হারাদনের ছেলে সৌমিত্রের মন খারাপ। ছোট আব্বু জরুরী টেলিগ্রামে লিখেছেন,সৌম আমি তোর ছোট চাচ্চু হরিদাস লিখছি- বাড়ীতে সমস্যা হয়েছে তুই কালকের মধ্যেই গ্রামে আয়,চিন্তা করিস না সৌম কেউ মারাটারা যায়নি। হারাদন আর তোর মা সৌমিত্রা ভালোই আছে। তুই আসলে তাদের চোখের অপেক্ষাও কাটবে আর জরুরী কাজটাও হবে।দেখিস সৌমিত্র চিন্তায় বিড়ির মাত্রাটা আজ বাড়িয়ে দিস না। আসলে আমি আর তুই একসাথে চন্দার দোকানে চায়ের সাথে বিড়ি ফুঁকবো। ইতি তোর ছোট আব্বু হরিদাস।
সৌমিত্র বেশ ভাবনায় পড়ে গেল- সেই শীতলপুর কোলকাতা থেকে প্রায় ২০০ মাইলের পথ। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ভালো না। গাড়ী বলতে একটা পাহাড়ী ট্রেন,আর সকালে দুইটা বাস। এখন প্রায় সন্ধ্যা ৭ টা বাজে। পাহাড়ী সেই ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার সময় আর বেশি নেই। ১০ টায় কলকাতা ছেড়ে যাবে। সৌমিত্র খুব তাড়াহুড়া করে একটা গেঞ্জি আর ধূতি পাঞ্জাবি নিয়ে রওনা করে দিলেন ষ্টেশনের দিকে। পকেটে টাকা বলতে ছাত্র পড়িয়ে পেয়েছে ৫০০টাকা,এর মধ্যে মেছের খাওয়ার রসদ হিসেবে ব্যয় হয়েছে ৫০টাকা,সিগারেট বাবদ খরচ ৭০ টাকা। বাকি টাকা নিয়ে দ্রুত চললেন ষ্টেশানে।
সৌমিত্র বেশ চিন্তায় মগ্ন বাড়ীতে কিনা কি হল,আবার ভাবে না ছোট আব্বুতো বললো তেমন কিছুনা। এ বলে নিজেকে শান্তনা দিয়ে আবার শান্ত হয় সৌমিত্র।ষ্টেশানে পৌঁছে সোজা টিকেট কাটে সৌমিত্র। ১০টা বেজে গেছে ট্রেন আসেনি। ষ্টেশানের মাইকে ঘোষণা আসলো "আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি যে, পুরুলিয়ার রেল-লাইন উঠিয়ে দেয়ার কারণে আমাদের ট্রেন আসতে কিছুক্ষণ বিলম্ভ হচ্ছে,আপনারা সবাই ষ্টেশানের অপেক্ষা কক্ষে অবস্থান করার অনুরোধ করা হচ্ছে,ট্রেন আসলেই আমরা পুনঃরায় জানিয়ে দিব।ভালো থাকবেন"।
সৌমিত্র এদিক ওদিক ছাটা-হাটি করছে,কিছুটা বিরক্ত ভাব নিয়ে। এমনিতে কি বিপদ হয়েছে আর এদিকে ট্রেনটাও বিপদে পড়েছে। একটা সিগারেট জ্বেলে সৌমিত্র অপেক্ষা করতে লাগলো। অমন সময় একটা কোট পরা ভদ্রলোক বললেন আগুন আছে ? দাও তো । বুঝলে কপালটাই খারাপ,কাল শীতল পুর কোর্টে আমার একটা মামলা আছে
তাই সরকারির গাড়ীর অপেক্ষা না করেমদ্রুত যাবো বলে ট্রেনে আসলাম,কিন্তু না এখানেও বিলম্ভ। সৌমিত্রের সাথে বেশ ভাব জমেছে কোট পরা লোকটার ।উনি এডভোকেট,শীতলপুর জজ কোট।
আবার ঘোষণা আসলো"সম্মানিত যাত্রী সাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, শীতলপুর গামী পাহাড়ী ট্রেন অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই প্রথম লাইনে আসবে,তাই আপনারা প্রথমে লাইনের সামনে দাঁড়ানোর অনুরোধ করা হচ্ছে। আপনাদের ভ্রমণ শুভ হউক,ধন্যবাদ।"
সৌমিত্র আচ্ছা উকিল বাবু আপনার টিকেট কোন বগিতে পড়েছে? আমার "ঘ" বগিতে,তোমার আমারটাও "ঘ" বগিতে। সিট নাম্বার? সৌমিত্র-জ্বি আমার সিট নাম্বার ৮ ।ওহ! বলে উকিল বাবু বললেন আমার টা ১৭নাম্বার সিট।
ট্রেন এসে দাঁড়ালো প্রথম লাইনে,সোমিত্র একটা ঠান্ডা পানির বোতল আর একটা চিপস নিলেন সাথে। গাড়ীতে উঠে বসলেন সৌম।
আস্তে আস্তে ট্রেন চলতে শুরু করেছে শীতলপুরের দিকে। পাশে থাকা জানালার পাশের সিটটা খালি দেখে সৌমিত্র ভাবে ভালোই হয়েছে আরাম করে বাইরের দৃশ্য দেখা যাবে। সৌমিত্র যেয়ে ৯ নং মানে জানালার পাশে যেয়ে বসে। এই যে জনাব আপনাকে বলছি এটা আমার সিট,আমি ওয়াশ রুমে গিয়েছিলাম। সৌমিত্র অবাক হয়ে চেয়ে আছে মনে হচ্ছে সাক্ষাত দূর্গা তার সামনে এসে কথা বলছে। সৌমিত্র বললো অবশ্যই, বসেন। সিট ছেড়ে দিল সৌমিত্র।
ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে বেড়েছে,পাশে থাকা মেয়েটা তার মুখে হাত দিয়ে জানালার বাইরে তাঁকিয়ে রইল। মেয়েটার সারা পিঠ চুলে ডাকা। হঠাৎ বাতাসে সব চুল সরে গেছে,সৌমিত্র অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছে মেয়েটার ধাড়ের দিকে। আহ! কি সুন্দর গলা।
মেয়েটা বোধয় কিছুটা আচ পেল,তাকাতেই দেখে ছেলেটা তার ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সাথে সাথে মেয়েটা ওড়না দিয়ে ডেকে দিল নগ্নস্থান।
সৌমিত্র নিজের অজান্তে বলে উঠলো থাক না আরো কিছুক্ষণ এভাবে,সুন্দর কে দেখতে দাও। মেয়েটা চেঁচিয়ে বললো এই যে আপনার কি মাথা ঠিক আছে? কি আজে বাজে বলছেন,আপনার ঘরে মা নেই বোন নেই। ছিঃ ছিঃ।
মেয়েটা বেশ অভিমান করলো। সৌমিত্রের দোষ সৌমিত্র খুঁজে পেল না। কারণ তার কাছে মেয়েটা সুন্দর তাই সে সুন্দর অবলোকন করছে।এতে দোষের কিসের?
সৌমিত্রের মাথায় বুদ্ধি এলো-
সে তার ব্যাগ থেকে একটা ইংরেজী বই বের করে চোখের সামনে ধরে কবিতা আবৃত্তি করছে নিজে নিজে নিজ থেকে।
"মেয়েদের অভিমান করতে নেই,
তাদের সোভা পায় প্রেমে
মেয়ে মানে সুন্দর ,মানে গোলাপ
ভ্রমর আসলে ক্ষতি নেই।
মেয়েদের জানা উচিত যে গোলাপ অহংকারী
মানুষে ধরলেই আঘাত করে
অথচ! ভ্রমরের সাথে কি সখ্যতা।
নারী তুমি শীতল হও,
প্রেম দাও"
মেয়েটা একটু হাসলো। মেয়েটাও বললো
"বালকের বোধয় স্মৃতি লোপ পেয়েছে
তা না হলে কি ইংরেজী বইয়ে বাংলা কবিতা খুঁজে পায়।
তবে বলে রাখি বালকের কন্ঠ ভালো,সুন্দর
একদম বালকের পছন্দের নারীর মত"।
সৌমিত্র আবার বললো--
"মেয়ের বুদ্ধি আছে,চোখ আছে বোধয় তিনটে
না হলে কেমন করে পায় দেখতে?
আচ্ছা মেয়ের নাম কি দ্বিপাবলি
নাকি না জানা থেকে যাবি"
মেয়ে আবার বললো------
"নাম আমার অঞ্জলি,
ফুলের মাঝে তাই খেলা করি।
আচ্ছা বালকের নাম কি সৌমিত্র?"
সৌমিত্র বলে --
"সুন্দর নাম ,তবে বালিকা জানে কিভাবে
বালকের নাম?
অঞ্জলি বলে --
"বইয়ে লেখা আছে যে!"
তারপর অনেক কথা হলো তাদের ,এর মাঝে দুইজনের সাথে একটা মায়া জমেছে।
অঞ্জলি কোলকাতা ইডেনে পড়ে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে।
মাঝে মাঝে আসে উজানপুরে।তার দাদার বাড়ী।
এর মাঝে উজানপুর ট্রেন এসে দাঁড়ালো,সৌমিত্র মেয়ের চোখের দিকে তাঁকিয়ে দেখে চোখে জল জমেছে,বোধয় প্রেমের জল। সৌম মেয়েটার হাত ধরে বললো কোলকাতায় যেয়ে তোমার কলেজে যাবো,দেখা করবো। একসাথে গংঙ্গায় যাবো।
মেয়েটা একটা নাম্বার দিয়ে বললো এটা আমার বাসার নাম্বার সময় হলে ফোন দিও সৌম।সৌমিত্র আচ্ছা দিব। মেয়েটা নেমে পড়লো ট্রেন থেকে। সৌমিত্র একটা খেলা খেললো যদি মেয়েটা দুই বার পেছন ফিরে তাঁকায় তবে মেয়েটা তাকে ভালোবাসে।
অঞ্জলি ট্রেন থেকে নেমে তাঁকায়নি ,সৌমিত্র ভাবলো এ ধরণের মেয়ে গুলাই এমন হয়।
ট্রেন উজানপুর থেকে আবার যাত্রা শুরু করলো শীতলপুরের উদ্দেশ্যে। উজানপুরের ষ্টেশান পার হচ্ছে মাত্র অঞ্জলি হাত নাড়িয়ে তাকে বিদায় দিচ্ছে,সৌমিত্র তো অবাক!!!!!!!! আরে মেয়েটা আমায় এত্ত ভালোবেসে ফেলেছে সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সৌমিত্র নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেনা,এত ভালো মেয়েকে সে খারাপ ভেবেছে।
কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই,ট্রেনের গতি ঘন্টা ৪০ কিলো।
উজানপুর থেকে প্রায় দুই ঘন্টা পথ পেরিয়ে ট্রেন শীতলপুরে আসলো। সৌমিত্র নেমেই বড় নিঃশ্বাসে গন্ধ নিল তার জন্মস্থানের।তখন ভোর ৪টা। চার দিক থেকে ভেসে আসছে আজানের সূর। আস্তে আস্তে হচ্ছে ভোর,পাখি ডাকছে। ভোরের মৃদু বাতাস তার শরীর ঠান্ডা করে দিচ্ছে। বোধয় অনেক দিন পর সৌমিত্র তার নিজস্ব এলাকায় এসেছে বলে প্রকৃতি তাকে এভাবে আদর করে স্বাগত জানাচ্ছে। এগুলা ভেবে সৌমিত্র হাসে।
গোয়ালীরা এখনো আসেনি তাদের গরুর গাড়ী নিয়ে। সৌমিত্রের আর তস সইছেনা। কখন বাড়ী যাবে,কখন মায়ের হাতের রান্না খাবে।
সকাল ৭টা ভেজে গেছে একজন গোয়ালী আসলেন,সৌমিত্র চেপে বসলেন গরুর গাড়ীতে। গাড়িয়াল আস্তে আস্তে চলছে সৌমিত্রের বাড়ীর দিকে। শীতলপুর বাজার পেরিয়ে ফসল ভরা মাঠের মধ্যখানের রাস্তা দিয়ে গাড়ী আস্তে আস্তে চলছে।এ মনোরম দৃশ্য দেখে সৌমিত্রের গান শুনতে মন চাইলে। ভাওয়াইয়া গান।গাড়ীয়াল তার ভাওয়াইয়া গলায় গাওয়া শুরু করলেন জনপ্রিয় গান --
ওরে আগা নাও যে ডুব ডুব
পাছা নাওয়ে বইসো
ঢোঙায় ঢোঙায় ছ্যাকঙ জল রে
ও কইন্যা পাছা নাওয়ে বইসো........
-
ভরা গাঙের খেওয়া দিয়া রে
ও কইন্যা শরীল হইল্ মোর কালা।
গরুর গাড়ীর তাল আর গানের তালে যে সৌমিত্রের সময় কখন কেটে গেল বুঝতেই পারলোনা। বাড়ীর উঠানে গাড়ী এসে থামলো,অবুঝ মা দৌড়ে ঘর থেকে এসে জড়িয়ে ধরে "ও বাপ রে,এত দিন কনে ছিলে বাপ রে....... য়ে..........। তারপর মা ছেলের কি গল্প। সৌমিত্র গতবার কোলকাতায় যাওয়ার সময় একটা খরগোশের বাচ্চা রেখে গিয়েছিল। খরগোশ সৌমিত্রকে দেখা মাত্র লাফিয়ে কোলে বসে চুপচাপ শুয়ে গেল। সাধারণত খরগোশ লাফায় খুব কম, কিন্তু সৌমিত্রের প্রতি থাকা ভালোবাসা তাকে এত দিন পুঁড়াচ্ছিল তাই দেখা মাত্র লাফিয়ে কোলে উঠেছে।
দিন পুরিয়ে সন্ধ্যা নামল হারাদন আর হরিদাস দুই ভাই ফিরে এলো ঘরে। হারাদন ছেলেকে
বললো ভালো আছ বাপ? জ্বি আব্বা ভালো,আপনার কি খবর আব্বা? এই তো তোমাদের দোয়ায় ভালোই। হারাদন সৌমিত্রা(সৌমিত্রের মা) কে বললো কি গো রান্নাভাড়ার কাজ কি শেষ হলো। বাপ আমার অনেক দিন পর শহর থেকে আসলো,তারাতারি কর। বাপ বেটা একসাথে আরাম করে খাবো। হরি(হরিদাস সৌমিত্রের চাচা) যা তুই ও হাত মুখ ধুয়ে আয় ভাতিজার সাথে বসে খাবি,বললো হারাদন।
সবাই ফ্রেশ হয়ে খাওয়ার টেবিলে বসলো,রান্নার আইটেমে সৌমিত্রের সব প্রিয় খাবার।
কিছুটা অনাক ও হলো সৌমিক।মা সৌমিত্র সবাই কে স্বযত্নে পাতে ভাত তরকারি বেড়ে দিচ্ছে,এমন সময় বাবা হারাদন সৌমিত্রকে বললেন-আজকাল ছেলে মেয়েদের যা অবস্থা,আমাদের যুগে এরকম ছিলোনা।মা বাবা যাকে পছন্দ করেছে ছেলে মেয়েরা তাকেই বিয়ে করত। কিন্তু কালের ছেলে মেয়েরা তো বাবা মায়ের কথা শুনেই না বরং কি যেন লাভ ম্যারেজ ত্যারেজ করে। বড্ড বেয়াদব স্বভাবের হয়েছে। আমার আগাদ বিশ্বাস রয়েছে আমার ছেলে সৌত্রিম এ ধরণের নয়।আমি আর তোমার চাচা হরিদাস মিলে সিন্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে খুব শিখ্রই পাত্রীস্থ করবো।এ কথা শোনার পর সৌমিত্র হালকা শব্দে কাশি দিলেন,কিছুটা লজ্জা আর কিছুটা অঞ্জলির কথা ভেবে। আবার হারাদন বললেন ডাক্তার মশাই বললেন তোমার মায়ের শরীরের যা হাল হয়েছে এত বড় সংসার ,পুকুর,জমি,এগুলা একজনের দ্বারা দেখা সম্ভব হচ্ছেনা। তাই তোমার মায়ের সেবা যত্ন করার জন্য আমরা এ সিন্ধান নিয়েছি।তাই আমি হরিদাস কে বলেছিলাম তোমাকে টেলিগ্রাম করতে। পাত্রী কোককাতা থাকে,ওখানে পড়ালেখা করে।
বিয়ের পর বউ মা,সৌত্রিমা,হরি তোমাদের সাথে কোলকাতায় যাবে,তোমার মাকে কোলকাতায় ডাক্তার দেখাবে।
শোন আগামীকাল ২২ শে শ্রাবণ আমরা কন্যা দেখবে যাবো। এর মাঝে সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। সৌমিত্র উঠেই মায়ের ঘরে যেয়ে মাকে জড়িয়ে বললো- মা এখন না করলেই নয় বিয়ে। একটা কাজের মেয়ে রেখে দিলেই হয়।
কথার মধ্যখানে হরিদাস সৌমিত্রকে ডাক দিলেন।চাচা ভাতিজা চন্দার দোকানে যেয়ে সিগারেট ধরিয়ে গল্প করতে লাগলো,সৌমিত্র সব খুলে বললো অঞ্জলির ব্যাপারে।
চাচা সৌম কে বলে দেখ সৌমিত্র তোর বাপ হার্টের রোগী কষ্ট পেলেই মারা যাবে।
তুই যা ভালো বুঝিস তাই করবি।
পরের দিন বিকালে সৌমিত্রা দেবী,সৌমিত্র,হারাদন,হরিদাস রওনা করলো মেয়ের বাড়ীর দিকে।অনেক দুরের পথ,যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে গরুর গাড়ী আর মাঝে মাঝে তেল চালিত দুয়েকটা ট্যাম্পু পাওয়া যায়। সৌমিত্রের চাচা বুদ্ধি করে তিন আগ থেকে একটা ট্যাম্পু ঠিক করে রেখেছিল। তাই তাদের আর বিড়ম্ববনায় পড়তে হয়নি।সন্ধ্যার ছাপ পড়ে গেছে ,অল্প কিছুক্ষণ পর নামবে অন্ধকার। এর মাঝে ট্যাম্পু শীতলপুর পেরিয়ে উজানপুরের রাস্তার দিকে মোড় নিল।সৌমিত্রের আবেগের স্থানে খুব করে কড়া নাড়ল,ইস যদি অঞ্জলির বাড়ীর ঠিকানা জানতো। তাহলে হরি চাচাকে নিয়ে অঞ্জলির ফুলচন্দনে ভরা মুখবদন দেখতে পারতো। সৌমিত্রের মনের ভিতর বইছে এক ঝড়হাওয়া। কাউকে খুলে বলতে পারছেনা।
এর মাঝে গাড়ী এসে থামলো জয়নাথের বাড়ীর সামনে। জয়নাথ বাবু মেয়ের বাবা। তারা মেহমানদের বরণ করতে বাড়ীর গেইটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। জয়নাথবাবু ও তার স্ত্রী জয়শ্রীদেবী তাদের বরণ করে ঘরে নিয়ে গেলেন।
সবাই ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার দাবারের জন্য বসেছেন টেবিলে। খাবারের ম্যানুতে কি নেই। সব আছে খাসীর রেজালা থেকে শুরু করে কবুতরের মাংস কিছু বাদ রাখেনি জয়নাথ বাবু।
খাবার শেষে চলে পাত্রী দেখার লগ্ন।সৌমিত্রের মন খারাপ,মুখ কালছে বর্ন ধারণ করেছে। অমনিই মেয়ের মা সৌমিত্রকে বলে বসলেন পাত্রের কি মন খারাপ? খাবার কি ভালো লাগেনি বাবা? সৌমিত্র না না কি যে বলেন,আপনাদের আথিতেয়তা আমাদের মুগ্ধ করেছে।
মেয়ের মামী মেয়েকে নিয়ে হাজির হলেন সামনের রুমে।সৌমিত্রা বললেন আচ্ছা তোমার গোমটা উঠাও দেখি।মেয়ে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে গোমটা উঠালো। সৌমিত্র আড় চোখে তাকালো মেয়ের দেখি। ওমা এ কি কান্ড এ যে অঞ্জলি!!! সৌমিত্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। সৌমিত্রা দেবি মেয়ের নাম জিজ্ঞেসা করতে সৌমিত্র পাশ থেকে বলে দিলেন ওর নাম অঞ্জলি। সৌমিত্রা দেবি তো অবাক! এই দাঁড়াও তোমাদের কি পরিচয় আছে? হুম মা আছে। হরিদাস বললেন আর কি ভাতিজা,বিয়ে করতে কি কোন সমস্যা? কিযে বলো চাচা আমি কি বলেছে কোন সমস্যা।
জয়নাথ বাবু সহ সবাই আলোচনা করলে বিয়ে দিন তারিখ ঠিক করলো।ভাদ্র মাসের ২১ তারিখে তাদের বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক করে রাতেই রওনা করলো শীতল পুরের উদ্দেশ্যে।
সৌমিত্র মহা খুশি,মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান গাইছে। “তোমাকে দেখেছি ট্রেনে,এবার দেখবো আমার ঘরে”।
আজ ২১ শে ভাদ্র বিয়ের দিন সকাল,সবাই হৈ চৈ আর মাতামাতি করছে। চারদিকে উল্লাস আর উল্লাস। গোটা বাড়ীটা যেন আনন্দের বাগান হয়ে গেছে। কারো মুখে দুঃখ নেই। সবার মুখে হাসি আর সৌমিত্র আর অঞ্জলির জন্য দোয়া। দুপুর ১২ বারোটা সৌমিত্র বর যাত্রার জন্য তৈরি। কোলকাতা থেকে ভাড়া হয়েছে সৌমিত্রের জন্য প্রাইভেট কার। সৌমিত্র আর মা গাড়ীতে উঠে বসলেন। বর যাত্রা শুরু হয়ে গেল। মা ও সৌমিত্র বেশ খুশি। সৌমিত্র মাকে বলছে “অঞ্জলি যদি তোমাকে কষ্ট দেয় তাকে আমি কষ্ট দিবো” সৌমিত্রা বলছে”ও এ রকম মেয়েই না,আর ও আমার আরেক মেয়ে”।
হঠা গাড়ী থামলো রাস্তার মাঝখানে,খবর এলো বলে সবাই হৈ চৈ করে উঠেছে। সৌমিত্রের মা বলছে বোধয় ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে তাই তারাতারি যেতে খবর পাঠিয়েছে।
হারাদন সৌমিত্রাকে গাড় থেকে নামতে বললেন—সৌমিত্রা কথা বলে আবার গাড়ীতে উঠে বসলেন। উঠে আবার গল্প শুরু করেছেন।আচ্ছা সৌমিত্র ধর তোর মা মারা গেছে তুই সইতে পারবি? না মা আমি সইতে পারবোনা। মা হা হা হেসে বললো আমাকে দিব্বি দে আমার মরার পর তুই কাদবিনা? অনেক জোর করে সৌমিত্রকে রাজি করায় সে কাদবেনা।
গাড়ী ছুটে চললো উজানপুরের দিকে--------
সৌমিত্রা দেবি জল পানের জন্য গাড়ীটা থামাতে বললেন,গাড়ীটা ঠিক অঞ্জলির বাড়ীর আধা মাইল সামনে এসে থামলো। তারপর মা পানি পান করে গাড়ীতে উঠলেন। গাড়ী আস্তে আস্তে আবার চলা শুরু করলো। হঠা সৌমিত্রার বুকে ধরেছে,সে চটপট করছে করছে। সৌমিত্র চিঠকার দিয়ে তার বাবাকে ডাকলেন। বাবা এসে দেখে সৌমিত্রা আর নেই।
পাশে পড়ে রইলো একখানা চিঠি--- লেখা ছিল---
প্রিয় সৌমঃ- তোকে হাসি মুখ ছাড়া কখনো দেখতে আমি পারবোনা। তোর কিছু হলে আমি নিজে বাচতে পারবোনা। আজ সকালে খবর এসেছে অঞ্জলি আর নেই।আমরা তোকে বলতে পারিনি,অঞ্জলির প্রতি তোর প্রেম দেখে। আমরা সবাই যাচ্ছিলাম তাকে চিরবিদায় জানাতে। আমি মা হয়ে কিভাবে আমার ছেলের কান্নাভরা মুখদেখি বল,আর তুই বা অঞ্জলির নিথর মুখ কিভাবে দেখবি। তাই প্লান করে আমি বিষ খেয়েছি যাতে অঞ্জলির প্রথম দেখা সেই মুখ তোর চোখে থাকে। বিদায়……।। সৌম তুই মাকে কথা দিয়েছিস কাদবিনা।
সৌমিত্র পাগলের মত হাহা করে হাসে,সে এখনো হাহা করে হাসে। সেদিন থেকে এভাবে হাসে। হেসে হেসে উজানপুর আর শীতলপুরের মায়ের চিতায় যেয়ে হাসে। সবাই তাকে পাগল বলে। আচ্ছা পাগলরা কি দুঃখী হয়?
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১০:৪৬