এক.
সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে কর্মক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। রাত ১ টা বাজে। ঈদের জন্যই কিছুদিন ধরে দেরি হচ্ছে। হাঁটা পথ। খুব বেশি না; পাঁচ মিনিট হাঁটলেই আমাদের বাড়িতে পৌঁছে যাব।
ঘরের সামনে গিয়ে 'মা' বলে ডাক দিলাম। মা দরজা খুলে দিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন রাতের খাবার খাব কি না। আমার না বোধক উত্তর পেয়ে উনি চলে গেলেন উনার রুমে। স্পষ্টই বুঝতে পারছি এতক্ষণ ধরে মা জেগেই ছিলেন। ভাবলাম গোসল করে নেওয়ার দরকার। শরীর থেকে ঘামের দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। গামছাটা নিয়ে গোসলখানায় চলে গেলাম। বেরিয়ে এলাম ঝরঝরে একটা শরীর নিয়ে। স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুংগিটা পরে বিছানায় গেলাম মোবাইলটা সাথে নিয়ে।
ফেসবুকে ঢুকলাম সাথে সাথেই। অনেকদিন ধরে ভালমত চালানো হয় না জুকারবার্গের এই মহৎ জিনিসটা। চ্যাটলিস্ট রিফ্রেশ করে দেখলাম মাত্র ১০ জন আছে। বাইরের ফ্রেন্ড খুব বেশি নেই আমার। সে হিসেবে নতুন কাউকে দেখারও কথা না। কিন্তু তাই হলো। দেখলাম নতুন একজনকে। 'ঝুমুর সাহা' নামটা অপরিচিতই লাগছে। কবে ঢুকেছে জানি না। এই প্রথম অপরিচিত কারোর উপর আগ্রহ বোধ করলাম আমি।
"কেমন আছেন?" লিখে মেসেজটা সেন্ড করতে যাব এমন সময়ে খুবই পরিচিত একটা কানে এল। 'টুং' । মেসেজটা পড়তে গিয়েই রীতিমত অবাক হতে হলো আমাকে। 'ঝুমুর' নামের মেয়েটাই পাঠিয়েছে মেসেজটা। যদিও খুব একটা বড় আকারের নয় এটা। তাছাড়া মেয়েরা অপরিচিত কাউকে 'হাই' ,`হ্যালো' ছাড়া অন্য কিছু প্রথম মেসেজে কিছু পাঠায় কি না আমার জানা নেই।
"জ্বি, বলুন।" রিপ্লাই দিলাম আমি।
"কেমন আছেন?" ১০ সেকেন্ডের মধ্যে রিপ্লাই দিল মেয়েটা।
"ভাল। আপনি?"
"জ্বি, আমিও। আচ্ছা, ঈদের জন্য কী কী কিনলেন?" আগ্রহ প্রকাশ পেল মেয়েটার ম্যাসেজে।
"দুইটা টি-শার্ট, একটা জিন্স প্যান্ট, জুতা এই আর কি। আপনি?"
"আমি হিন্দু।"
"ওহ, স্যরি। খেয়াল ছিল না।" তাড়াতাড়ি রিপ্লাই দিলাম আমি।
"তবে পুজোর সময়ে কিন্তু আমিও আপনাকে একই প্রশ্ন করব।" হাসির ইমো দিল মেয়েটা।
"আচ্ছা, ঠিক আছে। করবেন। আজ এই পর্যন্তই। কাল সকাল ৭ টায় দোকানে যেতে হবে, কাজের চাপ প্রচুর।" মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে আর দেরি করলাম না। সত্যিই আমার জন্য একজন অপেক্ষা করে আছে।
ঘুমপরী!
দুই.
ঈদটা পার হয়ে গেছে আজ চারদিন হলো। এর মধ্যে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ করে ঝুমুরের সাথে বেড়েছে ঘনিষ্ঠতা। বেশ ফ্রি হয়ে গেছি ওর সাথে। প্রতিটা মুহূর্তই ধরতে গেলে ওর খোঁজখবর নেওয়ার মধ্যেই কাটে। মেয়েরাও যে এত কেয়ার করতে পারে তা জানা ছিল না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার জন্য বাড়ির পথে রওয়ানা দিলাম। হাঁটতে হাঁটতেই সেই পরিচিত শব্দটার সাথে আরো একবার পরিচিত হওয়ার সুযোগ হলো।
"কী খবর?" রিপ্লাই দিলাম আমি।
"খবর আর কী। তুমি যেমন নাও তেমনই আছে।" স্যাড ইমো দিলো মেয়েটা।
"আরে, আরে! হঠাৎ স্যাড ইমো কেন?"
"তোমার আর আমার মাঝে যে সম্পর্কটা চলছে এটা কী? অথবা এটাকে কি বলা যায়?" খুব দ্রুত উত্তর দিল ঝুমুর।
"ফ্রেন্ডশিপ।" লিখে দুই সেকেন্ড ইতস্তত করে পাঠিয়ে দিলাম আমি।
"এর বেশি কিছু না? আর দুইশ মাইল দূরে থেকে ফ্রেন্ডশিপ রেখে কী হবে? বছরে একবারও বোধ হয় দেখা করতে পারব না। আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।"
"বলবে? তাহলে তো শোনার ব্যাবস্থা করতে হয়। চ্যাটে কিন্তু কিছু শোনা যায় না।" রিপ্লাই দিলাম আমি।
এরপর ঝাড়া এক মিনিট পার হয়ে গেল। কোন রিপ্লাই আসেনি দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। চিন্তা করতে করতে সামনে থাকা ইটের টুকরার সাহায্যে চমৎকার একখানা হোঁচট খেলাম। তখনই বোধোদয় হলো, বাড়ির সামনে চলে এসেছি।
বাড়ির সামনের রাস্তাটা ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলাম বাড়িটা অতিক্রম করে। খুব টেনশন হচ্ছে মেয়েটার রিপ্লাই না পাওয়াতে। হঠাৎ অচেনা একটা নাম্বার থেকে ফোন এল ডেটা কানেকশনের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে। বিরক্ত হয়ে রিসিভ করলাম কলটা।
"হ্যালো।" মেয়েলী গলায় বলল কেউ।
"জ্বি, বলুন।" নিচু স্বরে বললাম আমি।
"আপনিই মিজান?" কৌতূহল স্পষ্ট হলো মেয়েটার।
"জ্বি। আর আপনি? ঝুমুর?"
"হ্যাঁ। কথাটা তাহলে বলেই ফেলি। আপনি না শুনতে চেয়েছিলেন?"
"হ্যাঁ, উমমম.... আচ্ছা বলো।" তুমিতে চলে এলাম আমি। যাকে তুমি সম্বোধন করি আগে থেকেই তাকে নতুন কোন সম্বোধনের জালে জড়ানোর ইচ্ছা আমার নেই।
"আমি আপনাকে ভালবাসি।"
"দেখ, আমাদের মাঝে এটা সম্ভব নয়।" ঝুমুরকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমি। "প্রথমত, আমরা দুজন দুই ধর্মের মানুষ। আমাদের কারোরই বাবা মা এটা মেনে নিবেন না। আর সমাজ তো দূরে থাক। জীবনের প্রতিটা পদে পদে বাধার সম্মুখীন হব আমরা....
"আমি কিছুই শুনতে চাই না, একটা কথা ছাড়া। সেটা- তুমি আমাকে ভালবাসো।"
মেয়েটার সাহস দেখে অবাক হলাম, সাথে ভালোও লাগল। তবুও সাহস করে উত্তর দিলাম, "আমার পক্ষে অসম্ভব, দুঃখিত।"
"আচ্ছা, ঠিক আছে। সমস্যা নেই।" সরলভাবে উত্তর দিল ঝুমুর। আমি ওর কথা বলার সহজ ভংগিতে ভয় পেয়ে গেলাম।
"ধন্যবাদ, রাখি।"
তিন.
তারাভরা আকাশে চাঁদের চিহ্নটুকুও নেই। তবুও খুব একটা খারাপ লাগছে না। চারপাশের ঝিঁ ঝিঁ পোকারা তাদের আওয়াজের মাধ্যমে পরিবেশকে আরো গম্ভীর করে তুলেছে। হেঁটে বাড়ি ফিরছি। ঝুমুরকে ফোন দেওয়ার ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখলাম। সামনে ওর পরীক্ষা। এইচ.এস.সি পরীক্ষা। আচ্ছা, মেয়েটা কি আমার মনের কথা বোঝে না? বোঝে না যে আমি আস্তে আস্তে ওর মায়ায় পড়ে গেছি? কি জানি বাপু, কবি-সাহিত্যিকরা তো বলেন মেয়েরা আগে থেকেই প্রেমঘটিত ব্যাপার স্যাপার বুঝতে পারে।
বাড়িতে পৌঁছে প্রতিদিনের মতই গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। মোবাইলটা বালিশের পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম দ্রুতই।
****
আমি আর ঝুমুর পার্কে বসে আছি। ওকে আমি আগেই দেখেছি, ফেসবুকে। তবুও কিছুটা পার্থক্য তো আছেই। ফেসবুকে দেখেছিলাম ওর ব্লার ফটো। আর এখন ক্লিয়ার। গায়ের রং শ্যাম বর্ণের। কিন্তু সেই চেহারাটা! উহু, এমন মায়াবী মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি। যে মেয়ের চোখ দুটো দেখলেই হাজার বার বার প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করে সেই মেয়েই আমার পাশে বসে আছে! কিন্তু সমস্যাটা হলো, আমি ওর প্রেমে হাজার বার নয়, লক্ষ বার পড়েছি!
"চলো, ওই শপিং কমপ্লেক্সটা থেকে ঘুরে আসি।" আবদার করল ঝুমুর হঠাৎ করেই।
"আচ্ছা।" আমিও দ্বিমত করলাম না।
দুজনে মিলে বাহারি রকমের দোকানের আশপাশ দিয়ে চলাফেরা করছি। ঝুমুর আমার হাত ধরে আছে। একটা দোকান পার হয়ে একেবারে দালানের শেষ প্রান্তে চলে এলাম আমরা। রেলিংটা ধরতেই বুঝলাম ওটা কাঁপছে। ভূমিকম্প!
***
আসলে আমার ফোনটা বাজছে। সাথে ভাইব্রেশনও হচ্ছে। ফ্লিপ কভারটা উল্টিয়ে দেখলাম ঝুমুর ফোন দিয়েছে। রিসিভ করলাম।
"তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।" বললাম আমি
"হুম, বলো।"
"আমি তোমাকে ভালবাসি।"
"এটা বাদে অন্য কিছু বলো।" অনুরোধের সুরে বলল ঝুমুর।
"আসলে আমিই আমার সুযোগটা হারিয়েছি। প্রথমবারেই তোমাকে এক্সেপ্ট করলে আর এত ঝামেলা হত না।" স্বরটা আরো একটু নিচু করলাম।
"আমি তখন ভুল ছিলাম।"
"প্লিয।"
"আচ্ছা।" কণ্ঠে হাসি ফুটিয়ে তুলল মেয়েটা।
"কী?" না জানার ভান করলাম।
"আমিও তোমাকে ভালবাসি।"
চার.
কথায় বলে, মানে আমিই বলি আর কি, 'সম্পর্ক যায়, সম্পর্ক আসে। কিন্তু মন দিয়ে দিলে তা আর ফেরত নেয়া বা ফিরিয়ে আনা, কোনটাই করা যায় না।' আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শতভাগ সত্যি। ঝুমুরকে দেয়া মন আমি কখনোই ফিরিয়ে নিতে পারব না।
ওর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল গত মাসের তিন তারিখে, আর কথা হয়েছিল গত শুক্রবারে। আস্তে আস্তে মনে হয় ও আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নিজের ভবিষ্যৎ গুছাবার জন্য? নাকি অন্য কোন হরিণ শিকার করতে? নাকি প্রচণ্ড ব্যাস্ততা?
তৃতীয়টা ঠিক হলেই খুশি হব। ওর বান্ধবীদের কাছে শুনেছিলাম ও নাকি এখনো আমার কথা বলে। কিন্তু কেন ফোন দেয় না তা ভেবে পাই না। হঠাৎ হঠাৎ বলে, "তোমাকে এখনো ভালবাসি মিজান।" আবার পরক্ষণেই বলে, "না, না। আমি মজা করছিলাম।"
গত চার সপ্তাহ ধরে এমনই করছে ও। জানিনা, কবে আবার ও আমাকে ফোন করে একবার বলবে, "আমি তোমাকে ভালবাসি।" তবে জানি, ও ফিরবে।
আমার হয়ে।
-------------০---------------