১. কোন আমেরিকান কিংবা ব্রিটিশ বাংলাদেশের পতাকা অঙ্কিত টি-শার্ট পরিধান করবে না, কিন্তু অনেক বাংলাদেশী আমেরিকা/ইউকের পতাকা অঙ্কিত পোশাক পরিধান করে গর্বিত ভাব নিয়ে বাংলার বুকে ঘুরে বেড়ায়!
কারণ তাদের মধ্যে আত্মপরিচয়, আত্মসচেতনতা ও আত্মমর্যাদার অভাব রয়েছে।
২. কোন পুরুষ শাড়ি-কামিজ পরিধান করবে না। তবে অনেক নারীই প্যান্ট-শার্ট, টি-শার্ট পরিধান করে, মহা আধুনিক হওয়ার তৃপ্তি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, (যে যার ইচ্ছেমত পোশাক পরিধান করতেই পারে। আমি এখানে কাউকে কটুক্তি করার উদ্দেশ্য বলছি না। শুধুমাত্র এমনটা কেন হয়, তা অনুধাবনের জন্য বলি)।
কারণ তাদের মধ্যে আত্মপরিচয়, আত্মসচেতনতা ও আত্মমর্যাদা অভাব রয়েছে।
৩. কোন হিন্দি ভাষাভাষী ভুল করেও বাংলা উচ্চারণ করবে না। জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে যেকোনো ভাষা শিক্ষাকে সাধুবাদ জানাই। তবে বাংলাদেশে হিন্দির অবস্থান কি জ্ঞান মূলক, নাকি আগ্রাসন আমার প্রশ্ন এখানেই!
বাংলাদেশী মানুষের আত্মপরিচয়, আত্মসচেতনতা ও আত্মমর্যাদার অভাবেই এমনটা হয়েছে।
(কিছুদিন আগের কথা। বাড়ির পাশে নবনির্মিত স্কুলভবন উদ্বোধন হবে, সেখানে স্থানীয় নেতাকর্মীরা বক্তব্য রাখবে। এ উপলক্ষে সকালে হিন্দি গান দিয়ে মাইক চালু করা হলো।
এটা দেখে আবদুল হাকিমের সেই 'বঙ্গবাণীর' কথা মনে পড়ে গেল। এবং আমারো সন্দেহ হচ্ছিল, এদের জন্ম কি আদৌ মানুষে নাকি ছাগলে)
অযৌক্তিকভাবে অন্যকে নিজের মধ্যে লালন মূলত নিজেক অন্যের গোলাম বানানো। জাতি হিসেবে ইউরোপিয়ান বা আরবের যে মর্যাদা, বাঙ্গালিরও একই মর্যাদা, আফ্রিকার ক্ষেত্রেও একই! এটা যে ধারণ করতে পারবে না, মানুষ হয়েও মনস্তাত্ত্বিক ভাবে সে অন্য মানুষের গোলাম হয়ে থাকবে। এখান থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন আত্মপরিচয়, আত্মসচেতনতা ও আত্মমর্যাদা।
আত্মমর্যাদাবোধ কি তা একটু লক্ষ্য করুন।
২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাতৃভাষায় ৪৫ মিনিট বক্তৃতা দিয়ে বিশ্বের দরবারে নিজেদের তুলে ধরেন।
চীনের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ১৯৫২ সালের ২-১২ অক্টোবর শান্তি সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি এবং পূর্ববাংলার প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাংলায় বক্তৃতা দেন। এ সম্পর্কে তিনি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ২২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন।
"সাঁইত্রিশটা দেশের পতাকা উড়ছে। শান্তির কপোত এঁকে সমস্ত হল সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। প্রত্যেক টেবিলে হেডফোন আছে। আমরা পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা একপাশে বসেছি। বিভিন্ন দেশের নেতারা বক্তৃতা শুরু করলেন। প্রত্যেক দেশের একজন বা দুইজন সভাপতিত্ব করতেন। বক্তৃতা চলছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও অনেকেই বক্তৃতা করলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান খান ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করবো না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ববাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। কিন্তু আমার মাতৃভাষায় বলাই কর্তব্য"।
এটাই আত্মমর্যাদাবোধ। এই আত্মমর্যাদা তাকে বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিল। যার উদাহরণ পাকিস্থান থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন সফরকালীন এক ঘটনা থেকে পাওয়া যায়।
সাধারণত রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বিদেশ সফরে গেলে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রত্যেকের গাড়ির দরজা খোলার জন্য প্রটোকল অনুযায়ী বিভিন্ন র্যাংকের লোক থাকে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে হয়েছিল ব্যাতিক্রম। ৮ জানুয়ারি পাকিস্থানের কারাগার হতে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে গেলে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নিজের সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধুর গাড়ি ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছালে প্রটোকল ভেঙ্গে বিট্রিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ নিজেই গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলেন যতক্ষণ না বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে বের হন।
সেই বঙ্গবন্ধুর দেশের মানুষ হয়ে আমরা কতটা আত্মসচেতন? কতটা আত্মমর্যাদাশীল?
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১০:৪১