
বৃদ্ধ দৌড়ে জানালার কাছে এলেন। নিধি বললো, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? ট্রেনে উঠে পড়েন। ট্রেনে আপনার চীন দেশের চিরুনি অনেকেই কিনবে।’
বৃদ্ধ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললেন, ‘নারে আম্মাজান বিক্রি হয় না বেশি।’
নিধি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ত্রিশ টাকা বের করে বললো, ‘আপনার চীন দেশের চিরুনি দেন একটা।’
বৃদ্ধের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। নির্মল হাসি টেনে বললেন, ‘অ্যাই লন আম্মাজান।’
নিধির মনে জমে থাকা কষ্টের গাঢ় মেঘটা বৃদ্ধের নির্মল হাসিতে দূর হয়ে গেলো। চিরুনিটা না নিলে হয়তো মনের এই মেঘ তাকে বয়ে নিয়ে যেতে হতো। আহ! হাসি কি প্রবল মেঘদূরকারী!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ৮:৩৯