আজ এইচএসসি'র রেজাল্ট দিয়েছে, কিন্তু আমি বলছি এসএসসি'র রেজাল্টের কথা। আমার বোন এসএসসি-তে ৪.৪৪ পেয়েছে!
কাড়ি কাড়ি এ প্লাসের যুগে এই ফলাফলে সে ভয়াবহরকম হতাশ। তার ধারণা ছিল সে গোল্ডেন এ প্লাস, বা নিদেনপক্ষে এ প্লাসতো পাবেই। ফলাফল প্রকাশের পর সে ভেঙে পড়েছে। ভেঙে পড়ার সঙ্গত কারণ ছিল। তার বড়ভাই প্রবল অর্থাভাব, দারিদ্রে বেড়ে উঠেছে, নানান সীমাবদ্ধতা ডিঙিয়ে পড়াশোনা করেছে। মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় অবধি এসেছে। এই ঘটনা আম্মা তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতেই থাকতেন, 'তোর ভাইয়া এতো কষ্ট করে পড়াশোনা করে কত ভালো করছে, আর তোর তো কোন অভাব নাই। যখন যা বলিস, চাস, বলার আগেই, চাওয়ার আগেই হাজির! তুই কেন ভালো করবি না?'
আম্মা সম্ভবত এই কথা বলেন তাকে উৎসাহিত করতে, কিন্তু আদতে এটি প্রেসার ক্রিয়েট করে। একধরণের প্রতিযোগিতা তৈরি করে। এই প্রতিযোগিতা কি সকলের জন্য ভালো? সকলেই কি প্রতিযোগিতায় ভালো করে?
করে না।
এর প্রমাণ আমি নিজে। আমি কখনোই দশজনের সাথে প্রতিযোগিতায় ভালো নই। আমি বরং একা একা আমার কাজ করতে পছন্দ করি। প্রতিযোগিতা মানে আমার কাছে রুদ্ধশ্বাস এক ব্যাপার। প্রবল তাড়াহুড়া, স্নায়ু চাপ, নিজের ভালো করার চিন্তার ভেতর সবচেয়ে বেশি থাকে অন্য প্রতিযোগিদের ভালো মন্দের চিন্তা। কে আমার চেয়ে কতোটা এগিয়ে, কতোটা পিছিয়ে এই ভাবনা! তখন নিজের কাজ ার নিজের মতন হয় না, হয় অন্যের মতন।
ফলাফল নিয়ে আম্মার মন খারাপ। আমার বোনের মন খারাপ। তাদের দুজনেরই ধারণা এই ফলাফল আমাকে বললে আমি রেগে যাব। যদিও বছর কয় আগে আমার বোনের ক্লাস রোল নম্বর ৩ থেকে যখন ৬ এ চলে গেল, তখন সেই সংবাদ দিতে এসে সে কাচুমাচু মুখে দাঁড়াতেই আমি বলেছিলাম, 'রেজাল্ট কান্ট ডিফাইন ইউ। সো ফলাফল আসলেই সত্যিকারের মানদণ্ড না। তোর রেজাল্ট নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। আমার মাথা ব্যাথা তোর জানাশোনা নিয়ে'।
কিন্তু এসএসসি'র ফলাফল দেয়ার পর সে ভেঙে পড়েছে। ভেঙে পড়ার কিছু কারণও রয়েছে। এই বছর তার ছোট্ট জীবনে নানান অসফলতার, ব্যর্থতা, ভুলের ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং তার বদ্ধমূল ধারণা, এই ২০১৬ তার জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়!
সময়!
তার রেজাল্ট শুনে যে আমার একটুও মন খারাপ হয় নি, তা না। আমি আমার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে তার এইটুকু বয়স থেকে চেষ্টা করেছি তার বস্তুগত সম্ভাব্য সকল প্রয়োজন মেটাতে, একই সাথে চেষ্টা করেছি তার মনোজগতকে যতটা সম্ভব সমৃদ্ধ করতে, উন্মুক্ত করতে। ভাবনার প্রান্তর ছড়িয়ে যেতে। গাইবান্ধা যাচ্ছিলাম, বাসে বসেই তার রেজাল্ট পেলাম। ফোন দিতেই সে ভারী গলায় বলল, ভাইয়া, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! আমি সবকিছুর জন্য সরি ভাইয়া... এই ২০১৬ আসলেই আমার জন্য খারাপ সময়...'
আমি জানি, এটাই সেই সময়, যেই সময় একজন মানুষ ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে, টুকরোটুকরো হয়ে যেতে পারে। আবার এটিই সেই সময়, যখন একজন মানুষ উঠে দাঁড়াতে পারে। তারপর দৌড়াতে পারে, তারপর ডানা মেলে উড়ে যেতে পারে স্বপ্নের আকাশে!
আমি বললাম, 'সময়ের ভালো মন্দ কিছু নেই। সময় হচ্ছে সময়! সময়টাই আসল, ভালো বা মন্দ না। আজ এই মুহূর্তে যেই ঘটনাটি জীবনের সবচেয়ে খারাপ ঘটনা বলে মনে হচ্ছে, আজ থেকে ৫ বা ১০ বছর পরে এই ঘটনাটিই মনে হতে পারে জীবনের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক ঘটনা। সুসময়। আবার আজ যে সময়টা মনে হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত, সেই সময়টাকেই ৫ বা ১০ বছর পর মনে হতে পারে জীবনের সবচেয়ে বিষাদময় সময়'।
সে অবাক গলায় বলল, 'কিভাবে?'
আমি বললাম, 'যে ছেলেটি বা মেয়েটি আজ এপ্লাস, গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে আনন্দে মত্ত, সেও তার জীবনের পরবর্তী গল্পে এমন সফল নাও হতে পারে, হতে পারে এই সফলতা তাকে বেপথুও করে ফেলতে পারে। আবার এই সফলতা তার ভেতরে আরও সফলতার ক্ষিদেও চাগিয়ে তুলতে পারে। তবে এসকলই নির্ভর করছে তার জীবন দর্শনের উপর। সে সফলতা কিংবা ব্যর্থতাকে কিভাবে নেবে! এই জীবনদর্শন, জীবনবোধটা খুব দরকার। খুব। নাহলে আজকের এই সফলতার ভেতরেও লুকিয়ে থাকতে পারে ৫ বা ১০ বছর পরের কোন বড় ব্যর্থতার গল্প! আবার আজকের এই ব্যর্থতার গল্পেও লুকিয়ে থাকতে পারে ৫ বা ১০ বছর পরের কোন বিশাল সফলতার গল্প'।
আমি খানিক থেমে আবার বললাম, 'জীবনে সফলতার যেমন প্রয়োজন, প্রয়োজন ব্যর্থতারও। ক্রমাগত ব্যর্থতা যেমন কাউকে ভেঙেচুড়ে দেয়, আবার কাউকে কাউকে শক্তও করে। সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার প্রয়োজনও কম নয়। একজন মানুষ ক্রমাগত সফল হতে থাকলে সে হয়তো সফলতার মূল্যটা বোঝে না। আসলে সফলতা বুঝতে হলে আগে দরকার ব্যর্থতা। আর জীবনে ব্যর্থতা বা "খারাপ সময়ের" প্রয়োজন কখনও কখনও 'ভালো সময়ের' চেয়েও বেশি। 'খারাপ' বা অসফল সময় মানুষকে যা দেয়, তার নাম অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা ক্রমাগত সফলতায় নেই। জীবনে এই অভিজ্ঞতার চেয়ে অমূল্য, তুল্য কিছু নেই! সুতরাং ২০১৬ সালে যে নেতিবাচক ঘটনাগুলো ঘটেছে, যে ভুলগুলো হয়েছে তা হয়ে উঠতে পরের কোন দুর্দান্ত সফলতার গল্পের বীজ। এই ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা অজস্র সফলতার গল্পের নিয়ামক হতে পারে। ইচ্ছে থাকলেই পারে...'
সে বলল, 'আমি আর কমার্স নিব না? আমি কি আর্টসে চলে যাব?'
আমি বললাম, 'কেন?'
সে বলল, 'জানি না। মনে হচ্ছে কমার্স নেয়ার কারণে আমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে...'
আমি বললাম, 'না জানলে হবে না। নিজের শক্তির জায়গাটা নিজেকে জানতে হবে। একটা মানুষের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই চলে যায় নিজের শক্তির, মেধার জায়গাটা জানতে। এই জানাটা খুব জরুরী। না জানলে সে ভুল জায়গায় ভুল মানুষ হিসেবে সারা জীবন ধরে ভুল চেষ্টাটা করতে থাকবে। ফলাফল হবে শূন্য। সে নিজেকে ভাবতে থাকবে মেধাহীন, অথর্ব। সম্ভবত আইনস্টাইন বলেছিলেন, ''Everybody is a genius. But if you judge a fish by its ability to climb a tree, it will live its whole life believing that it is stupid.' প্রত্যেকটা মানুষ জিনিয়াস। তবে তাদের সকলের মেধার জায়গাটি এক নয়। যদি তারা ভুল জায়গাটি বেছে নেয়, তবে সারাজীবন তাদের কেটে যাবে নিজেকে স্টুপিড ভাবতে ভাবতেই... ফলে যে ছেলেটি একাউন্টিং এ ভালো, সে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলে একটা সময় নিজেকে মেধাহীন মনে হবেই, যে ছেলেটি অংকে ভালো, সে দর্শন পড়তে গেলে নিজেকে ব্যর্থ ভাবতেই পারে!
সে কী বুঝল জানি না। বলল, 'আমি তাহলে কিছুদিন সময় নেই ভাবতে?'
আমি বললাম, 'সিওর'।
সে বলল, 'ভাইয়া, আমি সামনে ভালো করব, অবশ্যই করব'।
আমি বললাম, 'তুই এইবারও ভালো করেছিস। খুবই ভালো করেছিস...'
সে কথা বলল না, চুপ করে রইল। আমার কেন যেন মনে হল তার সেই চুপ করে থাকার ভেতর ক্রমশই দৃঢ় হচ্ছে আগামি দিনের সংকল্পরা!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ৮:১৩