somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক সন্ধ্যায়

২৮ শে জুন, ২০২২ রাত ১১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তখন মাগরিবের ওয়াক্ত, চারিদিকে আজান হয়ে গেছে । সন্ধ্যের পূর্বেই কাজ সেরে রুমে ফিরেছি । শার্টটা ক’দিন ধরে পরছি, তাই ফিরেই ধুয়ে দিচ্ছিলাম । ধোয়া শেষে আঁড়ে নেড়ে দিচ্ছি । তখনই কেউ একজন বমি করতেছে বলে মনে হলো, টি-শার্টটা নাড়তে দিতেই উচ্চস্বরে হাউমাউ করে উঠলেন একজন মহিলা ।

তড়িঘড়ি করে কাছে গিয়ে দেখি একজন মহিলা হেঁচকি তুলছেন অনবরত । পাশে কয়েকজন দাঁড়িয়ে, আরেকজন কোলে নিয়ে মাথায় পানি ঢেলে যাচ্ছেন । পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাগুলোকে বললাম উনার হাত ঘষে দিন । অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপের দিকে গেলো, মহিলা গা ছেড়ে দিলেন একেবারে ।

বললাম হাসপাতালে নিতে হবে । যিনি পানি ঢালছেন তিনি বললেন, বাবা একটা অটোরিক্সা ডাকেন । রোডের সাথেই যেহেতু বাসা, সেহেতু গাড়ি পেতে দেরি হলোনা । তখন আমি লুঙ্গি পড়া, বললাম যে একটু দাঁড়ান । রুমে এসে প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে বললাম ‘চলেন’ । কারণ আশেপাশে উনার কোনো পুরুষ আত্নীয় ছিলোনা ।

অটোরিক্সা চলছে, মহিলাকে পিছনে রেখে আমি সামনে বসেছি । অসুস্থ মহিলাকে ধরে আসেন তাঁর আপন বোন(যা পরে জেনেছি) । রাস্তা ভাঙা হওয়ায় একটু যেতেই মহিলা নিচে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো । অটোরিক্সাওয়ালা বললেন, ভাই আপনি পিছনে গিয়ে বসেন তাছাড়া পড়ে যাবে মানুষটা । পিছনের সিটে বসে উনার কোমর আর পা ধরে নিকটস্থ পূর্বধলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলাম ।

রিক্সা থেকে নামার পর সেই অসুস্থ মহিলাকে হাসপাতালের ভিতরে নিতে হবে, কিন্তু যেই মহিলা আমার সাথে ছিলেন তিনিও মোটামুটি বৃদ্ধা । উনি ধরে নিয়ে যেতে পারবেননা । ততক্ষণে সেই অসুস্থ মহিলার জ্ঞান ফেরেনি । অটোরিক্সাওয়ালা বললেন, ভাই আপনি ঘাড়ে করে নিয়ে যান, সবারই মা-বোন আছে ।

ঘাড়ে তুলে নিয়ে সোজা জরুরি বিভাগের একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে দিলাম । একজন ইন্টার্ন উনার প্রেশার মাপলেন । সিস্টোলিক চাপ ১১০ আর ডায়াস্টোলিক চাপ ৮০ । সুতরাং প্রেশার নরমাল ।

ইন্টার্ন বুকে ঘষতে লাগলেন, জ্ঞান তখনও ফেরেনি । খানিক পর জ্ঞান ফিরলো মহিলার । ইন্টার্ন বললেন, ইসিজি করাতে হবে । ইসিজি করালাম, রিপোর্ট নরমাল । কর্তব্যরত একজন চিকিৎসক আসলেন খানিক পর, উনি বললেন, এডমিট করে দিন ।

যখন সেই অসুস্থ মহিলাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিই, তখন দেখি উনার একটা চোখ নেই । ডাক্তার প্রশ্ন করলেন উনার নাম কি, তখন আমি সেই বৃদ্ধা মহিলাকে বললাম ডাক্তার কি জিগেস করে সেগুলোর উত্তর দিন । মহিলার নাম: রেখা, স্বামীর নাম: কাজল, ঠিকানা: পূর্বধলা, বয়স: ২৫ । বয়স নিয়ে ডাক্তারের একটু সংশয় হলো, হবারই কথা যে মেয়ের বিয়ে হয়েছে বাল্যকালে যাঁর এক ছেলের বয়স ১৪ আরেকটা মেয়ের বয়স প্রায় দশ বছরের মতো হবে । সেই মহিলাতো নুঁইয়ে পড়বেন-ই, স্বাভাবিক । ওদিকে স্বাস্থ্যও রোগাপাতলা, দেখেই বোঝা যায় পুষ্টিহীনতায় ভোগে ।

ডাক্তারের কাছ থেকে এডমিট ফর্ম নিয়ে দোতলায় তুললাম আমি আর এক ভাই(সেই ভাইটা মহিলার নিকটাত্মীয় হোন, উনি কোনো একটা কাজে এসে দেখেন তাঁর আত্নীয়ের এই অবস্থা) । উপরতলায় গিয়ে দেখি কোনো রুমে বেড ফাঁকা নেই, রুমের বাহিরে একটা বেড পাওয়া গেলো, সেখানে শুইয়ে দিলাম । তারপর সেখানকার স্টাফদের বললাম ঘটনাটা, তখন বললেন যে উনাকে উপরে না রেখে নিচে রাখুন । সেন্সলেস মানুষকে উপরে রাখলে সমস্যা হবে ।

ধরাধরি করে এক জায়গা থেকে আবার আরেক জায়গায় শিফট করালাম । স্টাফ বললেন, স্কচটেপ শেষ হয়ে গেছে, একটু স্কচটেপ আনুন । নিচে গিয়ে স্কচটেপ, একটা মশার কয়েল নিয়ে উপরে গিয়ে দেখি মহিলাকে স্যালাইন দেয়া হয়ে গেছে ।

ততক্ষণে সেই বৃদ্ধা মহিলা ফোন করে বাড়িতে খবর পাঠিয়েছেন । তাঁর বোন আসলো, উনাকে বললাম আপনি থাকেন আর আমি ইনাকে(সেই বৃদ্ধ মহিলাকে) নিয়ে যাই । উনি একটা মাদুর আর যা যা লাগে নিয়ে আসবেনি । সেই বৃদ্ধা মহিলাকে রিক্সাতে করে আনতেছি, তখন উনি বললেন, রান্নার যে কি হলো ওদিকে, মাছ কি বিড়ালে নিয়েই গেলো নাকি । আমি বললাম চিন্তা কইরেননাতো, যা হবার হবে । পৌঁছে দেখি পাশের বাড়ির একজন বৃদ্ধ চুলোয় লাকড়ি ঠেলছেন ।

আজ সকালে উঠে কাজের উদ্দেশ্যে বের হলাম, মন আনচান আনচান করছিলো যে এখনই দেখে যাবো নাকি সন্ধ্যায় যাবো তাকে দেখতে । সাত-পাঁচ না ভেবে সকালেই রওনা দিলাম । হাতে সামান্যকিছু ফল নিয়ে হাসপাতালে গেলাম ।

পৌঁছার পর দেখি মহিলার দ্বিতীয় স্যালাইন চলছে । পাশে বসে আছে তাঁর ছোট্ট মেয়ে । নাম আকলিমা, একটা মহিলা মাদ্রাসাতে পড়ে । তাঁর একটা ভাই আছে যে ঢাকাতে পাইলিংয়ের কাজ করে । আকলিমার বয়স প্রায় দশ বছর হবে । আর ওঁর ভাইয়ের চৌদ্দ । তাঁর বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে, ভরণপোষণের খরচ তাঁর ছোটভাই পাঠায় মাসে মাসে । পরিবারের সাথে তেমন যোগাযোগ রাখেনা । শ্যামগঞ্জে রিক্সা চালায় আবার দিনমজুরের কাজ করে । আকলিমার পাশে বসে আছে তাঁর ছোট খালা ।

খানিকটা সময় পর বললাম, আমি আবার সন্ধ্যায় এসে দেখে যাবো । থাকেন । সেই অসুস্থ মহিলা আমাকে, 'ছেলে' সম্বোধন করলেন, বললেন আপনি নাকি গতকাল আমারে একাই নিয়ে এসেছেন । আপনি না থাকলে আমি হয়তো মরে যেতাম ।

আমি নির্বাক হয়ে পড়লাম । সেসব কথা কাটিয়ে বললাম, থাকুন আমি যাই ।

সন্ধ্যের পূর্বে ফেরার মতো আবারও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলাম, গিয়ে দেখি নিচের বেড ফাঁকা । কিরে, কই গেলো মানুষটা । ডিউটিরুমে বললাম, এখানে গতরাতে রেখা নামের একজন পেশেন্ট ভর্তি হয়েছিলো উনাকে কোথায় শিফট করা হয়েছে বলতে পারবেন, উনারা বললেন রুমগুলোতে দেখুন । দু’পাশে দুইটা রুম, কিন্তু কোনো রুমেই তাঁরা নেই । স্টাফদের বললাম রেজিস্ট্রি খাতাতে চেক করে দেখুনতো, পরে দেখা গেলো যে রিলিজ দেয়া হয়েছে ।

বাসায় ফিরে দেখি সেই বৃদ্ধা মহিলা রাঁধতেছে । সেই বৃদ্ধা মহিলা(তিনি এখানকার মেসে রান্না করে দেন, যিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সেই মহিলা উনার বোন হয়) বললাম যে কখন বাসায় নিয়ে এসেছেন, বললেন দুপুরে...

সাব্বির আহমেদ সাকিল
১৪ আষাঢ় ১৪২৯ বঙ্গাব্দ | মঙ্গলবার | ২৮ জুন ২০২২ ইং | পূর্বধলা, নেত্রকোনা
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২২ রাত ১১:২৪
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: রহস্যময় চৌধুরী ভিলা

লিখেছেন গ্রু, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৩৩



পরদিন সকালে আকাশ পরিষ্কার। গতরাতের বৃষ্টির কোনো চিহ্ন নেই, শুধু রাস্তার ধারের গাছগুলো থেকে টুপটাপ জল পড়ছে। অনিরুদ্ধ তার জীর্ণ নীল রঙের পাঞ্জাবিটা পরে তৈরি হয়ে নিল। সে সাধারণত রিকশায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামপন্থী রাজনীতির বয়ান এবং জামাতের গাজওয়াতুল হিন্দ-এর প্রস্তুতি

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০


গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাহ্ম হয়েও, ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শের বিপরীতে "গোরা" নামে একটি চরিত্র তৈরি করেন। গোরা খুব কট্টরপন্থী হিন্দু যুবক। হিন্দু পরিচয়ে বড় হলেও, আসলে সে আইরিশ দম্পতির... ...বাকিটুকু পড়ুন

I have a plan

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:২২

আসেন নেতা পা বাড়ান সামনে এগিয়ে চলেন
প্ল্যান টা কী বলেন।

সামনে আজাদ পেছনে দিল্লি কোন দিকে যাই বলেন
প্ল্যান টা কী বলেন।

যে দিকেই যাই ৩৬ যাবে? সেইটা ক্লিয়ার করেন
প্ল্যান... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫ আগস্টের পর তো কিছুই বদলায়নি

লিখেছেন মুনতাসির, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৯

অনেকেই বলেন, ৫ আগস্টের পর তো কিছুই বদলায়নি। এই কথাটার সূত্র ধরেই এগোনো যায়। ৫ আগস্টের পর আমাদের কোন কোন পরিবর্তন এসেছে, সেটাই আগে দেখা দরকার। হিসাব করে দেখলাম, বলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আদর্শের রাজনীতি না কোটি টাকার হাতছানি...

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:২৫



১. আমি অনেক আগে ব্লগে লিখেছিলাম, বাংলাদেশে ছোট দলগুলো নিষিদ্ধ করা উচিত। উন্নত দেশের মত ২/৩ টিতে থাকাই উত্তম। কারণ, ছোট দলের নেতাদের টকশো-তে গলাবাজি করা ছাড়া আর কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×