১.
আরো দুটি প্রাণ ঝড়ে গেলো। অকালেই চলে গেলো। এর প্রতিশোধও হয়তো নেবে নিহতদের বন্ধুরা - সংগঠনের সদস্যরা। শংকায় থাকতেই হবে; উড়িয়ে দেয়া কি যায় এই শংকাকে?
যে যায়, সেতো চলেই যায়। আর যারা রয়ে যায়, তারাই বয়ে বেড়ায় সব। চাকুরী সূত্রে, শিক্ষকতা করায়, কিংবা তারও আগে নিজে যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি তখন খুব কাছ থেকেই দেখেছি এসব ছাত্র রাজনীতিবিদদের অনেককে আর সেই সঙ্গে তাদের পিতা-মাতাদেরও। এই ছেলেগুলো যখন প্রথম কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে আসে তখন খুব নিরীহ থাকে; এদের অনেকে এমন কি জোরে কথা বললে পর্যন্ত ভয়ে জড়সর হয়ে পড়ে। অথচ কিছু দিনের মধ্যেই এদের মধ্যে চলে আসে বেপরোয়া ভাব। কিন্তু এর উৎস কি?
২.
বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে বলতেই হবে ছাত্র রাজনীতির সূচনা, বিস্তৃতি এবং অবদান বিশাল মহিরূহ হয়ে আছে। এদেশে ছাত্র রাজনীতির প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল প্রগতিশীল দর্শনের দ্বারা অনুপ্রাণিত একদল তরুণের দ্বারা যারা সমাজের অনাচার দূর করতে আর শ্রেণী বৈষম্যের নিঙ্গড় থেকে পরাধীন ভারতকে মুক্ত করতে প্রথম এগিয়ে এসেছিলো বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। কালক্রমে পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, আর ১১ দফার আন্দোলন হয়ে দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে এসে সমাপ্ত হয়েছে। কাজেই বলা যায় এটি সমাজের অবিচার আর নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে এক প্রচন্ড শক্তিই ছিলো একসময়। হ্যা, এক-সময়। আজ স্বাধীন দেশে এই ছাত্র রাজনীতি কোন পথে চলছে?
স্বাধীনতার পর নির্লজ্জ অর্থ লোলুপতা আর ক্ষমতা লিপ্সার থেকে উৎসরিত জিঘাংসার চারিতার্থ করার দ্বারা ধনতান্ত্রিক মানসিকতার বিকাশই মূলত একে অবক্ষয়ের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আর এর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে সামরিক শাসনের ভিতকে টিকিয়ে রাখার মানসিকতার জন্য বিভিন্নভাবে একে আকর্ষণীয় করে তোলার দ্বারা; ফলে ছাত্র রাজনীতি তার চিরায়ত গণমুখী ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে নেমে আসে ক্ষমতামুখী দৃষ্টিভঙ্গীর স্তরে। শুরু হয়ে যায় পেশী শক্তি আর অর্থের তান্ডব। আর যেহেতু প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই লক্ষ্য যেকোন মূল্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া; সেখানে দেশ আর জনগণের কল্যান নিয়ে ছাত্ররা ভাবার কোনো অবকাশই পাচ্ছেনা। তারা এখন ব্যস্ত টেন্ডার ভাগাভাগি আর চাঁদার বখরা আদায় করার কাজেই।
৩.
এদেশের ক্ষমতার ইতিহাস পর্যলোচনায় দেখা যায় যে, তরুণ প্রজন্ম যাদের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে তারাই যাচ্ছে ক্ষমতার মসনদে; ফলে ক্ষমতার মসনদের আকাঙ্খীরা তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নেয় শিক্ষার সাথে সংশ্লষ্ট জনগোষ্ঠীকেই, ফলে ছাত্ররাই হয়ে উঠছে তাদের নিশানা। ফলশ্রুতিতে ছাত্রদের দেয়া হয় অযথাচিত আশ্রয় - প্রশ্যয়; যা তাদের অন্যায়কে আড়াল করার দ্বারা বা তাদের দ্বারা স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় চলে আসে পেশী শক্তি আর অস্ত্রের ঝনঝনানির। আবার এসবকে সচল রাখতে আর পালন করতে প্রয়োজন হয় অঢেল অর্থের; ফলে ব্যবহৃৎ হয় ছাত্ররাই, অনেকটা কৈ-এর তেলে কই ভাজার মতো।
এদেশের ছাত্র রাজনীতির যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজকে ঘিরে আবর্তিত হয় তাই সকল রাজনৈতিক দলই সচেষ্ট থাকে এই স্তরের শিক্ষার্থীদেরকে নিজের কাছে টেনে নিতে। ফলে অস্ত্রের ঝনঝনানিও এই স্তরেই সীমাবদ্ধ। আর যেহেতু সর্বোচ্ছ বিদ্যাপীঠে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেরাও এসে যোগ দেয় তাই দেখা যায় সেসব ছেলেই বেশি শিকার হয় এর। ছাত্র রাজনীতি দেশের মূল রাজনীতি একটি ধারা ঠিকই কিন্তু তাদেরকে তাদের অধিকার অর্জনের জন্য নয় বরং ব্যবহার করা হয় ক্ষমতার মসনদের পথকে কুসুমাস্তীর্ণ করার জন্য। দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এমনকি শিক্ষকরাও ছাত্র রাজনীতির সাথে যারা জড়িত তাদেরকে বৈধ - অবৈধ সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার পাশাপাশি অন্যায়গুলোকে দিচ্ছে প্রশ্রয় আর অপরাধকে করে যাচ্ছে আড়াল।
৪.
আমাদের প্রায় সকল অর্জনের পিছনে ছাত্রদের বিপুল অবদান রয়েছে যা কেউ অস্বীকার করে না; কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী, বিশেষতঃ ‘৯০-এর দশক থেকে চলমান ছাত্র রাজনীতি তাকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধই করেনি; বরং এর যৌক্তিকতাকেও করে তুলছে হাস্যস্পদ। ফলে বিচারপতি সাহাবউদ্দিন আহমেদ বা অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামসহ আরো অনেকেই বর্তমান ছাত্র রাজনীতির এই নৈরাজ্যের বিরোদ্ধীতা করেছেন এবং এটি বন্ধ রাখার পক্ষেই মত দিয়েছেন। কিন্তু বিরোধীতা করেছেন কেবল রাজনীতিবিদরাই; যাদের ক্ষমতায় যাবার বাহন হচ্ছে এই ছাত্ররা - ছাত্র রাজনীতি নামক নোংরা যন্ত্র। দেশের কোনো রাজনীতিবিদ - প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা আমলার সন্তানই এদেশে পড়াশোনা বা স্খায়ীভাবে বসবাস করে না; তারা বিদেশের থেকে ডিগ্রী নিয়ে দেশে এসে বাবা - মায়ের পরিচয়ে বাগিয়ে নিচ্ছে বড় বড় পদগুলো বা বসে পড়ছে ব্যবসা - বাণিজ্যের পসরা খুলে।
৫.
আজ যে ছেলেগুলো এতটা নৃশংস হয়ে উঠেছে তাদের কয়েকজনকে দেখেছি অনেক নিরীহরূপে; হয়তো তাদের ভালোমানুষি চেহারার আড়ালেই লুকিয়ে থাকা পশুটি কেউ খুচিয়ে তুলে দিয়েছে। কিংবা তারা বিকিয়ে দিয়েছে তাদের বিবেক - বুদ্ধি আর নৈতিকতাকে। কিন্তু আমি দেখি তাদের পিতা-মাতাকে। হাড়-ভাঙা পরিশ্রম করে যিনি পাঠাচ্ছেন পুত্রের মাসের বেতন আর পড়ার খরচ, স্বপ্নের জাল বুনে যাচ্ছেন অবিরত, তিনি যখন দেখেন তার আদরের ধন একটি লাশ হয়ে ফিরে এসেছে। তখন সেটি শুধু তার সন্তানের লাশই থাকে না; থাকে তার স্বপ্নেরও লাশ। সেই সমাধিতে তার পুত্রের সাথে শায়িত থাকে তার সার-জীবনের স্বপ্নও।
আজ আমরা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছি শিক্ষাঙ্গনের সন্ত্রাসের বৈধতাকে। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের জন্য, আমাদের সরকার বাহাদুর আর বিপরীতে থাকা ক্ষমতার মসনদে আসন পেতে মরিয়া বিরোধী দল এবং সেই সঙ্গে ছড়িয়ে - ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য দলগুলো, আমাদের সন্তানদের আজ তাদের মসনদে যাবার বা গদিতে টিকে থাকার একমাত্র বাহক হিসেবে ব্যবহার করেই যাচ্ছে। কি দিয়েছে এই ছাত্র রাজনীতি নিহত শিক্ষার্থীদের পিতা - মাতার চোখের নোনা জল ছাড়া?
>>> ... >>> ... >>> ...
প্রভাষক-এর ব্লগ থেকে...