একটা ভয়ংকর কিশোরের সাথে পরিচয় ছিল। সে নিজের আপন বাবা- মা কে খুন করতে তীব্র ইচ্ছা পোষণ করে। ১৫-১৬ বছরেরএই কিশোরের ভয়ংকর সাইকোলজি চ্যাঞ্জ করব বলে মনে মনে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। চ্যালেঞ্জে ফেল করেছি।
অপমানের সাথে ফেল করেছি।
প্রথম সাক্ষাতে প্রথম কথা হিসেবে সে আমাকে বলল, দেখেন ভাই, আপনাকে ফার্স্টেই ক্লিয়ার কাট কিছু কথা বলি। আপনি আমাকে পড়াতে আসছেন, পড়াইয়া চলে যাবেন। আমাকে পড়তে প্রেশার দেবেন না। তাতে কোন লাভ নাই। আপনি আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না, আমিও আপনাকে ডিস্টার্ব করব না। হিসাব সোজা।
আমি ভালো রকম চমক খেলাম। ছাত্র সামনের বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। সেই ১৫-১৬ বছরের একটা ছেলের প্রথম কথা যদি এরকম হয় তবে খানিকটা ভয় পাওয়ারই কথা।
ছাত্রের বাসা মিরপুর। মা ব্যাংক অফিসার। বাবা কি করেন জানি না। তবে বড়সড় একটা কিছু যে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আমি বললাম, তুমি পড়তে চাও না কেন?
সে তার হাতের ব্রেসলেট নাড়াতে নাড়াতে বলল, কারণ পড়তে ভালো লাগে না। সোজা হিসাব।
আমি বক্তব্য দেয়ার মতো করে বললাম, দেখো ভালো লাগে না বলে সব কাজ করা যাবে না এমন না। এত জ্যাম ঠেলে কষ্ট করে আমার আসতেও কিন্তু ভালো লাগে নি। তারপরও কেন আসলাম?
কারণ আসতেই হবে। আমার টাকার দরকার।
তোমার পড়তেই হবে, কারণ তোমার পড়ার দরকার।
ছাত্র মুখ কুঁচকে বলল, ভাই আরেকটা কথা বলি?
আমাকে জ্ঞান দেবেন না। বাপ মায়ে বহু জ্ঞান দিছে। ঘ্যান ঘ্যান ভাল্লাগেনা। আপনি টাকার জন্য আসছেন না?
চুপচাপ অংক করায়া টাকা নিয়া যান। আপনারে তো আমি ডিস্টার্ব করছি না।
হিসাব সোজা।
আমি চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রইলাম। মোটামুটি ভালো রকম অপমান। একটা বাচ্চা ছেলে এ রকম অপমান করবে সেটা অকল্পনীয়।
কোনমতে ঘন্টাখানেক সময় পার করে চলে আসলাম।
পরের দিন যথারীতি ছাত্র হাতে ফোন, ব্রেসলেট এবং শর্টস পরে এসে বসল।
আমি অংক করাচ্ছি, সে ফেসবুকিং করছে। দুইজন দুই জগতে। নিজেকে তখন ভয়াবহ দুর্বল মানুষ মনে হচ্ছে।
তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ছেলেটা আমার জন্য একটা এসাইনমেন্ট। এর সাইকোলজি আমি বদলাবই।
আমি অংক করা বাদ দিয়ে বললাম, কি করো?
সে উৎসাহের সাথে বলল, ফেসবুক চালাই। একটা পিক দিসি আজ। ১২২ টা লাইক পড়েছে।
- তাই নাকি?
- হাঁ। আপনার আইডি আছে?
- আছে।
- দেন তো।
আমি আমার সেকেন্ড আইডি দিলাম। সেই আইডির প্রো পিকে ৭ টা লাইক।
ছাত্র হাসতে হাসতে বলল, মাত্র ৭ টা লাইক? চিন্তা কইরেন না, আপনারে প্রমোট দেব। একদিনে লাইক ৫০ এ চলে যাবে।
আমি উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, আচ্ছা দিও তো। এবার তাহলে অংকটা দেখো।
ছাত্র প্রথমবারের মতো একটু দ্রবীভূত হলো। তার ভেতর থেকে খানিকটা কাঠিন্য দূর হলো। তবে তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। মাঝে মধ্যে খাতার দিকে তাকালেও তার চোখ
মোবাইলেই পড়ে রইল।
আমি আবার অংক করা বাদ দিয়া বললাম, পড়ালেখা বাদ দিই। আসো গল্প করি। তোমার পছন্দের একটা গল্প বলো।
ছাত্র অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। টিচার গল্প শোনতে চাইবে এটা স্বাভাবিক কিছু না।
সে তার প্রেমের গল্প শুরু করতে লাগল।
ক্লাস টেনের একটা ছেলে প্রেম করছে, প্রেমিকা নিয়ে ঘুরছে এটা উপাদেয় গল্প না। আমি আমার ফোন টিপতে লাগলাম।
সে কিছু সময় পর মুখ কঠিন করে বলল, আপনি কিন্তু আমার গল্প শুনছেন না।
- শুনছি।
- না, আপনি আমাকে ইনসাল্ট করছেন। আমার কথার সময় ফোন টিপছেন।
আমি মুখ তোলে হাসিমুখে বললাম, একটু আগে আমি কথা বলার সময় তুমি ফেসবুকিং করেছো। আমাকে ইনসাল্ট করো নি?
সে একটু হতভম্ব হয়ে বলল, ঐ টা তো পড়া, এইটা গল্প।
- দুইটাই অপমান।
- আচ্ছা স্যরি ভাই।
এই একটা "স্যরি" শব্দের তাৎপর্য তখন আমার কাছে অসামান্য ছিল। সে আবার গল্প শুরু করল।
মাঝখানে কথা বললেন আন্টি। পাশের ঘর থেকে চিৎকার করে বললাম, নয়ন এত গল্প কিসের? পড়তে হবে না?
কথাটা যে নয়নকে না, ঝি কে মেরে বৌ শেখানোর আদলে আমাকে বলা হয়েছে এটা সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম।
আমি অংক করতে লাগলাম। সে ফোন টিপতে লাগল।
এভাবে চলল আরো দুই দিন। পরের দিন আমি তাকে একটা প্রস্তাব দিলাম। অর্ধেক সময় আমি তার গল্প শোনব, অর্ধেক সময় সে অংক দেখবে।
সে সানন্দে রাজী হয়ে গেল। তার পেটে অজস্র গল্প। তার শ্রোতা দরকার।
গল্পের এ পর্যায়ে আবারো আন্টি বাগড়া দিলেন। ভদ্রমহিলা অদ্ভূতভাবে অংকের বাইরে কিছু বললেই শোনতে পান এবং সাথে সাথে চিৎকার মারেন, "এত গল্প কিসের?"
কিছু দিন পর ভয়াবহ কথাটা শোনলাম।
আমি পড়ানোর ফাঁকে বললাম, নয়ন তোমার জীবনের ইচ্ছা কি?
সে বলল, ভাই জীবনের ইচ্ছা সোজা। একটা গাড়ি থাকবে,সাথে চারটা মেয়ে থাকবে...
- চারটা মেয়ে?
- হাঁ চার সিটে চারটা। সারা দিন মেয়ে গুলো নিয়ে ঘুরব, ফিরব..ইচ্ছামতো টাকা উড়াব।
আমি বললাম, তোমার উড়ানোর টাকা আর গাড়ির টাকা কে দেবে?
- বাপ মায়ে দেবে। বাপ মায়ের টাকার অভাব? আমারে না দিলে তারা কারে দিবে?
- যদি না দেয়?
ছেলেটা এবার মুখ কঠিন করে বলল, ভালো মুখে না দিলে পেটে ছুরি ঢুকাই দেব। জবাই করে দেব দুইটারে। হিসাব সোজা।জীবন তিঁতা বানাই দিচ্ছে।
- তুমি সিরিয়াস?
- খোদার কসম। আমারে কম প্যারা দেয় নাই। জীবনটা তছনছ করো দিল।
আমি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। একটা বাচ্চা ছেলে বাবা মা কে খুন করবে!
সে "খোদার কসম" বলে ডিটারমাইন্ড। এটা কি সাময়িক ফ্যান্টাসী নাকি বহু দিনের ইচ্ছে?
একবার মনে হলো গার্ডিয়ানকে ইনফর্ম করি। পরে সিদ্ধান্ত বদলালাম। ইনফর্ম করে কোন লাভ হবে না। আমি আবারো মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম একে লাইনে আনবোই।
প্রথম পনের দিনে আমি তাকে কিছুই শেখাতে পারি নি।
২০ দিনের মাথায় একদিন পিথাগোরাসের উপপাদ্য করার আগে আমি তাকে বললাম, তুমি এই উপপাদ্য একবার দেখাই দেয়ার পর যদি করতে পারো তবে তোমার জন্য গিফট আছে।
সে উৎসাহের সাথে বলল, যদি করতে পারি?
- জীবনেও পারবা না। আমি ছাত্র চিনি।
- আমি পারবোই।
সে প্রথমবারের মতো খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখল।
তারপর সত্যি সত্যিই নিজে নিজে করে ফেলল। তার মুখে বিজয়ীর হাসি, আমার মুখে তারচেয়ে বড় হাসি। তাকে লাইনে আনার প্রাথমিক ধাপ সফল।
আমি তার ভূয়সী প্রশংসা করলাম। ছাত্র হিসেবে যে সে চরম মেধাবী, কেবল মনোযোগ দিলে ইতিহাস করে ফেলবে এমন উদ্বৃতি দিলাম।
সাথে সাথেই দৃশ্যপটে আগমন ঘটল ছাত্রের মায়ের।
তিনি চোখ মুখ উজ্জ্বল করে বললেন, দেখছেন স্যার! আমার ছেলে কত ব্রিলিয়ান্ট! দেখছেন স্যার?
আমি বুঝতে পারলাম মহিলা কোনভাবে কান পেতে আমাদের কথা শোনেন। তিনি মিনিট পাঁচের তার ছেলে যে কত লক্ষী তার ফিরিস্তি দিলেন।
আমি ফিরিস্তি শোনলাম না, কল্পনায় দেখলাম টাকার কারণে ছেলে তার মায়ের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
পরের দিন থেকে আমি তার ফোন হাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হলাম। সে শর্ত দিল ফোনের বিনিময়ে পড়ার শেষ অর্ধেক সময় তার সাথে গল্প করতে হবে।
পড়া শেষ করে গল্প শুরু করতেই আবারো গার্ডিয়ানের হুংকার।
" পড়া বাদ দিয়ে এত গল্প কিসের নয়ন! এক্সাম না সামনে? পড়ো"
ছাত্র চাপা স্বরে বলল, বলেন ভাইয়া, এই মায়েরে জানে মরা উচিত না?
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
:
মাস শেষ হয়ে গেল। মাস শেষে ফোন মারফত জানতে পারলাম আমার চাকরি নট।
সম্ভাব্য কারণ, পড়ালেখার চেয়ে গল্প বেশি হয়ে যায়!!
তারা পড়ানোর জন্য টিচার রাখেন, গল্পের জন্য না।
আমি সিরিয়াস রকমের তব্দা খেলাম।
একজন সরকারি ব্যাংক অফিসার মহিলা খবরও জানেন না তার ছেলে কত ভয়ংকর সাইকোলজি নিয়ে ঘুরছে।
এই ছেলের মাথা গাড়ি, চারপাশে চারটা মেয়ে ঢুকে আছে তিনি বলতে পারেন না।
ছেলে যে টাকার জন্য তার পেটে "ছুরি ঢোকানোর" পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সে ব্যাপারেও বেখবর।
তার ছেলের জীবন কত "সোজা হিসাব" এ চলছে সেটা যদি জানতেন!
যদি একটু জানতেন তবে গল্পের ফাঁকে বাগড়া দিতে আর শেষমেষ চাকরি নট করার আগে একটু হলেও ভাবতেন।
আমি চাকরি হারানোর অপমান-দুঃখ ভুলে ভাবতে বসলাম।
দোষটা তবে কার?
একটা কিশোর ছেলের নাকি শিক্ষিত মা-বাবার?
ছেলেকে খাইয়েছেন। দামি ফোন কিনে দিয়েছেন, বাই সাইকেল দিয়েছেন। প্রতিদিন হাত খরচের জন্য কয়েকশ টাকা দান করেন। কয়েক ডজন টিচার রেখেছেন।
গর্বভরে এই খবর আমাকে দিয়েছেন। ছেলের মানসিকতা বা জীবন দর্শন সম্পর্কে জানার দরকার বোধ করেন নি।
ছেলের গল্প, তার ভেতরের মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করেন নি।
ডিয়ার শিক্ষিত গার্ডিয়ানস, আপনাদের মোটেই উপদেশ দিচ্ছি না,
কেবল অনুরোধ করছি- টাকা পয়সা সব না। ফোন-বাইক-দামি কলেজ-দামি টিউটর সব না।
এসব দিয়ে একটা শিশু-কিশোর-কিশোরীর কোন উপকার আপনি করছেন না।
আপনি তার সাথে বসুন, গল্প করুন। তার ভেতরের সত্ত্বাটাকে বের করে নিয়া আনার চেষ্টা করুন।
তার চাহিদা পূরণের চেয়ে তার সুস্থ ইচ্ছে পূরণকে প্রাধান্য দিন।
তার ভেতর অবশ্যই কিছু না কিছু ভালো আছে। সেটাকে হাইলাইট করে তাকে উৎসাহ দিন। তার প্রশংসা করুন।
একটা শিশুকে কোনটা ভালো কোনটা খারাপ বোঝানোর আগে নিজে বুঝুন সত্যিই আপনার সন্তানের জন্য কোনটা ভালো কোনটা খারাপ।
নিজের গর্ভে এনে যাকে নিয়ে গর্ব করেছেন আপনার নিজের অজান্তে সে ঐশী হয়ে যাচ্ছে না তো?
ভাবনার অনুরোধ রইল
#ফেসবুকের এক বড় ভাইয়ের পোস্ট থেকে কপি করা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ৯:৪৩