এক.
বাড়ি ফিরে প্রথমেই কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা খুলে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে দিল সমির। তারপর একে একে টাই, আইডি কার্ড, শার্ট খুলে নিল শরীর থেকে। লুঙ্গিটা মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে দিয়ে প্যান্টটা খুলে গত পরশু কেনা ট্রাউজারটা পরে নিল ঝটপট। ঘড়িটা একবার দেখে নিল প্রায় সাথে সাথেই। হাতে মোটেও সময় নেই, তার ওপর যদি আবার জ্যামে পড়া যায় তাহলে তো রক্ষাই নেই।
"রকির সাথে দু'ঘণ্টা ধরে আজাইরা গল্প না করলেই পারতাম।" মনে মনে ভাবে ও। তারপর নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, "যা হবার হয়ে গেছে।"
টি-শার্টটা পরার সময় থাকে না বলে কাঁধে ঝুলিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ও।
****
"স্যার, আজকেও দেরি করলেন?" মুখ বাঁকা করে প্রশ্ন করে জিনিয়া।
"আসলে...
"থাক বলতে হবে না। আজকের মতো মাফ করে দিতে পারি, তবে একটা শর্ত আছে।" চোখেমুখে দুষ্টুমির একটা ভাব ফুটিয়ে তোলে মেয়েটা।
"বলো।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমির। জানে আরও কঠিনতর বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে সে।
"আগামীকাল থেকে মোট পাঁচ দিন নির্ধারিত সময়ের বিশ মিনিট আগে আসবেন। তাহলেই আজকের করা আপনার মহৎ কীর্তিটা আর আম্মুর কান পর্যন্ত যাবে না।"
নিজের ট্রেডমার্ক হাসিটা আরও একবার সমিরকে উপহার দেয় জিনিয়া।
"চেষ্টা করব।" অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে সমিরের কণ্ঠে।
"চেষ্টা নয়, আমাকে প্রমিজ করতে হবে।" ডান হাতটা সমিরের দিকে বাড়িয়ে দেয় জিনিয়া।
অগত্যা কোনো উপায়ান্তর না দেখ সমিরকে জিনিয়ার হাতের ওপর হাত রাখতে হয়। জিনিয়া শিউরে ওঠে সমিরের কঠিন হাতের স্পর্শ পেয়ে। এই স্পর্শের জন্য কত কিছুই না করছে সে! আজ অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে পেয়ে যাওয়ায় যারপরনাই খুশি হয়ে যায় মেয়েটা।
"কোন চ্যাপ্টারে ছিলাম যেন আমরা?" হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কাজের প্রতি মনোযোগী হয় সমির।
"স্যার, আজ আমি পড়ব না। তার চেয়ে আপনি বরং একটু অপেক্ষা করুন। আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে।"
সমির আন্দাজ করার চেষ্টা করে কোন ধরনের সারপ্রাইজ হতে পারে। কিন্তু কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারে না। প্রায় পনের মিনিট পর জিনিয়া ওর পড়ার রুমে প্রবেশ করে। যথারীতি সমির বসে আছে ওর জন্য নির্ধারিত চেয়ারটায়। নূপুরের আওয়াজ শুনে দরজার দিকে তাকায় সমির। সাথে সাথেই ওর চোখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ কী দেখছে সে? একেবারে রাজকন্যার মতো সাজ সেজেছে মেয়েটা।
"স্যার দেখুনতো আমায় কেমন লাগছে?" নিরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করে জিনিয়া।
বিস্ময়ের প্রাথমিক ঘোরটা কাটিয়ে ওঠে সমির।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জবাব দেয়, "অপূর্ব, অদ্বিতীয়া।"
"কী বললেন স্যার?" না শোনার ভান করে জিনিয়া। "আর একবার বলুন প্লিজ।"
"তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।" মুচকি একটা হাসি জিনিয়াকে উপহার দেয় সে।
তারপর জিনিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে নিজের বাড়িতে।
দুই.
"প্ল্যানটা কার? আর কী এমন জরুরি প্ল্যান?" জহিরকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটা করে রাফসান।
"প্রথমত আমাদের কারোরই এরকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি আগে। দ্বিতীয়ত পারফেক্ট একটা গিনিপিগ পাওয়া গেছে একাজের জন্য। তাই জরুরি মিটিংটা করে আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করে ফেলতে চাচ্ছিলাম আরকি।" সবজান্তার ভঙ্গিতে বলে জহির।
সাথে একটা ছোটখাট ম্যাগাজিনের মতো দেখতে কিছু কাগজের বান্ডিল রাফসানের দিকে এগিয়ে দেয়। রাফসান কাগজগুলো হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকে আর মাথাটা উপর নিচে মৃদুভাবে নাড়াতে থাকে। পুরোটা পড়া শেষ করে খুশিতে চোখ চকচক করতে দেখা যায় রাফসানের।
"তাহলে কবে শুরু হচ্ছে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ানোর মিশন?" উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে জহির আর সমিরকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটা করেই ফেলে রাফসান।
"আগামী শনিবার।" সমস্বরে উত্তর দেয় বাকি দুজন।
"ওকে। চেষ্টা করব থাকার।" ছাদ থকে নিচে নামতে নামতে চেঁচিয়ে বলে রাফসান।
রাফসান আপন গন্তব্যে যেতে থাকে আর বাকি দুজন গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা চালিয়ে যায়।
তিন.
"চলো আজ কিছুক্ষণ বাইরে কাটানো যাক।" হাস্যোজ্জ্বল মুখে জিনিয়াকে প্রস্তাব দেয় সমির।
"চলুন।" সানন্দেই রাজি হয় জিনিয়া।
দুজনে পাশাপাশি থেকে মধুর অনুভূতি নিয়ে হাটতে থাকে রাস্তাটা ধরে। এদিকটায় এখনো বড় বড় বিল্ডিং হয়নি। তাই, বাতাস ভালোই মনোরম। কিছুদূর এগিয়ে একটা রিকশা নেয় ওরা। তারপর অজানার উদ্দেশ্যে যেতে থাকে আরো কিছু মধুর সময় কাটানোর লক্ষে।
******
সারাদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে রাতের অন্ধকারের সাথে নিজের নিস্তেজ ভাবটুকু যেন লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছে সবাই। ইলেকট্রিসিটি না থাকাতে পরিবেশটা ক্রমেই আদিম হয়ে উঠছে। মধ্যবিত্তদের অবশ্য সামর্থ্য নেই এই আদিমতাকে লুকিয়ে রাখার। পিচঢালা সড়ক দিয়ে এই আদিম পরিবেশেই হেঁটে চলেছে তিন সদ্য যুবক। আর সাথে চলছে দুর্বার আলোচনা।
"আমাদের তাহলে আগামীকাল বেলা তিনটাতেই হোটেল গ্রিনিসনে থাকা উচিৎ?" রাফসান নিজের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে নেওয়ার ক্ষুদ্র প্রয়াস চালায়।
"আর কয়বার বলব শালা?" বিরক্তি প্রকাশ করে সমির নামের ছেলেটা।
"আচ্ছা, ধন্যবাদ দোস্ত।"
"ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু হইল নাকি এইটা?" ভ্রু কুঁচকে ফেলে সমির। অন্ধকারে সমিরের ভ্রু কোঁচকানো লক্ষ না করলেও কণ্ঠ শুনে ব্যাপারটা আঁচ করতে পারে রাফসান।
"এইতো তোর বাসার সামনে চলে এসেছি। চলে যা ছোট্ট সোনা।" কথার মাঝে শ্লেষ মিশিয়ে দেয় জহির। রাফসান শ্লেষটুকু গায়ে না মেখেই ওদেরকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির অন্তঃদেশে ঢুকে পড়ে।
ওর চলে যাওয়াটা বাকি দুই বন্ধুর আলোচনার গতি আরো বাড়িয়ে দেয় যেন। শুধু বাড়ে না কিছু গাছের কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগের পরিমাণ।
চার.
হোটেল গ্রিনিসন।
২৯ শে আগস্ট, শনিবার।
হোটেলের মূল ফটকে মুজিবুর রহমানের পোস্টার টাঙানো রয়েছে আগস্ট মাস এখনো শেষ হয়নি বলে। তবে ভেতরের ডিজে আর বারগুলোতে বিনোদনের মাত্রার কমতি নেই এতটুকুও। বেলা তিনটা বাজতেই মূল ফটক ধরে ভেতর প্রবেশ করে চার যুবক- যুবতী। তিনজন যুবক এবং একজন যুবতী।
স্পেশাল টেবিলের টিকিট কাটে চারজনেই। অবশ্য যাওয়ার আগে রিসিপশনে একটা কাগজে সই করে যেতে হয়। আস্তে আস্তে টেবিলের চারদিকের চারটা চেয়ারে বসে যায় চারজনেই। কিছুক্ষণ সকলেরই চোখেমুখে বিরাজ করে এক অজানা ভীতির আশংকা।
নিরবতা ভেঙ্গে রাফসানই বলতে শুরু করে প্রথমে, "মানুষের তাজা চোখ। উমমম খেতে বেশ লাগবে। আচ্ছা এর স্বাদ কেমন হতে পারে এর কোনো ধারণা আছে তোদের? আর তোমারও।" জিনিয়ার দিকে আঙ্গুল তুলে নির্দেশ করে ও।
"মনে হয় নোনতা লাগবে।" সহাস্যে বলে জিনিয়া। "যেহেতু চোখের পানি নোনতা।"
"আমার মনে হয় হালকা কটু স্বাদযুক্ত হবে।"
সবজান্তার ভঙ্গিতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে জহির।
"লবণহীন কাঁচা ডিম খেতে যেমনটা হয় তেমনটাই হবে হয়ত।" সবার শেষে বলে সমির।
সমিরের কথাটা শেষ হতেই ওয়েটার এসে হাজির হয়।
"আপনাদের মধ্য থেকে কে পটল তুলতে যাবে তাকে সিলেক্ট করে রাখুন।" খাবারের মেনু বলার পরিবর্তে এটাই বলে ওয়েটার। "সিলেক্ট না করলে লটারি করে যে কোনো একজনকে নিয়ে যাওয়া হবে।"
"আমাকে কেউ বুঝিয়ে কলতে পারবেন?" ওয়েটার চলে যাওয়ার পর সবাইকে উদ্দেশ্য করে জানতে চায় জিনিয়া।
"পটল তোলা মানে নিশ্চয়ই পটল তোলা নয়। ওদেরকে আমাদের দিয়ে ক্ষেতের পটল তোলানোর ততটা গুরত্ব নেই, যতটা আমাদের প্রতি আছে।" প্রায় সাথে সাথেই বলে সমির।
"এনিওয়ান উইথআউট সমির? ক্লিয়ার প্লিজ।" প্রশ্ন করে জিনিয়া।
"মানে, আমাদের মাঝের একজনের বিনিময়ে আমরা তিন জোড়া তাজা চোখ পাব।" পরিস্কার করে রাফসান।
"চল, আমাদের ভোট শুরু হোক। যার চলে যাওয়ার পক্ষে অধিকাংশের মতামত থাকবে সেই মরবে।" প্রস্তাব দেয় রাফসান। "প্রথমে সমির শুরু কর।"
"ও।" জিনিয়ার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয় সমির।
কিন্তু বাকিরা যখন সমিরের যাওয়ার পক্ষে মত দেয় তখন সমিরের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে থাকে। মন হয় পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। রাগে চোখমুখ অন্ধকার হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু সমির তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। জানে, কোনো লাভ নেই। নিজের তৈরি করা ফাঁদে নিজেই আটকে গেছে সে। ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে; অমোঘ মৃত্যুকে মেনে নেওয়ার জন্য।
পরিশিষ্ট.
"তোর কোনো শেষ ইচ্ছা আছে?" রাফসান মুখ উঁচু করে প্রশ্ন করে।
"আছে।" সমির সম্মতি জানায়।
"আচ্ছা, বল। সাধ্যের মধ্যে হলে চেষ্টা করব।"
"আমাকে পারফেক্ট টার্গেট হিসেবে সিলেক্ট করা হলো কেন? আর জিনিয়ার সাথে তোদের পরিচয় কত দিনের?"
জিনিয়া নিজেই বলতে শুরু করে, "আমরা স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড। তোমার সাথে আমার ওটুকু অভিনয় না করলে আমরা আজ তাজা চোখ চিবোতে পারতাম না। তোমার সাথে অভিনয়টা বেশ ভালোই হয়েছে দেখা যাচ্ছে। না হলে তুমি এত সহজে কারো ফাঁদে ধরা দেওয়ার মত নও। আর তোমার পরিবার বলতে কেউ বা কিছু নেই যে আমরা অভিযুক্তের তালিকায় পড়ে যাব।"
"হুম, বুঝতে পারছি।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে সমির।
সাথে সাথে সমিরের সিরিয়ালি মনে পড়তে থাকে জিনিয়ার টিউশনিটা হঠাৎ করেই পেয়ে যাওয়া, জিনিয়ার টেবিলে বছরের শুরুতেও পুরনো বই দেখা, মাঝে মাঝে জিনিয়ার ফোনে রাফসান আর জহিরের কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া, সব। সব। বিশেষ লোকটা এসে সমিরকে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময়ও সমিরকে অস্বাভাবিক স্বাভাবিক দেখে একটু অবাকই হয় ওরা। মিনিট দশেক পরে ওয়েটার এসে তিনটা প্লেটে তিন জোড়া তাজা চোখ দিয়ে যায় ওদের জন্য। সাথে তিনটা কাঁটাচামচও। ওরা কচকচ করে মৃদু শব্দে খেতে থাকে। দূর থেকে এক জোড়া চোখ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। যে দৃষ্টিতে কোনো বিস্ময় নেই, কোনো কৌতূহল নেই।
------------------------------
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ২:০১