somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাফর ইকবালের ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে হিংসাত্মক মন্তব্যকারিদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন

০৬ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বুদ্ধিজীবী ড. জাফর ইকবালের উপর হামলাকারীকে দেখলাম। এখনো জীবিত আছে। পুলিশের হেফাজতে। পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়েছে। চেহারায় দারিদ্রতার স্পষ্ট ছাপ। অপুষ্টির শিকার । প্রথম দর্শনেই শিক্ষিত বলে মনে হয়না। কি ধর্মীয় শিক্ষা! কি আধুনিক শিক্ষা! যত নিন্দা করা হোক, কোন কিছুই তাকে ছুয়েঁ যাবে বলে মনে হয়না। সে কাকে আঘাত করেছে এটা বুঝার ক্ষমতা বা বোধ বুদ্ধিও তার আছে বলে মনে হয়না। ইসলামে সব মানুষ এক নয়। জ্ঞান ও তাকওয়ার ভিত্তিতে মানুষে মানুষে পার্থক্য। আল্লাহ নিজে বিষয়টি পরিস্কার করেছেন। কোরআনে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, যারা জানে আর যারা জানেনা- তারা কি এক? কোরআনে যখন এধরণের প্রশ্ন করা হয় তার অর্থ, কখনোই এক নয়। অর্থ্যাৎ সব মানুষ আল্লাহর কাছে সমান না। হাদিসে আরো বিশদভাবে বলা আছে, ন্যায়পরায়ণ হলে কেয়ামতের দিনেও ইহজগতের সম্মানিতদের আলাদা সম্মান দেয়া হবে। কাউকে ছায়া দেয়া হবে। যাই হোক- এসব বলার উদ্দেশ্য যে ধরা পড়েছে, ড. জাফর ইকবালের কাছে তার অবস্থান আসফালা সাবেলিন। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। অধমের অধম। এ কারণে চলমান লেখাটা তার উদ্দেশ্যে নয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশে চিন্তার স্বাধীনতা বা মতামত প্রকাশের যে গুরুত্ব রয়েছে তা সে বুঝতেও পারবেনা। আজ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলো যে অমুসলিমদের করুণার উপর বেঁচে আছে, তার পেছনে রয়েছে এই মেধাহীনতা। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিলনা। ইউরোপ যখন ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, যখন তারা ভিন্নমতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করতো, তখন জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলমানরা আলো ছড়িয়েছিলো। বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় ভিত্তিটা আসলে মুসলমানদেরই। এই উন্নতির মূলে ছিল রেনেঁসা। দর্শন। মতবাদ। সহজে বলতে গেলে স্বাধীন চিন্তা বা মতামত প্রকাশ। তৈরী হয়েছিল বায়তুল হিকমাহ। সহ্য হয়নি ধর্মান্ধদের। প্রায় প্রত্যেক মুসলিম মনিষীদের উপর হামলা করা হয়েছে। তাদের নির্যাতন করা হয়েছে। ট্যাগ ওই একটাই। তারা ধর্মবিরোধী। এতে কি হয়েছে। স্বাধীন চিন্তা থেমে গেছে। থেমে গেছে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা। মুসলমানরা যেখানে শেষ করেছিল, ইউরোপ সেখান থেকে শুরু করেছে। ফলে রেঁনেসা শুরু হয় ইউরোপে। ধর্মের নামে সেখানেও প্রতিবন্ধকতা তৈরী করা হয়েছিল। ডারউইন তত্ত্ব দেয়ার পর তার বাড়িও আক্রমণের শিকার হয়েছিল। তবে এক পর্যায়ে তারা ভিন্নমত মেনে নিতে শুরু করে। যে যার বিশ্বাস ধারণ করতে পারার স্বাধীন পরিবেশ তৈরী করে। অর্থ্যাৎ 'আমি তোমার মতের সাথে একমত না-ও হতে পারি, তবে তোমার মতামতকে সমুন্নত রাখার জন্য প্রয়োজনে আমি জীবন বাজি রাখতেও রাজি আছি।' এতে এগিয়ে যায় তারা। এক সময় প্রযুক্তিতে এগিয়ে ছিল বলে, মুসলমানরা ইউরোপে পর্যন্ত রাজত্ব সম্পসারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। আবার যখনি প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়ে, ইউরোপ থেকে কিভাবে বিতাড়িত হয়েছিল, তার ইতিহাস আমরা জানি। জ্ঞান, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি পার্থক্যটা গড়ে দিয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো- ইউরোপ এগিয়েছে মুসলমানদের আবিস্কৃত বিজ্ঞানের শাখায়। আর মুসলমানরা ফিরে গেছে, বিবি তালাকের ফতোয়া গবেষণায়। মুসলমানরা যখন এগিয়ে ছিল, সেটার নাম এখন মধ্যযুগ। আমরা কোন নির্যাতন হলে তাকে বলি মধ্যযুগীয় নির্যাতন। কারণ আছে। এ যুগে বিজ্ঞানী দার্শনিকরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর কিছু নির্যাতনের চিত্রই স্বল্প পরিসরে তুলে ধরবো।

২.০
আমি আগেই বলেছি, জাফর ইকবালের উপর হামলাকারী আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। তার হামলার মাধ্যমে প্রকারান্তরে ইসলামের বা জাতির যে কি ক্ষতি সে করেছে এটা বুঝার ক্ষমতা তার নেই। হামলার পর সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত মন্তব্যকারীরা আমার উদ্দেশ্য। অনেকের প্রোফাইলে গেছি। কাউকে কাউকে শিক্ষিত মনে হয়েছে। তাদের একটু ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়ার জন্য লিখতে বসেছি। আন্দালুসিয়ার মতো এদেশেও বায়তুল হিকমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেটার নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২৬ সালের ১৭ই জানুয়ারি আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজি আনোয়ারুল কাদির, আবুল ফজল প্রমুখের 'ঢাকা মুসলিম সমাজ’ কেন্দ্রিক 'বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলন' প্রকাশ পায়। তাদের মুখপাত্র ছিল 'শিখা'। শিখার শ্লোগান ছিল 'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আরষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব '। নওয়াব আবদুল লতিফ বা নওয়াব সলিমুল্লাহ বুঝতে পেরেছিলেন, জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে নিজেদেরকে চিনতে হবে। আর নিজেকে চিনতে হলে মুক্তবুদ্ধির চর্চা কেন্দ্র দরকার। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর ফল জাতি পেয়েছে। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতি কখনো স্বাধীন ছিলনা। কখনো অচ্ছুৎ নিম্নজাতের মানুষ হিসেবে, কখনো ধর্মের নামে আমাদের শাসন শোষণ করা হয়েছে। হানাদার পাকিস্তানিরা ঠিকই বুঝেছিলো, এই যে মুক্তিযুদ্ধ তা উন্নত মুক্তিবুদ্ধি চর্চার ফল। এ কারণে নিজেদের সময় শেষ জেনেও মরণ কামড় বসিয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের উপরে। অবাক লাগে, এখনো এর ধারাবাহিকতা আছে। একই প্যাটার্ন। সেই আন্দালুসিয়া কিম্বা পাকিস্তান বা বাংলাদেশ। নাস্তিকতার ট্যাগ লাগিয়ে বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করা হয়। এটাই আসলে চিন্তার ইতিহাস। এই চিন্তার ইতিহাস না জানলে বিজ্ঞানের অগ্রগতি কিভাবে হলো তা বোধগম্য হবেনা। আবদ্ধ সমাজে থেকে কখনোই জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নয়ন হয়নি। আমাদের দেশে ধর্মীয় জগতের অধিবাসিরা এই যে প্রযুক্তি নিয়ে কি ভাবেন- তা খুব একটা জানা নেই। সুযোগও নেই। একটা প্রযুক্তি আসে। তারা একযোগে হারাম বলে ফতোয়া দেন। পরে সন্দেহের দৃষ্টিতে ব্যবহার শুরু করেন। পরে এর মুখপাত্র হয়ে যান। মাইক যখন আসলো- হারাম ফতোয়া দেয়া হলো। পরে কেউ কেউ ব্যবহার শুরু করলেন। এক পর্যায়ে ফতোয়া শিথিল করে বলা হলো- ইবাদতে মাইক ব্যবহার করা ঠিক না। তবে কেউ মাইকে নামাজ পড়ে ফেললে, তাকে দ্বিতীয়বার পড়তে হবেনা। এই ফতোয়ার উপর ভিত্তি করেই এখন চলছে। এ ফতোয়াটা যিনি দিয়েছেন তার নাম মুফতী শফি। তিনি পাকিস্তানের। সৌদী আরব থেকে কোরআনের একটা বাংলা তাফসির ফ্রি দেয়া হয়। নাম মারেফুল কোরআন। তার লেখক। তিনি নিজেই মাইক হারাম বলেছিলেন। পরবর্তীতে মত পাল্টান। যুক্তি দেন- মক্কা মদিনায় মাইক ব্যবহার হচ্ছে। তবে এখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদেও চার পাঁচটা মাইক লাগানো। অসুস্থ মানুষগুলোর কথা কেউ বিবেচনা করেনা। এখন কেউ এর বিরুদ্ধে বলতে গেলে তার বিরুদ্ধে ইসলাম বিরোধী ট্যাগ লাগানো হবে। এ বিষয়ে আর বিস্তারিত কেউ জানতে চাইলে ইসলামি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ওই মুফতির লেখা ইবাদতে যন্ত্রের ব্যবহার বইটা পড়ে দেখতে পারেন। বলছিলাম, এদেশে ধর্মবেত্তাগণের বিজ্ঞান সচেতনতার বিষয়ে। সাংবাদিক গোলাম মর্তুজা একবার তার পত্রিকা সাপ্তাহিকে প্রয়াত শায়খুল হাদিসের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। আঞ্চলিক ভাষায় প্রদত্ত একটা লাইন আমার মনে আছে, ‘হে হে, ওই রকম চান্দে আমরাও যাইতে পারি।’ কোন আলেম ওলামাকে হেয় করা বা অসম্মান আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি নিজেও মাদ্রাসায় পড়েছি। একারণে মাদ্রসায় কি পড়ানো হয় তা আমি জানি। ফিকাহের নামে যা পড়ানো হয়। তা মধ্যযুগীয়। এখন দাস দাসী নেই। কেন এগুলো এখনো পড়ানো হবে। যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ফিকাহ লেখা উচিত। ফতোয়া আলমগীরী এ কারণেই লেখা হয়েছিল। আর শুধু ধর্মীয় পড়াটাই মুখ্য হতে পারেনা। একজন ছাত্র হেফজ শেষ করে কেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেনা। কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবেনা। আমার অনেক বন্ধু যারা হেফজ শেষ করে মাদ্রাসায় পড়েছে। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। আমি যতটুকু দেখেছি, একজন আধুনিক শিক্ষিত ব্যক্তি ইচ্ছা করলেই ধর্ম সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। আহলে হাদীসের অনুসারী ভারতীয় ডা. জাকির নায়েকের দর্শন আমার পছন্দ নয়। অন্য ধর্মীয় নেতাদের এনে ধর্ম নিয়ে বহাসের বিষয়ে আমি একমত নই। কারণ এতে অনুসারীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু ডাক্তার হয়েও তিনি ধর্ম পড়েছেন। প্রশংসার যোগ্য। আশরাফ আলী থানবিও মধ্য বয়সে ধর্ম পড়া শুরু করেছিলেন। একারণে শুধু ধর্ম না পড়েও আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় জ্ঞান ভালোভাবেই অর্জন করা যায়। এতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুবান্ধবদের মতো উন্নত চিন্তা চেতনার অনেক ধর্ম বিশেষজ্ঞ পাওয়া যাবে। এটা অনেক দরকার। চিন্তার জগতটা মুক্ত না হলে সার্বিক মুক্তি নেই।

৩.০
এবার কিভাবে ধর্মের নাম করে মুসলিম রেনেঁসা শেষ করে দেয়া হয়েছে, তা উল্লেখ করবো। নাস্তিক নাম দিয়ে মুসলিম মনিষীদের রচিত বই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে জানতে প্রথমেই কিছু বই সুপারিশ করতে চাই। ইচ্ছা করেল পড়ে দেখতে পারেন। বাংলা একাডেমী থেকে আবদুল হালিমের মুসলিম দর্শন : চেতনা ও প্রবাহ ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে। পড়তে পারেন-১৯৭০ সালে প্রকাশিত আবদুল মওদুদের লিখিত বই মুসলিম মনীষা। কিম্বা ১৯৯০ সালে শতদল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এম এন রায় লিখিত বই ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান। মুসলিম দার্শনিকদের জীবনী পড়লেই পাওয়া যায়-ইসলামের নামে তাদের হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা।
প্রথম আরব দার্শনিক আল কিন্দি ছিলেন বহুবিষয়ে পারদর্শী। জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখায় তিনি অদান রেখে গেছেন। ইউরোপের সমস্ত দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিকদের উপর আল কিন্দি'র মুলতত্ত্ব এর অধিপত্য ছিল। তিনি একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে তাকে বেত্রাঘাত করা হয় এবং তার গ্রন্থাগারটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। আল কিন্দির ছাত্র আহমদ বিন আল তায়েব সারাখশিকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। স্পেনে মুসলমানরা যারা জ্ঞান বিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন, তাদের বলা হয় আন্দালুসীয়। এই আন্দালুসীয় দার্শনিকদের মধ্যে অগ্রগামী হলেন আবু বকর মোহাম্মদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে বাজা। তিনি ইবনে বাজ নামে পরিচিত। তিনি দর্শনে মোলিক অবদান রেখে গেছেন। তাকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। এরপর যার নাম বলবো তিনি ইবনে রুশদ। তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। তিনি বলেছিলেন, “অজ্ঞতা থেকে ভীতি তৈরি হয়, ভীতি ঘৃণার সৃষ্টি করে আর ঘৃণা থেকে আসে হিংস্রতা। এটাই নিয়ম।” আমি যদি বলি ইউরোপে চিন্তার যে রেঁনেসা তৈরী হয়েছে তার বীজ বপন করেছেন রুশদ, তাতে মোটেও অত্যুক্তি হবেনা। ইউরোপীয়ানরা তার নাম দিয়েছিলেন Averroes। এই ইবনে রুশদের সাথে ইমাম গাজ্জালীর মতপার্থক্য ছিল। দর্শন ও দার্শনিক নিয়ে ইমাম গাজ্জালি ‘দার্শনিকদের অসঙ্গতি’ বই লিখেছেন। দার্শনিকদের বিশটি অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। বই লিখে এর জবাব দিয়েছেন, ইবনে রুশদ। মানে পক্ষ বিপক্ষ। আমাকে যদি বলা হয় তুমি কোন পক্ষ। আমি অবশ্যই ইমাম গাজ্জালির পক্ষে। তবে গাজ্জালির পক্ষে তৎকালীন যারা ইবনে রুশদকে নির্যাতন করেছিলেন, তাদের পক্ষে নই। কেউ কিছু লিখলে লেখার মাধ্যমে জবাব দেয়াটাই ছিল গাজ্জালির উদ্দেশ্য। অথচ চিত্র ছিল ভিন্নরূপ। ১১৯৭ সাল। স্পেনের কার্ডোভা শহরের আলজামা মসজিদ। স্বর্ণখচিত মিনার। একসময় এটি গীর্জা ছিল। কার্ডোভায় উমাইয়া বংশের স্থপতি আবদুর রহমান এটি কিনে মসজিদে রূপান্তরিত করেছিলেন। এর সামনে ধরে আনা হয়েছে জীর্ণ শীর্ণ পরিচ্ছেদের একজন দার্শনিক কে। পালিয়ে গিয়েও রেহাই পাননি। মারধোর করা হয়েছে। নত মুখে দাড়িয়ে আছেন। আর মসজিদে যারা ঢুকছেন বের হচ্ছেন, দার্শনিকের গায়ে থু থু ছিটিয়ে দিচ্ছেন। অবাক হচ্ছেন, তিনিই ইবনে রুশদ। মসজিদের সামনে নেয়ায় একটা বিষয় ফুটে উঠেছে। তা হলো ধর্মকে আশ্রয় করেই ভিন্নমতের প্রতি অাক্রমণ করা যায় সহজে। পার পাওয়া যায় সহজে। আজকে আমরা যে এরিস্টেটল পেয়েছি তার রচনাকে বাচিয়েঁছিলেন এই ইবনে রুশদ। নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি তিনি। অথচ চার’শ বছর ইউরোপের বৈজ্ঞানিক চিন্তা জগতে প্রভাব বিস্তার করেছে ইবনে রুশদ। দার্শনিকের এ অপমান নির্যাতনে অবশ্য স্পেনে মুসলমানদের ভবিষ্যৎ পরিস্কার হয়ে যায়। একসময় রক্ত আর জীবনের বিনিময়ে ইউরোপ ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল মুসলমানরা।
নির্যাতনের কত কথা আর বলবো। শুধু কি বিজ্ঞানীরা। ইমামরাও বাদ যাননি নির্যাতন থেকে। ইমাম মালিক (রঃ) এর হাত পা বেঁধে মারধর করে হাত ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। ওই অবস্থায় তাকে অন্ধকার কারাগারে পাঠানো হয়। একই কারাগারে বন্দী ইমাম শাফি (রঃ) আর ইমাম হাম্বল (রঃ) কে নির্যাতন করা হয়। ইমাম নাসায়ী (রঃ) খুন হয়েছেন। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে প্রকাশ্যে ১১ দিন ধরে প্রত্যেকদিন ১০ ঘা বেত মারা হয়। পাঠানো হয় কারাগারে। কারাগারেই বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়। বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় ইমাম জাফর সাদেক (রঃ) কে। একই পরিণতি বরণ করেন ইমাম মুসা কাজেম (রঃ)। বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় ইমাম রেজা (রঃ) কে। এ তালিকা কত দীর্ঘ, যে অবাক হয়ে যাবেন। এর পেছনে ভিন্নমত। শুনলে অবাক হবেন, আমরা হাদীসের যে গ্রন্থকে সবচেয়ে সহীহ মনে করি তার সংকলক ইমাম বুখারী রহ.। ১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত মুহম্মদ মুজীবুর রহমানের লিখিত ইমাম বুখারী বইটা পড়লেই বুঝতে পারবেন, তিনিও এর থেকে রেহাই পান নি। ইমাম আবু আবদুল্লাহ মুহম্মদ ইবনে ইসমাইল আল বুখারী (৮০৯-৮৬৯) তখন বৃদ্ধ। এসময় তার বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগে বুখারার গভর্নর তাকে আজীবন নির্বাসন দেন। ইমাম বুখারী বয়কন্দ যান। সেখানেও অপপ্রাচার। সমরখন্দবাসীরা তাকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি সমরখন্দ যাত্রা করেন। পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় জানতে পারলেন সমরখন্দেও তার বিরুদ্ধে প্রচারণা চলছে। সমরখন্দবাসী তাকে সেখানে যেতে নিষেধ করেন। ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে ইমাম বুখারী দু’হাত তুলে দোয়া করলেন, "হে আল্লাহ! আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও-এ দুনিয়া আমার জন্য ছোট হয়ে গেছে।" পরে সমরখন্দবাসী তাদের ভুল বুঝতে পারে। তারা তাকে নিতে যান। তিনি দু'ব্যক্তির কাধে ভর করে বাহনের উপরে উঠতে যান। একটু এগিয়ে গিয়েই বললেন :"আমাকে ছেড়ে দাও, আমার দূর্বলতা বেড়েছে "। এর পরেই মৃত্যূবরণ করেন ইমাম বুখারী (রঃ)। নির্যাতনের শিকার সুফিদের তালিকাটা অনেক বড়। মনসুর হাল্লাজ থেকে শুরু করে লালন সবাই এর শিকার হয়েছেন।

৪.০
দেশে কবি নজরুলও কাফের নাস্তিক ফতোয়া থেকে মুক্তি পাননি। ভাগ্যটা ভালো ওই সময় চাপাতির প্রচলন ছিলনা। তাহলে তার দফা রফা হয়ে যেতো। রেহাই ছিলনা। আমার কৈফিয়ত কবিতায় তো বলে দিয়েছেন, তিনি একজন কবি। তাকে নবী মনে করার কারণ নেই।
মৌ-লোভী যত মৌলভী আর 'মোল-লারা' ক'ন হাত নেড়ে,
'দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে !'
ফতোয়া দিলাম কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও !
'আম পারা'-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে !'
হিন্দুরা ভাবে, 'পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা'ত-নেড়ে !
শিখা আয়োজিত এক সভায় কবি নজরুল বলেছিলেন: 'বহুকাল পরে কাল রাত্রে আমার ঘুম হয়েছে। এতদিন আমি মনে করতাম আমি একাই কাফের , কিন্তু আজ দেখে আমি আশ্বস্ত হলুম যে, মৌ আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ কতকগুলি গুণি ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের। আমার দল বড় হয়েছে এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আমি চাইনা।' এ হিসাব করতে গেলে, দেশে ইসলামী ধর্মবেত্তা যারা আছেন, তারাও একদল আরেক দলকে কাফের বলেন। এখন এর সমাধান চাপাতি হলে আলেম ওলামারা কেউ টিকবেন বলে মনে হয়না। এর মধ্যেই অনেক আলেমকে হত্যা করা হয়েছে। নবীপ্রেমিক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি চ্যানেলে আইতে নবী পয়গম্বরদের স্মৃতি চিহ্ণ দেখাতেন। অনেক জনপ্রিয় ছিলেন। এভাবে চাপাতি সমাধান চলতে থাকলে দেশে আলেমই থাকবেন না। লেখার জবাব লেখা দিয়ে দিতে হয়। যুক্তির বিপরীতে যুক্তি দিন। এক আলেম আরেক আলেমের বিরুদ্ধে লিখলে আরবীতে লিখুন। সাধারণ মানুষ যেন বুঝতে না পারে। রাস্তায় নামা সমাধান নয়। হত্যা তো নয়ই। ইসলাম এত ঠুনকো বিষয় নয় যে কেউ কিছু লিখলেই ইসলামের বড় কোন ক্ষতি হবে। আল্লাহ যেখানে বলেছেন, তার মনোনীত ধর্ম ইসলাম। তাছাড়া দেশে আইন আছে। কেউ কারো ধর্মে আঘাত করলে আইনের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ আছে। অনেকে এজন্য জেলও খেটেছে। সেখানে কাউকে নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে তার হত্যা কোন ধর্মে আছে। যেখানে রাষ্ট্রকাঠামো ইসলামি নয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ধর্ম। দেশের অগ্রগতি। অনেকে জেনে বা না জেনে ভিন্নমতের প্রতি হিংসাত্মক মন্তব্য করে ইতিহাসের আন্দালুসিয়ার দিকে দেশকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। ফলাফলটা কি ইসলামের জন্য শুভ হবে? জাফর ইকবালের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জঘন্য মন্তব্যকারিদের উদ্দেশ্যে এ প্রশ্নটা রেখে গেলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৪:২৭
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×