somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঈশা খাঁ এবং বারো ভূঁইয়াদের ঐক্যের নেপথ্যে

১৮ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


“বারো ভূঁইয়া” শব্দটি একটি ঐক্যের নাম। এ ঐক্য জনগণের কোন ঐক্য নয়। সরাসরি সামন্ত রাজাদের মধ্যেকার ঐক্য। এই ঐক্যই বাংলায় মোগল সাম্রাজ্যের কম্পন থামিয়ে দিয়েছিল। এটি মোগল আমলের একটি বিরল ঘটনা। এরকম দৃঢ় ঐক্য নিয়ে মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ সময় টিকে থাকার ঘটনা কেবল মাত্র বাংলায়ই ঘটেছিলো। মোগল আমলে এমনটি আর কোথাও দেখা যায় নি। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টানা ৩৫ বছর বারো ভূঁইয়ারা এককভাবে এ অঞ্চল শাসন করেছিলেন। এই ঐক্যের কারণে জনগণের যে খুব একটা লাভ কিংবা ক্ষতি হয়েছিল বিষয়টা সেরকম ছিলো না। বারো ভূঁইয়ারা এখানকার জনগণকে শোষণ করেই টিকে ছিলেন। জনগণকে তখন বাধ্যতামূলক ট্যাক্স দিতে হত। ট্যাক্স না দিলে নির্যাতন এক সাধারণ বিষয় ছিলো। মোগলরা আসলে এটাই করতো। কিন্তু পার্থক্যটা অন্য জায়গায়। নিজ নিজ সিংহাসন রক্ষার্থে কম বেশি বারো জন সামন্ত রাজা তখন ক্ষমতার প্রশ্নে একাট্টা হয়েছিলেন। তবে ভূঁইয়াদের সংখ্যা ঠিক বারো ছিলো না। কখনো সংখ্যাটি বারো থেকে উপরে উঠেছে কখনো নিচে নেমেছে। এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যেও প্রশ্ন রয়েছে। তবে একদল সামন্ত রাজা তখন মোগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এ সত্যটিকেই আমাদের গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন রয়ে যায় বারো ভূঁইয়ারা এমন বিদ্রোহ করলেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের শুরু করতে হবে ঈশা খাঁ থেকে। বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে প্রধান নেতৃত্বের নাম ছিলো ঈশা খাঁ। ঈশা খাঁর জন্ম ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল পরগণায়। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার এক রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করে ঈশা খাঁ তার জমিদারি শুরু করেন। শুরু হয় ঈশা খাঁ’র প্রতাপশালী শাসন। মূলত ঈশা খাঁর নেতৃত্বেই অন্যান্য জমিদাররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তখন মোগল সাম্রাজ্যের বিপরীতে অবস্থান নেন। তাদের এই ঐক্যই ইতিহাসে “বারো ভূঁইয়া” নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু কী ই বা দরকার ছিলো এত কট্টোর মোগল বিরোধীতার? ঈশা খাঁ’রা চাইলে তো মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করে বেশ থাকতে পারতেন। বেশনিরাপদ থাকতে পারতেন তারা। কিন্তু বিদ্রোহের দরকার ছিলো বটে! কারণ ঈশা খাঁর বাবাকে মোগল বিরোধিতার জন্য হত্যা করা হয়েছিলো। খোদ মোগলরাই তারা বাবাকে হত্যা করে। শের শাহের মৃত্যুর পর যখন ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন ঈশা খাঁ’র বাবা সুলেমান খাঁ দিল্লীর বশতা স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। এর ফলাফল স্বরূপ সুলেমান খাঁ কে নিজ জীবন দিতে হয় এবং ঈশা খাঁ কে তখন বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল এক বণিকের কাছে। পুরো ঘটনাটি মোগল চক্রান্ত অনুসারে সম্পন্ন করা হয়েছিল। ঈশা খাঁ সেই অতীত সারাটি জীবন মনে রেখেছিলেন। মূলত এখানেই রচিত হয় ঈশা খাঁ’র কট্টোর মোগল বিরোধিতার প্রেক্ষাপট। বড় হয়ে এই ঈশা খাঁ হয়ে ওঠেন দোর্দ্দন্ড প্রতাপশালী।
মোগল সম্রাটদের এক বড় চিস্তার কারণ হয়ে দাঁড়ান ঈশা খাঁর নেতৃত্বাধীন এই বারো ভূঁইয়ারা। বারো ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েও মোগল সম্রাটদের ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয়। আকবরের মতো দিগ্বীজয়ী সম্রাট এই বারো ভূঁইয়াদের শায়েস্তা করতে ব্যর্থ হন। শেষ মেষ এই বারো ভূঁইয়াদের সাথে খোদ আকবরকে মীমাংসার টেবিলে বসতে হয়েছিল। মীমাংসার টেবিলে বসে আকবর তার বন্দী সৈন্যদের মুক্ত করে নিয়ে যান ঠিকই কিন্তু বারো ভূঁইয়াদের মন থেকে মোগল বিরোধিতা বিন্দুমাত্র দূর করতে পারেন নি। ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর তার ছেলে মুসা খাঁ সিংহাসনে বসলেও ঠিক থাকে বারো ভূঁইয়াদের ঐক্য। এখন প্রশ্ন হলো বারো ভূঁইয়ারা কিভাবে এরকমটি করতে পারলেন? তৎকালীন বাংলার উপর এই ঐক্যের প্রভাবটাই বা কি ছিলো?

এটি নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হবে যে বারো ভূঁইয়াদের সাহসই ছিলো তাদের শক্তির অন্যতম উৎস। তারা সামরিক দিক বিবেচনায় সব দিয়েই মোগল সাম্রাজ্যের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু জীবন দিয়ে হলেও তারা নিজ সিংহাসনের জন্য লড়াই করবেন, মোগল আগ্রাসন কোন ভাবেই বরদাস্ত করবেন না- এ প্রশ্নেই মূলত তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। অন্য দিকে এখানে একটা অর্থনৈতিক প্রশ্নও জড়িত ছিলো। নিজ অঞ্চলে আদায়কৃত রাজস্বের পুরোটাই তখন বারো ভূঁইয়ারা ভোগ করতে পারতেন। কিন্তু মোগল বশ্যতা স্বীকার করে নিলে তাদের এ পরিমাণটি অনেক কমে যেত। এ অর্থনৈতিক হিসেবটি ঈশা খাঁ ছাড়াও অন্যান্য ভূঁইয়াদের মধ্যে খুব কাজ করেছিলো। অন্যদিকে বারো ভূঁইয়াদের সাথে বিচ্ছিন্ন কিছু যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর মোগল সম্রাটদেরও বোধোদয় হয় যে, বাংলা ভূখন্ডটি দখল করতে হলে তাদের বেশ কাঠ খড় পোড়াতে হবে। ফলে যুদ্ধে না গিয়ে মানিয়ে নেয়াটাকেই তারা শ্রেয় মনে করলেন।
দ্বিতীয়ত এই ঐক্য বাংলা ভূখন্ডের সংস্কৃতির উপর বেশ প্রভাব রেখেছিল। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের সংস্কৃতিতে মোগল সংস্কৃতি যে প্রভাব বিস্তার করেছিলো বাংলায় তা পারে নি। বাংলা সংস্কৃতি তার স্বীয় মহিমায় তখন টিকে ছিলো। ঐ সময় মোগল শাসিত ভারতবর্ষের স্থাপত্যকলা, ভাষা, সংগীত, খাবার দাবারে ব্যাপক মোগলীয় প্রভাব পড়েছিল। বাংলার ক্ষেত্রে কিস্তু তেমনটি ঘটে নি। বাংলা তার অনেক স্বাতন্ত্র ধরে রাখতে পেরেছিল। এখনো আমরা ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে তুলনা করলে বিষয়টি সত্যতা দেখতে পাই।
তবে “বারো ভূঁইয়া” দের এক পর্যায়ে এসে মোগলদের কাছে পরাজিত হতে হয়। তখন অবশ্য মোগল সাম্রাজ্যও পতনের দিকে এগুচ্ছিলো ধীরে ধীরে। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বাংলা মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন বারো ভূঁইয়াদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ঈশা খাঁর ছেলে মুসা খাঁ। এ সময় বারো ভূঁইয়াদের ঐক্যেও খানিক ফাটল দেখা দিয়েছিল। তখন সম্রাট জাহাঙ্গীরের নিয়োগ দেয়া বাংলার সুবেদার ইসলাম খান চিশতী’র নিকট মুসা খাঁ কে প্রাণ দিতে হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলায় “বারো ভূঁইয়া”দের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
এখানে উল্লেখ্য, বাংলায় “বারো ভূঁইয়া”দের পতনের প্রাক্কালেই ১৬১০ সালে ইসলাম খান চিশতী ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করেন। এর আগে বাংলার রাজধানী ছিলো বিহারের রাজমহলে। ইসলাম খান চিশতীর হাত ধরেই ঢাকা প্রথম বাংলার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে।
সর্বোপরি বাংলার সাহসী এক জন সামন্ত রাজা হিসেবে ঈশা খাঁ সহ অন্যান্য বারো ভূঁইয়ারা এখনো ইতিহাসের পাতা জ্বলজ্বল করে রয়েছেন।

লেখক
সৌরভ দাস
শিক্ষার্থী
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:০২
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×