২০০২ সালে অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ পান ডেনিয়াল কাহ্নেমান। উনি কিন্তু মোটেও অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেন নাই, উনার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল কগ্নেটিভ সাইকোলজি। উনার গবেষণার বিষয়বস্তু একটু বলি- উনি একজন দৈব চয়নে মানুষ নির্বাচন করলেন। এইবার নির্বাচিত ব্যক্তির ডান হাত ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঠাণ্ডা পানিতে এক মিনিটের জন্য রাখতে বললেন, এক মিনিট শেষ হওয়ার পর বাম হাত আবার ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পানিতে একমিনিটের জন্য রাখতে বললেন কিন্তু এইবার উনি নির্বাচিত ব্যক্তির অজ্ঞাতে অল্প কিছু গরম পানি এড করলেন যাতে পানির তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়। এবং এই ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পানিতে বাম হাত আরও ৩০ সেকেন্ড রাখতে বলা হল। পরীক্ষা শেষে উনাকে জিজ্ঞেস করা হল আপনার কষ্টের অনুভূতি কখন বেশি হয়েছিলি? ডান হাতের সময় না বাম হাতের সময়? সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ৮০ পারসেন্ত লোক বলেছে বাম হাতে কষ্টের অনুভূতি কম ছিল। এর কারণ কি? এর উত্তর হচ্ছে আমারা আসলে কিভাবে চিন্তা করি। দেখুন আপনি যখন একটা মুভি দেখেন তখন আপনি এর ক্লাইম্যাক্স আর এন্ডিং মনে রাখেন। মানে আমরা যে অনুভূতি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাই সেইখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ক্লাইম্যাক্স আর এন্ডিং। কিছু উদাহরণ দেই তাহলে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হবে।
যেমন ধরুন ছোট বাচ্চারা ইনজেকশন নিতে ভয় পায় এই জন্য ডাক্তার যেইটা করে বাচ্চাটার ইনজেকশন নেয়া শেষ হলে তাকে কিছু চকলেট দিয়ে বিদায় করে। এর ফলে যেইটা হয় বাচ্চাটা পরবর্তী রোগের ভ্যাক্সিন নিতে ভয় কম পায়। কারণ বাচ্চাটাকে একটা কষ্টের অনুভূতি শেষে চকলেট দিয়ে খুশি করা হইসে। ওর কাছে এন্ডিং টা আনন্দের ছিল তাই পরবর্তীতে ভয়ের অনুভূতি কমে যায়। ডেনিয়াল কাহ্নেমান এর উক্ত পরীক্ষার সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হচ্ছে সন্তান প্রসব করা। একটা মা যখন সন্তান ধারণ করে তখন তাকে যেই পরিমাণ কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেইটা অকল্পনীয়। তবু মা আবার সন্তান নেয়। এর কারণ হচ্ছে সন্তান প্রসব শেষে মা শরীর থেকে করতিসল, বেটা- এন্দ্রফিন্স এইসব হরমোন বের হয় যা প্রসব যন্ত্রণা প্রশমিত করে, সন্তান সুস্থভাবে পৃথিবীতে পদার্পণ করার পর সন্তানের বাব, দাদা-দাদি, নানা-নানি সবাই ঈদ লাগায়ে দেয়, মা কে অভিনন্দন জানায়। মার কাছে এই শেষের অনুভূতিই মনে থাকে। ফলে সে আবার সন্তান নেয় ঐ শেষের ঐ আনন্দদায়ক অনুভূতিই ফিরে পাবার জন্য ।
ডেনিয়াল কাহ্নেমান এই পরীক্ষাটা অর্থনীতিতে কিভাবে ব্যবহার করা হয় তার একটা উদাহরণ দেই। ২০১৪ সালে ইন্ডিয়া ফার্স্ট স্লোগানের ব্যানারে ভারত প্রভূত উন্নতি সাধন করবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমটায় আসেন। কিন্তু ২০১৪-১৯ সালে এই শাসনামলে ভারতে বেকারত্বের হার ছিল সবচেয়ে বেশি, ইকনমি বেশ বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে। ভারতের রাজনীতি বুঝাই যাচ্ছিল মোদী হারবে ২০১৯ সালের নির্বাচনে। কিন্তু হারে নাই কেন? আপনিও জানেন, আমিও জানি জাস্ট এক বালাকোট দিয়ে কংগ্রেসকে একদম ধুয়ে দিসে। মানুষজন গত ৫ বছর মোদী কি করছে কিচ্ছু মনে রাখে নাই, শুধু নির্বাচনের আগে পাকিস্তানকে শিক্ষা দিতে পারছে, ভগবত ভারতের মর্যাদা রাখতে পারছে এইটাই মোদীকে জয় এনে দিছে। মানুষজন শুধু শেষ কয়েকমাস দিয়ে পুরো পাঁচ বছরের কষ্টের কথা ভুলে গেছে মোদীকে আবার নির্বাচিত করছে।
আমরা আমাদের অর্থনীতি, সামাজিক, রাজনৈতিক যেকোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়াড় ক্ষেত্রে বারবার এই কাজটাই করি। আরও একটা উদাহরণ দেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালির মুসলিনোর উত্থান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই লেখা হয়ে গেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ট্রেন্ট আর ট্রিস্ট নামে দুইটা শহর ইঙ্গ-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। শহর দুইটা দখল করতে ইতালি সৈন্য-সামন্ত পাঠাল। যুদ্ধে ইতালি ১৫ হাজার সৈন্য হারাল। ইতালি আবার সৈন্য পাঠাল এইবার ৪০ হাজার সৈন্য মারা গেল। এইভাবে গুনে গুনে ১১ বার ইতালি হারছে। কিন্তু ইতালির শাসকগণ প্রতিবার বলছে Our boy’s didn’t die in vain । ইতিহাসে এই যুদ্ধ ইসাঞ্জো ব্যাটল নামে পরিচিত। এইযে বারবার সৈন্য পাঠাচ্ছে আর হারছে আর প্রতিবার বলছে আমাদের সেনাদের প্রাণ বৃথা হতে দেব না এর কারণটাই হচ্ছে আমরা ব্যাপারটা এইভাবে বিশ্বাস করতে ভালোবাসি "আমি দেশের জন্য জীবন দিছি" কারণ এতে গৌরব আছে। কেউ কিন্তু কখনওই এইটা বলে না যে "এই যুদ্ধের কারণে আমি পঙ্গু হইছি, আমার পরিবার হারাইছি" কারণ এতে মানসিক কষ্ট বাড়ে। ঠিক এই কারণেই মানবজাতি তার আদর্শের জন্য তর্ক করে। হোক সে কমিউনিস্ট, বাম-ডান পন্থি, উগ্র জাতীয়তাবাদ সে সবসময় মনে করে তার বিশ্বাস বৃথা হতে পারে না।
এই কারণেই তালেবান মনে করে তারা একদিন সারা দুনিয়ায় ইসলাম ছড়াবে, আর বিজেপি মনে করে সারা ভারতবর্ষে একদিন সবাই হিন্দু হবে। সব এক গোয়ালের গরু।
ইউভাল নোয়াহ হারারির হোমো ডিউস বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখাটা লিখেছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৯ রাত ৯:২১