সূরা বাকারার ২ নং আয়াতে বলা হয়েছে (ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ) যালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফিহি হুদাল্লিল মুত্তাকীন। যার অর্থ-- ''এটি সেই গ্রন্থ যাতে কোন সন্দেহ নেই এবং খোদাভীরু পরহেজগারদের জন্য এটি পথ নির্দেশক।'' আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে তেলা মাথায় তেল দেওয়া হয়েছে । যারা মুত্তাকী খোদাভীরু পরহেজগার তাদের আবার হেদায়াত দরকার কেন? হেদায়াত পেয়েই তো তারা মুত্তাকী হয়েছে। আয়াতে বর্ণিত ‘হূদা’ অর্থ সঠিক পথ নির্দেশনা। সঠিক পথ বলতে বুঝায় যে পথে দুনিয়াতে চলে গেলে খুব সহজে আল্লাহর সাক্ষাত পাওয়া যাবে সেই পথ। কাফেররা যেহেতু আল্লাহকে বিশ্বাসই করেনা সুতরাং তাদের জন্য এটা বিশ্বাস করাও কঠিন যে পুন:রায় তাদেরকে আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে। হিসাব দিতে হবে দুনিয়ার কৃতকর্মের। আল্লাহকে যারা অবিশ্বাস করে তারা মনে করে দুনিয়ার জীবনই শেষ জীবন। সেজন্যই এই মহাগ্রন্থ আল কুরআন তাদেরকে হেদায়াতের পথ দেখায় না। তবে একথা ঠিক যে দুনিয়ার প্রত্যেকের জন্য এই গ্রন্থের মধ্যে কল্যান রয়েছে। দুনিয়াবী কল্যান সবার জন্য কিন্তু উভয় জাহানের কল্যান কেবল মুত্তাকীদের জন্য।
অমুসলিমদেরকে আল কুরআনে কাফের বলা হয়েছে। ''কাফের'' শব্দটি আরবি, যার অর্থ ঢেকে রাখা। আলোর প্রতিফলনের সূত্র থেকে আমরা জানি আলো কেবল স্বচ্ছ কোন তল বা স্থির পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়। ময়লাযুক্ত আয়না যেমন আলোকে প্রতিফলিত করতে করতে পারে না তেমনি কাফেরকেও এই গ্রন্থ হেদায়াত দেয় না। কোরআনের আলো তাদের অন্তরে পৌঁছে না। তবে যারা কোরআনের সংস্পর্শে থাকে আস্তে আস্তে তাদের অন্তরের মধ্যেও হেদায়াতের নূর পৌঁছে। কাফেরের অন্তরের আবর্জনা দূর হয়ে তারা মুত্তাকী হয়ে যায়।
হাদিসে বলা হয়েছে- ''প্রত্যেক মানব শিশুই ইসলামের আদর্শ নিয়েই জন্ম গ্রহন করে। অত:পর তার মা-বাবা তাকে অগ্নিপূজক কিংবা কাফের করে তোলে।'' সুতরাং বুঝা যাচ্ছে আপাত দৃষ্টিতে যারা কাফের, বর্তমানে ইসলামের নাম শুনলে যাদের গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায় তাদের অন্তরেও হেদায়াতের আলো প্রতিফলনের জন্য একটুকরা স্বচ্ছ স্থান আছে। শুধু তাদের অন্তরের ময়লাটুকু দূর হওয়ার অপেক্ষা।
এই ঐশী গ্রন্থ আসলে তো সমস্ত মানুষের হিদায়াত এবং পথ প্রদর্শনের জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু এই নির্ঝরের পানি দ্বারা কেবল তারাই সিক্ত হবে, যারা ‘আবে হায়াত’ (সঞ্জীবনী পানি)-এর সন্ধানী এবং আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হবে। আর যাদের অন্তরে মৃত্যুর পর আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করার অনুভূতি এবং চিন্তা নেই, যাদের মধ্যে সুপথ সন্ধানের অথবা ভ্রষ্টতা থেকে বাঁচার কোনই উৎসাহ ও আগ্রহ নেই, তারা সুপথ কোথা থেকে এবং কেনই বা পাবে? সকাল তো তাদের জন্য, যারা ঘুম ছেড়ে চোখের পাতা মেলে জেগে ওঠে। ঘুমিয়ে থাকলে যেমন ভোরের আলোর দেখা পাওয়া যায় না, দরজা না খুলে যেমন ঘরের বাহিরে যাবার পরিকল্পনা করা বৃথা তেমনি বদ্ধ হৃদয় নিয়ে কোরআনের আলোর দেখা পাওয়া যাবে না। কুলসিত অন্তর নিয়ে চিন্তা করলে বেকুবের মস্তিষ্ক শুধু কুরআন থেকে দূরে যেতে থাকবে।
পবিত্র কোরআন মানুষকে সৌভাগ্য ও সফলতার দিকে পরিচালিত হবার সব উপায় বলে দিয়েছে। কাজেই যে ব্যক্তি সফলকাম হতে চায় তাকে অবশ্যই স্রষ্টার কাছ থেকে প্রেরিত দিক নির্দেশনার শরণাপন্ন হতে হবে। যে সব জিনিস তার দেহ কিংবা মনের জন্য ক্ষতিকর সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন- “পবিত্র কোরআন মানুষকে পথ প্রদর্শনের জন্য নাযিল করা হয়েছে।” তবে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, এ ঐশী গ্রন্থ থেকে কেবলমাত্র তারাই উপকৃত হবে, যারা সত্যকে বুঝতে চায় এবং সত্যকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকবে।
গোঁড়া ও সংকীর্ণমনা ব্যক্তিরা কখনও সত্যকে গ্রহণ করতে চায় না। সত্য তাদের কাছে প্রমাণিত হলেও তারা তা অস্বীকার করে। কোরআনের শিক্ষা তাদের কোন উপকারে আসে না। কাজেই কোরআনের পথনির্দেশনা তাদের মধ্যেই প্রভাব বিস্তার করে, যাদের মনে খোদাভীতি রয়েছে। সুতরাং এ আয়াতে বলা হয়েছে-“কোরআন খোদাভীরু ও পরহেযগার লোকদের জন্য পথ নির্দেশক।”
হাতে আলো থাকলেও কেউ যদি সেই আলো পথের দিকে না ধরে নিজের চোখের দিকে ধরে তবে সে ঐ আলো বা লাইট থেকে কোন উপকার তো পাবেই না বরং ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তাই বলে কি আলোর দোষ দেয়া যাবে?
এ আয়াতে কী কী শিক্ষণীয় বিষয় হলো:
১) পবিত্র কোরআনের জ্যোতি কেবল তখনই আমাদের অন্তরকে প্রভাবিত করবে যখন আমরা সত্যকে গ্রহণ করার জন্য তৈরী হব। মাটি কিংবা ময়লার মধ্যে আলোর বিকিরণ ঘটেনা, আলো কেবল স্বচ্ছ আয়নার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়।
২) এটি একেবারে একটি হিদায়াত ও পথ নির্দেশনার গ্রন্থ। কিন্তু এর থেকে লাভবান হতে চাইলে মানুষের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক গুণ থাকতে হবে। এর মধ্যে সর্বপ্রথম যে গুণটির প্রয়োজন সেটি হচ্ছে, তাকে “মুত্তাকী” হতে হবে। ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা তার মধ্যে থাকতে হবে। তার মধ্যে মন্দ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ও ভালোকে গ্রহণ করার আকাঙ্খা এবং এ আকাঙ্খাকে বাস্তবায়িত করার ইচ্ছা থাকতে হবে। তবে যারা দুনিয়ায় পশুর মতো জীবন-যাপন করে, নিজেদের কৃতকর্ম সঠিক কি না সে ব্যাপারে কখনো চিন্তা করে না, যেদিকে সবাই চলছে বা যেদিকে প্রবৃত্তি তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অথবা যেদিকে মন চায় সেদিকে চলতে যারা অভ্যস্ত, তাদের জন্য কুরআন মজীদে কোন পথ নির্দেশনা নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:২৯