somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অফেন্ডিং শেখ মুজিব-১ : ২৫ মার্চ , ১৯৭১ , টাইম ম্যাগাজিনের অদ্ভুত তথ্য

২৪ শে মে, ২০১০ রাত ১০:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



২৫ শে মার্চের কালো রাত - স্বাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত গা হিম করা এক রাত। এই রাতের প্রতিমুহূর্ত জানার অদম্য কৌতূহল কাজ করে স্বাধীনতা প্রিয় এবং এখনও অন্তরে পাকিস্তান প্রিয় সবার ভেতরে।

অনেক আলোচনা , তথ্য উদঘাটন , ইরফরমেশন ডায়াগনসিস হয়েছে এই রাতের কুখ্যাত-বিখ্যাত ঘটনাগুলো নিয়ে।
তার ভেতরে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ছিলো সেই রাতে পাকিস্তান আর্মির হাতে শেখ মুজিবের আটক হওয়া নিয়ে।
সেটা কি আত্নসমর্পন না গ্রেফতার ছিলো ?
সেটা কিভাবে ঘটেছিলো ?
এই নিয়ে খোদ সেই ঘটনার ভিলেন পাকিস্তানী আর্মির ব্রিঃ জেনাঃ জহিরুল আলম খান নিজেও বই লিখেছেন "দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ"।
সিদ্দিক সালিকের বই , মুসা সাদিকের টিক্কা খানের সাক্ষাৎকার নেয়া অনেক কিছুই হয়েছে ২৫ শে মার্চের ইনফরমেশন ডায়াগনসিস করতে গিয়ে।
তাই বিষয়টা নিয়ে আর জানার কিছু নেই ভেবে ক্ষান্ত দিয়েছিলা।

কিন্তু নানাভাবে সেদিন রাতের ঘটনাগুলোর টুকরো টুকরো প্রামান্যের সাথে পরিচিত হতে হতে মনে হলো এগুলো একসাথ করে জানালে ২৫ শে মার্চ , ১৯৭১ এর একটা পরিষ্কার অবয়ব পাওয়া যাবে।

তবে সব গুলো ঘটনাকে সাজাতে গিয়ে শেষ অনুসিদ্ধান্তটি আসলো শেখ মুজিবের নেতৃত্ববীর্য কে ম্লানকর।
তাই শিরোনাম:
"অফেন্ডিং শেখ মুজিব"

দেখা যাক সেদিন রাতের ঘটনাক্রম:

সন্ধ্যা ৬:০০ :
সুপরিচিত পাকিস্তানী সাংবাদিক তারিক আলীর পিতা মাজহার আলী এবং রেহমান সোবহান শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন এবং তাকে জানান মিলিটারী ক্র্যাকডাউন আসন্ন।
[ সূত্র: বাংলাদেশের অভ্যুত্থান এবং একজন প্রতক্ষ্যদর্শীর ভাষ্য , রেহমান সোবহান , ভোরের কাগজ প্রকাশনী , ১৯৯৪ ]

শেখ মুজিব এরপর ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকেন।
এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১জন সংবাদবাহক স্থানীয় এবং বিদেশী সাংবাদিকদের মাঝে ১টি প্রেসনোট বিলি করেন যেটিতে উল্লেখ করা হয়:
"প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা চুড়ান্ত হয়েছে , ক্ষমতা হস্তান্তরের মতানৈক্য হয়েছে এবং আমি (বংগবন্ধু) আশা করি প্রেসিডেন্ট তা ঘোষনা করবেন"।
এবিষয়ে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বলেন:
"আমার দুঃখ হয় , এই নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে আমার কোন মন্তব্য নেই"
[ সূত্র: রেপ অব বাংলাদেশ , অ্যান্থনি মাসকারেনহাস , অনুবাদ মযহারুল ইসলাম , ১৯৭৩ , পৃষ্ঠা:১১৩ ]

২৫ শে মার্চ ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর ভেতর ৪৫ মিনিটের ১টি মীটিং হয়।
শেখ মুজিব পূর্বঘোষনা অনুযায়ী ২৫শে মার্চে ইয়াহিয়ার ভাষনের জন্য অপেক্ষা করেন।

সন্ধ্যা ৬:০০ টা পরবর্তী:
ইয়াহিয়া করাচীর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার এই ঢাকা ডিপারচার এর প্রতক্ষ্যদর্শী ছিলেন ২ জন বাঙালী সামরিক কর্মকর্তা।
১. ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে এটি প্রতক্ষ্য করেন লে. কর্নেল এ. আর চৌধুরী।
২.বিমানবন্দরে এটি প্রতক্ষ্য করেন এয়ারফোর্সের গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খোন্দকার।


শেখ মুজিব তখনো ১ টি ফোনকলের অপেক্ষায় ছিলেন।এবং ডঃ কামাল হোসেন কে বার বার জিজ্ঞেস করছিলেন কোন ফোন এসেছে কিনা।
প্রতিবারই ডঃ কামালের উত্তর ছিলো না সূচক।
ফোনটি আসার কথা ছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেঃ জেনাঃ পীরজাদার কাছ থেকে।
কারন ইয়াহিয়া বলেছিলো তার ভাষন প্রচারের আগে পীরজাদার সাথে শেখ মুজিবের ১টি ছোট বৈঠক হবে।
সেই ফোনকল আর আসেনি কোনদিন।শেখ মুজিবও বুঝতে পারেন সব আশা শেষ। ইয়াহিয়া ধোঁকা দিয়েছে।
[ সূত্র : বংগবন্ধু শেখ মুজিব , জীবন ও রাজনীতি , ১ম খন্ড , সম্পাদক মোনায়েম সরকার , বাংলা একাডেমী ২০০৮ , পৃষ্ঠা:৪৪৭ ]



রাত ৮:০০:
এরকম একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে এইচ এম কামরুজ্জামান , ক্যাপ্টেন মনসুর আলী , তাজউদ্দীন আহমদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে চলে যান।
শেখ ফজলুল হক মনি ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যায়ই টুংগীপাড়া চলে যায় এবং শেখ কামাল রাত ৯টায় ধানমন্ডী ৩২নং ছেড়ে যান।
[ সূত্র : শেখ মুজিব , এস.এ. করিম, ইউপিএল, ২০০৫, পৃষ্ঠা ১৯৫ ]

রাত ৯:০০:
ডঃ কামাল হোসেন এবং ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম ৩২নং থেকে বিদায় নেন।



রাত ৯:১০:
ঠিক এই সময়েই প্রথমবারের মত গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন জানান রেহমান সোবহান। [ সূত্র : প্রাগুক্ত ]

রাত ১০:৩০:
ইস্ট পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের এম.ডি. ক্যাপ্টেন রহমান এবং ২ জন এক্স নেভাল অফিসার কমান্ডার ফারুক এবং লে. মতিউর রহমান শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে আসেন।
এ সময় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ প্রধান আব্দুর রাজ্জাক এর ১টি ফোন আসে শেখ মুজিবের কাছে এবং "ইপিআর কে ডিসার্মড করা হয়েছে" শেখ মুজিব কে এতটুকু বলতে না বলতে লাইন কেটে যায়।
[ সূত্র : শেখ মুজিবের বাসভবনে সে সময় অবস্থানরত পারিবারিক কর্মচারী মমিনুল হক খোকা , প্রাগুক্ত , পৃষ্ঠা - ৪৪৭-৪৮ ]

রাত ১১:০০:
আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ প্রধান আব্দুর রাজ্জাক শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাত করে তাঁকে আত্মগোপন করার অনুরোধ জানালে, শেখ মুজিব তাকে জানান তিনি বাসা ছেড়ে যাবেননা , মরতে হলে সেখানেই মরবেন।
[ সূত্র : আর্চার ব্লাড, দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ, ইউপিএল, ২০০৬, পৃষ্ঠা ১৯৮]
যদিও শেখ মুজিবের এই মুখের গর্জন শেষ পর্যন্ত একেবারেই বর্ষায়নি
বাস্তবিকভাবে।
রাত ১১:০০:
সিরাজুল আলম খান , আ.স.ম আব্দুর রব , শাহজাহান সিরাজের শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে ধানমন্ডী ৩২নং ত্যাগ করেন।
ওয়াজেদ মিয়ার বক্তব্য অনুসারে এটাই ছিলো শেখ মুজিবের সাথে কারো ঐ রাতে শেষ বৈঠক।

১১:৩০:
ওয়াজেদ মিয়ার বক্তব্য অনুসারে ঝন্টু (জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা জাকারিয়া চৌধুরীরা ভাই) ধানমন্ডী ৩২নং এ আসেন। শেখ মুজিব কে ঝন্টু অপারেশন সার্চলাইট এবং নির্বিচার গোলাগুলির খবর জানান।
ঝন্টুর মাধ্যমে পরিস্থিতি অবগত হয়ে শেখ মুজিব হাসিনা , রেহানা এবং জেলীকে ১টি ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দেন আত্নগোপন করার জন্য।
শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের আত্নগোপনের জন্য ঐ ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয়া হয়েছিলো।
ওয়াজেদ মিয়া নিজেও ১১:৩০ এর পর ধানমন্ডী ৩২নং ত্যাগ করেন।
[ সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ইউপিএল, ২০০০, পৃ ৮৪ ]

"সেদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শেখ মুজিবের বাসায় ছিলো মানুষের ঢল।কিন্তু ইয়াহিয়ার ঢাকাত্যাগের খবর প্রকাশ হয়ে পড়ায় এবং সেনাবাহিনীর মতিগতি দেখে সন্ধ্যার পর থেকেই ঢাকার সর্বত্র বাড়তে থাকে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা।
এ পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব ১ বিবৃতিতে বিভিন্নস্থানে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষনের প্রতিবাদে হরতাল আহ্বান করেন।"
[ সূত্র : বংগবন্ধু শেখ মুজিব , জীবন ও রাজনীতি , ১ম খন্ড , সম্পাদক মোনায়েম সরকার , বাংলা একাডেমী ২০০৮ , পৃষ্ঠা:৪৪৭ ]

ইত্তেফাকের শিরোনাম: মার্চ ২৬ , ১৯৭১



পিপল'স ভিউ'র শিরোনাম: মার্চ ২৬ , ১৯৭১




রাত ১:০০:
রাত ১ টায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মত পাক আর্মির ১ম দলটি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে ফার্মগেটের নিকট ব্যারিকেডের সম্মুখীন হয়।
রাত ৯:৩০ তেই সেনাবাহিনীর বহর কে বাধা দেয়ার জন্য রাস্তায় গাছ ফেলে অসংখ্য মানুষের জমায়েত হয় সেখানে। প্রতিরোধ তখনই শুরু হয়ে যায় পাক আর্মির বিরুদ্ধে।
[ সূ্ত্র : উইটনেস টু সারেন্ডার , সিদ্দিক সালিক , ইউপিএল , ১৯৭৭ , পৃষ্ঠা ৭৩]

এই ছিলো শেখ মুজিবের গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সেদিনের ঢাকা এবং ধানমন্ডী ৩২নং এর ঘটনাক্রম এবং শেখ মুজিবের মানসিক অবস্থা।

এবার যাওয়া যাক ফোকাল পয়েন্ট বা শেখ মুজিব গ্রেফতারের বিষয়টাতে।
মার্চ ২৫ , ১৯৭১ 'র কালোরাতে শেখ মুজিব বুকচেতা দৃড়তা নিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন না নমনীয় মেরুদন্ডে আত্নসমর্পণ করেছিলেন এটা নিয়ে অনেক বছরই বিতর্ক জিইয়ে ছিলো।
যাইহোক- সেই বিতর্ক ধোপে টিকবেনা বুঝতে পারেই "শেখ মুজিব আনত মেরুদন্ডে গ্রেফতার হয়েছিলেন " পন্থী ইতিহাসবিদ এবং বুদ্ধিজীবিরা মেনে নিয়েছেন :
"শেখ মুজিব আত্ন সমর্পন করেছেন" এবং বিষয়টা সেই পরিস্থিতিতে কিভাবে সঠিক ছিলো সেটা জাস্টিফাই করাটাকে অপশন অব টাস্ক হিসেবে নিয়েছেন।

এ বিষয়ে এপ্রিল ৩ , ২০০৯ এ প্রথম আলোতে হাসান ফেরদৌসের কলাম দেখুন :
বঙ্গবন্ধু কেন আত্নসমর্পন করেছিলেন : হাসান ফেরদৌস , এপ্রিল ৩ , ২০০৯ , প্রথম আলো

যাইহোক , নীচে কলামটির ইমেজ আপলোড করলাম:


সামনের পর্বে এই কলামটির বেশকিছু তথ্য কতটুকু অতিরিক্ত গরমিল পূর্ন সেটা আলোচনায় থাকবে।
এই পর্বে এটি তুলে ধরে ধরলাম এই জন্য যে : শেখ মুজিব আত্নসমর্পন করেছেন-এটি ধ্রুব সত্য।

শেখ মুজিবকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে আরো ১টি বিতর্ক প্রায়ই উঠে আসে যে তিনিতো পাহাড়ী বিপ্লবী নেতাদের মত আত্নগোপন করেননি। অথচ শেখ মুজিবের সিদ্ধান্ত ছিলো যেকোন জরূরী পরিস্থিতিতে ৭০ 'র নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের সকল এমএনএ সহ তিনি এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আত্নগোপন করবেন।

মার্চের অস্থির অনিশ্চিত সময়টাতে মিলিটারী ক্র্যাকডাউন হলে শেখ মুজিব কি করবেন সেই বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত হয়েছিলো সেটা জোহরা তাজউদ্দীনের মুখে শুনুন:



"বংগবন্ধু , তাজউদ্দীন এরা সবাই আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যাবার " সিদ্ধান্তে খুব সহজেই বোঝা যায় শেখ মুজিবের নেতৃত্ব মেরুদন্ডে তখন চিড় ধরেছে এবং শেখ মুজিবতো পাহাড়ী নেতাদের মত আত্ন গোপন করেননি এই বক্তব্যও ধোপে টেকেনা।
এছাড়া ইতিপূর্বে জানিয়েছি শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের আত্নগোপন করার উদ্দেশ্যে ১টি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়া হয়েছিলো যেখানে রাত ১১:৩০ এর পর শেখ মুজিব হাসিনা , রেহানা , জেলী এবং ওয়াজেদ মিয়াকে পাঠান।

শেখ মুজিবের আত্ন সমর্পন কে সঠিক প্রমান করার করে তার নেতৃত্ব পৌরূষের ঔজ্জ্বল্য ঠিক রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা যারা করছেন অনবরত তাদের জন্য আরো ১টি বিষয় তুলে আনলাম।

৯ মাসের রক্তঝরা মুক্তিযুদ্ধে কোন পাকিস্তানীর অনুতাপ-ব্যথানুভূতি হয়েছিলো কিনা বাঙালীর দুর্দশা দেখে তা নিয়ে বিস্তারিত জানিনা , তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযু্দ্ধের ১ অকৃত্রিম পাকিস্তানী বন্ধুকে চেনানো প্রয়োজন।
তিনি খান আবদুল ওয়ালী খান।
মহাত্না গান্ধীর সহচর সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফ্ফার খানের ছেলে ওয়ালী খান।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের নেতা।
ওয়ালী খান সম্পর্কে জানতে উইকিতে যান:
উইকিপিডিয়ায় ওয়ালী খান
ভূট্টোর সাথে মুজিবের যেমন আপোষরফা হয়নি ঠিক তেমনি ওয়ালী খানের সাথেও ঘাড়মোটা ভুট্টোর বনিবনা হয়নি পাকিস্তানের আফগান সীমান্তবর্তী এলাকার স্বায়ত্বশাসন প্রশ্নে ১৯৭২ এ।১৯৭৫ এ তার দলকেও ভুট্টো নিষিদ্ধ করেছিলো।
নীচের ক্লিপটি দেখুন:



বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তার অবস্থান জানিয়ে ৩ টি তথ্য জানাই:

১. বাংলাদেশের মানুষের উপর হায়েনার মত বর্বর মিলিটারী আক্রমন চালানোর প্রতিবাদ জানানোর কারনে ১৯৭১ নভেম্বরে তার দল ন্যাপ (ওয়ালী) কে ইয়াহিয়া খান নিষিদ্ধ করে ঠিক যেভাবে ২৫ শে মার্চে CMLA আদেশ জারী করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো।

২. এই ওয়ালী খান যুদ্ধ বেধে যাওয়ার পর ১ বাঙালী কূটনীতিকের ছেলেকে পশ্চিম পাকিস্তান ছেড়ে আফগানিস্তানে পালাতে সাহায্য করেন।

৩. এই ওয়ালী খানই ১ মাত্র পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতা যিনি এবং যার দল শেষমুহূর্ত পর্যন্ত চেয়েছিলেন শেখ মুজিব যাতে ৭০'র নির্বাচনী ফলাফল অনুযায়ী সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন।
সেই উদ্দেশ্যে তিনি তার দলের আরো কিছু রাজনীতি বিদদের নিয়ে ২৩ শে মার্চ শেখ মুজিবের বাসায় আসেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের জন্য তার দল ন্যাপ (ওয়ালী) এর সমর্থন জানাতে।
আর তখন ঘাড়মোটা ভুট্টো তার দলের এম.পি. দের কে বলেছিলেন অ্যাসেম্বলীতে যোগ দিলে ঠ্যাং ভেঙে দেয়া হবে, শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান শাসন করবে , তবে কোনভাবেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেনা।


ছবিঃ ২৩ শে মার্চ শেখ মুজিবের বাসায় ওয়ালী খান , শেখ মুজিব যাকে আলিংগন করতে যাচ্ছেন।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস উল্লেখ করেছেন এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ২২ মার্চ , ১৯৭১।



সেদিনের সেই বৈঠকে ওয়ালী খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের ব্যাপারে সতর্ক করতে গিয়ে বলেছিলেন: "তারা হয়তো আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে।"
প্রত্তুত্তরে শেখ মুজিব হেসে বলেছিলেন: "করতে চাইলে করুক , আমিতো স্যুটকেস রেডীই রেখেছি।"
সূত্র: ওয়ালী খানের নিজ মুখের বয়ান।

এই বক্তব্যের সাপোর্টিং ক্লু আরো ১ জায়গাতে পাওয়া যায়।

" আগের রাতে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ গোয়েন্দা সূত্র আওয়ামী লীগকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলার কথা জানিয়ে দেয়।
জেনারেল ওসমানী ধানমন্ডির বাসভবনে আসেন শেখের সঙ্গে দেখা করতে এবং তিনি তাকে একই খবর দেন।
ওইদিন শেষ রাত পর্যন্ত করণীয় নিয়ে তারা আলোচনা করেন।
সিদ্ধান্ত নেয়া হয় - তারা আত্মগোপন করবেন এবং পালিয়ে ভারতে চলে যাবেন।
কিন্তু ২৫ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তাজউদ্দিন এসে দেখেন তিনি তার বিছানাপত্র গুছিয়ে তৈরি হয়ে আছেন। মুজিব তাকে বললেন যে, তিনি থেকে যাবেন- গ্রেপ্তার বরণ করবেন। "
-পশ্চিম বাংলার সাংবাদিক জ্যোতি সেন গুপ্ত
[ সূত্র : মাসুদুল হক , দৈনিক ইনকিলাব ২৬.৩.২০০৬ ]

আশা করি জোহরা তাজউদ্দীনের নিজ মুখের বক্তব্যের সাথে জ্যোতি সেন গুপ্তের বক্তব্যের মিল (আত্নগোপন) খুঁজে পেয়েছেন।
এখানে আরো ১ টি টাইমিং মিলে গেছে।
জ্যোতি সেন গুপ্তের মতে তাজউদ্দীন আহমেদ সাড়ে ৭ টায় মানে ৭:৩০ এ ধানমন্ডী ৩২ নং এ যান শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে
এবং উপরে ঘটনাক্রমের রাত ৮:০০ টায় তাজউদ্দীন সহ অন্য নেতারা ধানমন্ডী ৩২ নং থেকে বিদায় নেন।

টাইমিং এর এই বিষয়টি জোহরা তাজউদ্দীনের মার্চ ২৬ , ২০০৯ এ প্রথম আলোতে প্রকাশিত কলামেও পাওয়া যায়






এই বিষয়ে সামান্য পেছনের আরো ১টি তথ্যও বোধকরি প্রাসংগিক:

" ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে দেশে দ্বিতীয় দফা সামরিক আইন জারি হলো। শেখ সাহেব তখন ঢাকায়। শুনলাম তিনি চট্টগ্রাম সফর বাতিল করেছেন। চারিদিকে অসংখ্য প্রত্যাশা-ব্যাকুল মুখে ( যে প্রত্যাশা শেখ সাহেব নিজেই সৃষ্টি করেছেন) একটি মাত্র প্রশ্নের গুঞ্জরণ শুনলাম।
শেখ সাহেব এখন কি করবেন?
তিনি দেশের মানুষকে কি নির্দেশ দেবেন? পরদিন কাগজ উল্টালাম।
না কিছু নেই।
বিকেলে বহুদিন পর আবার ধানমন্ডীর বত্রিশ নম্বর রাস্তার দিকে এগোলাম। চারদিকে ঝিরঝিরে বিকেলের বাতাস।
আমাকে দেখে (শেখ মুজিব) বিমর্ষ হেসে বললেনঃ আসুন চৌধুরী আসুন। বললামঃ ব্যক্তিগত সাক্ষাতের জন্য নয়, সাংবাদিক হিসেবে এসেছি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মত কি?
শেখ সাহেব বললেনঃ আমি তৈরি হয়ে রয়েছি।
আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম।
জিজ্ঞেস করলামঃ তৈরি হয়ে রয়েছেন কিসের জন্য?
তিনি বললেনঃ সুটকেস গুছিয়ে রেখেছি , যদি নিতে আসে , তারা দেখবে আমি তৈরি। জেলের গাড়িতে উঠে পড়বো।
আমি হতাশ কণ্ঠে বললামঃ শুধু জেলে গেলেই কি আপনার সব সমস্যার সমাধান?
তিনি আগের মতোই নিস্পৃহ কণ্ঠে বললেনঃ আর কি করতে পারি? আমি সুটকেস গুছিয়ে তৈরি হয়ে রয়েছি।
- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
[ সূত্র : অক্টোবর ৯ , ১৯৭০ , দৈনিক পূর্বদেশ , তৃতীয় কলাম ]

এবার আসুন শেখ মুজিবের গ্রেফতার বিষয়ে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) জহিরুল আলম খানের বক্তব্য কি :

" তল্লাশী চালানোর জন্য এরপর একটি দল ঢুকলো। প্রহরীদের একজনকে বলা হলো রাস্তা দেখাতে। কিছুদূর যাওয়ার পর তার পাশে থাকা সৈন্যকে দা দিয়ে আক্রমণ করতে গিয়েছিলো সে, কিন্তু জানতো না তার উপর নজর রাখা হচ্ছে। তাকে গুলি করে আহত করা হয়। এরপর সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো সার্চপার্টি। একের পর এক দরজা খুলে কাউকে পাওয়া গেলো না। একটা রুম ভেতর থেকে আটকানো ছিলো। ওপরে ওঠার পর কে যেন আমাকে বললো বদ্ধ ঘর থেকে কেমন অদ্ভুত শব্দ আসছে । মেজর বিল্লালকে বললাম দরজা ভাঙতে। আর আমি নীচে নামলাম ক্যাপ্টেন সাঈদের দল এলো কিনা দেখতে।
সাঈদের সঙ্গে কথা বলার সময় একটা গুলির শব্দ হলো। এরপর গ্রেনেড বিস্ফোরন ও তার সাথে সাব-মেশিনগানের ব্রাশ। ভাবলাম কেউ হয়তো শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি সেই বদ্ধ রুমের দরজায় দাড়িয়ে মুজিব। রীতিমতো সন্ত্রস্ত।

পরে জানতে পারলাম মেজর বিল্লালের লোকেরা যখন দরজা ভাঙার চেষ্টা করছিলো তখন কেউ একজন সেদিকে পিস্তলের গুলি ছোড়ে। ভাগ্যক্রমে কারো গায়ে তা লাগেনি। বাধা দেয়ার আগেই বারান্দার যেদিক থেকে গুলি এসেছিলো সেদিকে গ্রেনেড ছোড়ে একজন সৈনিক। এরপর সাবমেশিনগান চালায়। গ্রেনেডের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির আওয়াজে বদ্ধ সে রুমের ভেতর থেকে চিৎকার করে সাড়া দেন শেখ মুজিব এবং বলেন তাকে না মারার প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি বেরিয়ে আসবেন। নিশ্চয়তা পেয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। বেরুনোর পর হাবিলদার মেজর খান ওয়াজির (পরে সুবেদার) তাকে শারীরিকভাবে অপদস্থ করেন।

শেখ মুজিবকে বললাম আমার সঙ্গে আসতে। উনি জানতে চাইলেন পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারবেন কিনা। আমি তাকে তা জলদি সারতে বললাম। এরপর গাড়ির দিকে হাটা ধরলাম। এরমধ্যে সদরে রেডিও বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছি যে আমরা শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেছি। (বিগবার্ড ইন কেইজ)।
মুজিব এবার বললেন ভুলে পাইপ ফেলে এসেছেন তিনি। আমাকে নিয়ে পাইপ আনতে গেলেন আবার। এরমধ্যে মুজিব আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন। টের পেয়ে গেছেন তার কোনো ক্ষতি করা হবে না।বললেন, তাকে ফোন করে বললে তিনি নিজেই চলে আসতেন।"
-বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জহিরুল আলম , ইনচার্জ - অপারেশন বিগবার্ড
[ সুত্র: দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ ,
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : অপারেশন বিগবার্ড , ২৫ শে মার্চ , ১৯৭১ - অমি রহমান পিয়াল]

জহিরুল আলম খানের বক্তব্যের সাথে মিলে যায় এরকম আরো ২ টি নিউজ ক্লিপস পাওয়া যায়।
১. এম. এফ . এইচ বেগ এর রিপোর্ট [২৯ মার্চ , ১৯৭১ ,ডেইলী টেলিগ্রাফ ]



এখানে জহিরুল আলম খানের বক্তব্য অনুযায়ী ১টি গুলি হয়েছিলো।
এই ক্লিপসে যেটা পাওয়া যায় মুজাম্মিল রিভলবার বের করার চেষ্টা করেছিলো।
২. সায়মন ড্রিং এর রিপোর্ট [৩০ মার্চ ১৯৭১ , ডেইলী টেলিগ্রাফ]


শেখ মুজিব কে ফোন করে বললে তিনি নিজেই চলে আসতেন এই বক্তব্য এখানেও পাওয়া যায় এবং ১ জন বডিগার্ড কে গুরুতর আহত করা হয়েছিলো সেটাও পাওয়া যায়।


এবিষয়ে অন্য ১টি বক্তব্য দেখুন:

" ২৬ মার্চ ১টায় সেখানে হামলা দেয় পাকিস্তানী কমান্ডো দলের একটি প্লাটুন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার শেখ মুজিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন ঢাকার সর্বত্র যখন চলছে প্রতিরোধ লড়াই, তখন খোদ শেখ মুজিব কোন প্রতিরোধ গড়ে না তুলে, স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পন করলেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে, যদিও হাবিলদার মেজর খান ওয়াজির শেখ মুজিব রুম থেকে পোশাক পরিধিত অবস্থায় বের হতেই তার সাথে অপমানকর আচরণ করে। "
[ সূত্র : সেলিম আহমদ, ব্লাড বিটেন ট্র্যাক: শেখ মুজিবস নাইন মান্থস ইন পাকিস্তান প্রিজন, বুকট্রেডারস, লাহোর, ১৯৯৭]


টাইম ম্যাগাজিনের অদ্ভুত তথ্য:
মার্চ ২৫ , ১৯৭১'র কালোরাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন একটি অদ্ভুত তথ্য দিয়েছে যেটি আগে থেকেই স্যুটকেস গুছিয়ে রাখা শেখ মুজিবের নেতৃত্বযোগ্যতা কে রীতিমত হাস্যস্পদ করে তোলে।
তথ্যটি এতই অস্বাভাবিক শুনতে যে টাইমের মত বিশ্ববিখ্যাত কোন সংবাদ সূত্র না হলে আমি এটি সবার দৃষ্টি গোচর করতাম না।
কেননা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আলোচনা মানেই তথ্যসূত্র নিয়ে রাজায় রাজায় যুদ্ধ আর উলু খাগড়ার প্রাণ যাওয়া।

এই প্রেক্ষিতে এমন কিছু সোর্স অফ ইনফরমেশন আছে যেগুলো মুক্তিযোদ্ধা -রাজাকার , কালা , বোবা , পঙ্গু , সুস্থ্ সবাই বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারে।
তেমনই একটি সোর্স বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন বা "TIME"
যেই পত্রিকার কভার স্টোরী হতে পারলে বিশ্বব্যক্তিত্বরা গদগদ হন।

যাইহোক , মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনের যে কয়টি রিপোর্ট আলোচিত সেগুলো নীচে দেখুন:





এপ্রিল ৫ , ১৯৭১ , টাইম ম্যাগাজিন

অক্টোবর ২৫ , ১৯৭১ , টাইম ম্যাগাজিন

ডিসেম্বর ২০ , ১৯৭১ , টাইম ম্যাগাজিন

ডিসেম্বর ২৭ , ১৯৭১ , টাইম ম্যাগাজিন

এই উল্লেখযোগ্য রিপোর্ট গুলোর পাশাপাশি আরো একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিলো মে ৩ , ১৯৭১ তারিখে।
নীচে দেখুন:


এটি বেশ বড় একটি রিপোর্ট।এর বেশ কিছু অংশ রয়েছে।এর আসল অংশটি দেখুন নীচে:


আশা করি পরিষ্কার ভাবে পড়তে পারছেন।
তবুও বাংলা অনুবাদ করছি:

"নির্মমতার গল্প শেষ হবার নয়।
একটি যুবক বয়সের ছেলে যাকে খোজা হচ্ছিলো সে পাকিস্তানী সেনাদের কাছে মিনতি করছিলো তাকে যা খুশী করা হোক , কিন্তু তার ১৭ বছর বয়সী বোনটাকে যেন ছেড়ে দেয় ওরা!
খান সেনারা ছেলেটাকে ছেড়ে দিলো যাতে সে দেখতে পারে তার সামনেই কিভাবে তার বোনকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে মারা হয়েছিলো।
কর্ণেল আবদুল হাই , একজন বাঙালী ডাক্তার , ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন , তাকে শেষবারের মত একটি ফোন করার সুযোগ দেয়া হয়েছিলো।
একঘন্টা পর তার মৃতদেহ তার বাসায় পৌছে দেয়া হয়েছিলো!
একজন ধার্মিক বৃদ্ধ মানুষ যার কাছে জুমার নামাজ কারফিউর চাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ন ছিলো - মসজিদে হেটে যাবার সময় তাকেও গুলি করে মারা হয়!

ভোররাত ১:৩০ , ২৬ শে মার্চ (যেটাকে আমরা বলি ২৫ শে মার্চের কালোরাত) ২ টি আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) শেখ মুজিবের ধানমন্ডীর বাসায় পৌছালো।
বিশেষ নিরাপত্তা গ্রুপ কমান্ডোরা (Special Security Group Commandos) যখন হাল্কা আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে শেখ মুজিবের বাসার চারপাশ ঝাজরা করে দিচ্ছিলো শেখ মুজিব তখন প্রথমে বিছানার নীচে আশ্রয় নিয়েছিলেন
এরপর কিছুটা শব্দহীন সুনসান সময় কাটলো।
হঠাৎ শেখ মুজিব নীচের তলার বারান্দায় নেমে আসলেন , হাত উত্তোলন করলেন আত্ন সমর্পনের জন্য এবং চিৎকার করে বললেন :
"গোলাগুলি করার প্রয়োজন নাই , আমি এখানে , টেক মি"।
এরপর শেখ মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানে উড়িয়ে নেয়া হয় এবং আতক ফোর্ট নামক কারাগারে অন্তরীণ করা হয়।"

পাকিস্তান আর্মির হাতে আটক হওয়া বিষয়ে শেখ মুজিব নিজে নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিনিধি সিডনি শনবার্গের কাছে যে বক্তব্য দিয়ে গেছেন তার সাথে যা সত্যিকারভাবে ঘটেছে বেশ বড় ফারাক পাওয়া যায়।
এটাই স্বাভাবিক- কারন সেই রাতে সমালোচিত হওয়ার যে কিছু কাজ তিনি করেছিলেন , শুধু তিনি কেন , কোন ব্যক্তিই তা ২য় কোন ব্যক্তির কাছে খুলে বলবেনা , আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের কাছে তো নয়ই।

বরন্চ্ঞ সিডনী শনবার্গের কাছে ২৫ শে মার্চ রাতের সেল্ফ ডিফেন্ডিং রোমান্টিক বিবরন দিতে গিয়ে বেশ কিছু ব্যাপারে তিনি অবচেতন ভাবেই সত্যিকার ঘটনাগুলোর আঁচ দিয়ে ফেলেছেন।








রেড আন্ডার লাইনড করা বাক্য গুলো ফলো করুন।
১.
পরিষ্কারভাবে তিনি বলেছেন যে তিনি চেয়েছেন পাকআর্মি তাকে তার বাসার ভেতরে ঢুকে গ্রেফতার করুক।
২.
তিনিই আবার স্বীকার করেছেন যে তিনি নিজেই কাপড় পাল্টানোর ঘর থেকে বের হয়ে আসেন পাকিস্তানী সেনাদের গোলাগুলির পর।
৩.
হাসিনা , রেহানা , জেলী কে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়া , কামালের ধানমন্ডী ৩২নং ত্যাগ করা এবং বেগম মুজিব , রাসেল ও জামালের থেকে যাওয়ার সত্যতা মিলে যায়।
৪.
শেখ মুজিব যে অপ্রস্তুত রাতের পোশাক পরিহিত অবস্থায় (পান্জ্ঞাবী - লুঙ্গী) গ্রেফতার হননি , বরং তিনি তার চিরাচরিত ফর্মাল পোশাক (পাজামা- পান্জ্ঞাবী আর মুজিব কোট) পরিধিত অবস্থায় আত্নসমর্পনের উদ্দেশ্যে কাপড় বদলানোর ঘর থেকে বের হয়ে আসেন সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়।
৫.
তিনি বলেছেন গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর বেগম মুজিব , রাসেল আর জামাল কে উপরতলার কাপড়বদলানোর ঘরে পাঠিয়ে দেন। এবং তারা মাথা নীচু করে শুয়ে পড়ে মর্টারের আঘাত থেকে বাঁচার জন্য।
কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে সবকিছু মিলিয়ে যেটা বোঝা যায় ঠিক এর পরেই শেখ মুজিব নিজেই কাপড় বদলানোর ঘরের ভেতর থেকে চিৎকার করেন গোলাগুলি আর না করার জন্য। তারমানে ঐ সময়টাতে তিনি নিজেও সেই ঘরে ছিলেন এবং তার স্ত্রী সন্তানরা যেটা করেছিলেন সেরকম কিছু তিনি নিজেও করেছিলেন মাটিতে শুয়ে পড়ার মত।
টাইম ম্যাগাজিনের অদ্ভুত তথ্যটির সত্যতার রেশ এখানে পাওয়া যায়।
৬.
সে সময়টাতে শেখ মুজিব নিজেই বা কেন কাপড় বদলানোর ঘরে গিয়েছিলেন ? পরিষ্কারভাবেই আত্ন সমর্পনের পূর্বে পোশাক পরিধানের জন্য।
৭.
সিডনী শনবার্গকে দেয়া সাক্ষাৎকারে যেটা পাওয়া যায়
"থামাও । গোলাগুলি থামাও , গুলি করছো কেন (১)? আমাকে যদি গুলি করতে চাও তো করো গুলি। আমি তোমাদের সামনে দাড়িয়ে আছি (২) "।

টাইম ম্যাগাজিনে যেটা পাওয়া যায়:
"There is no need for shooting (১) , here I am (২)"
৮.
শেখ মুজিব যে ২৫ শে মার্চের রাতে রাত ১১:০০ টার পর ২৭ শে মার্চ হরতালের ডাক দিয়েছিলেন সেটি তিনি বেমালুম চেপে গিয়েছেন সিডনী শনবার্গের কাছে !
অথচ সেটি অকাট্য সত্য।
ইনএভিটেবল ট্রুথ!
৯.
টাইম ম্যাগাজিনের মতে শেখ মুজিব গোলাগুলির সময় বিছানার নীচে আশ্রয় নেন এবং এরপর কিছুটা সুনসান শব্দহীন সময় কাটে (Then , during a lull)।
এরপরই তিনি কাপড় বদলানোর ঘর থেকে হাত উত্তোলন করে পোশাকপরিধিত অবস্থায় নীচের বারান্দায় নেমে আসেন এবং চিৎকার করেন গোলাগুলি না করার জন্য।
তাহলে ঐ গোলাগুলিমুক্ত শব্দহীন সময়টাতে তিনি কি করেছিলেন?
অতি সম্ভাব্য উত্তরঃ ঐ সময়টাতেই তিনি পোশাক বদলে নিয়েছিলেন।
(পান্জ্ঞাবী-লুঙ্গী পাল্টে পাজামা- পান্জ্ঞাবী মুজিব কোট )

এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে
টাইম ম্যাগাজিনের রিপোর্টৈ প্রকাশিত হয় মে ৩ , ১৯৭১
এবং
সিডনী শনবার্গের কাছে শেখ মুজিব সাক্ষাৎকারটি দেন জানুয়ারী ১৬ , ১৯৭২ যা প্রকাশিত হয় জানুয়ারী ১৮ , ১৯৭২ এ।




অফেন্ডিং মানে চরিত্রহনন নয়।
আমার কাছে অফেন্ডিং মানে সমালোচনা , অসন্তোষ প্রকাশ করা , পরিশুদ্ধতার পাতক দিয়ে ছেঁকে দেখা কতটুকু সঠিক আর কতটুকু সঠিক নয়।
যতটুকু ভুল ততটুকুর জন্য জবাবদিহিতা করা।

২৫ শে মার্চের কালোরাতে শেখ মুজিব কি করেছিলেন এই প্রশ্নে নানা মিথ প্রচলিত। কিছু তার চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে , কিছু তাকে গ্ল্যাডিয়েটর তুল্য বীর্যবান উপস্থাপনের লক্ষ্যে।

৭০ এর নির্বাচনের জোরে শেখ মুজিব তখন
টোকেন অব বাংলাদেশ ,
টোকেন অব রেড-গ্রীন ফ্ল্যাগ ,
টোকেন অব ১৪৪০০০ স্কয়ার মাইলস।
শেখ মুজিবের মেরুদন্ড আনত মানে বাংলাদেশের মেরুদন্ড আনত।
শেখ মুজিবের আত্ন গোপন মানে পুরো জাতির আত্ন গোপনের বিপদ ঘন্টী বেজে যাওয়া।

সেইরাতে শেখ মুজিব কে আটক হতেই হতো।
তাইবলে স্যুটকেস আগে থেকে গুছিয়ে রাখা,
আত্ন গোপনের পূর্ব সিদ্ধান্ত নেয়া এবং শেষ মূহুর্তে সেটা সম্ভব না হওয়া ,
সফেদ সাদা পাজামা-পান্জ্ঞাবী আর মুজিব কোট পরিধানে রেখেই আত্ন সমর্পন করা খুব পরিষ্কার ভাবেই ৭ ই মার্চের বিপ্লবের গর্জনময় শেখ মুজিবকে মরীচিকা করে ফেলে।
আর টাইম ম্যাগাজিনের এই অদ্ভুত তথ্য যেটা কোনভাবেই নাকচযোগ্য নয় সেটি শেখ মুজিবের নেতৃত্বশক্তি কে চরম ভাবে অফেন্ড করে , ধারালো সমালোচনার স্তরে নামিয়ে আনে।
আর এই প্রেক্ষিত থেকেই
শেখ মুজিব ইজ অফেন্ডেড -
১.
কেন আপনি ভীরু কাপুরুষের মত কাপড় বদলানোর ঘর থেকে পোশাক পরিধিত অবস্থায় বের হয়ে নিজে থেকেই হ্যান্ড রাইজ (হাত উত্তোলন) করলেন ?
আপনিতো কেবল ব্যক্তি শেখ মুজিব ছিলেননা ,হাসিনা- রেহানা -জামাল- কামালের পিতা ছিলেন না , ফজিলাতুন্নেসার স্বামী ছিলেন না,
আপনি ছিলেন স্বাধীনতাবিপ্লবের প্রানপুরুষ ,
সুপ্রীম লীডার অব দ্য নেশন।
২.




কেন লজ্জাজনক ভাবে নত মেরুদন্ডে আত্নসমর্পন করার পরও জাতির সেই চরম দুঃসময়টিতে আপনার এরিনমোর তামাক আর পাইপের কথা মনে পড়ে?
সন্তানের মৃত্যুদশায় কি কোন পিতার সিগারেটের নেশা জাগে?
৩.
কেন আপনি সব কিছু জেনেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না দিয়েই আত্নগোপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন (ডিসিশন টু গো আন্ডার গ্রাউন্ড) সেই অনিশ্চিত সময়টাতে নিজের সন্তানতুল্য জাতিকে কামড়োদ্যোত পাকিস্তানী নেড়ী কুকুরের সামনে ফেলে ?

৭ই মার্চ আপনি বলেছিলেন: "আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি "
কোন অযোগ্যতায় , কোন অজুহাতে আপনি হুকুম দিতে পারেননি ২৪ মার্চ সেনা আক্রমনের কথা জেনেও , ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যা ৬ টাতেই সেটা নিশ্চিত জানা সত্ত্বেও , ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর পাওয়া সত্ত্বেও ?


_____________________________________________

পরের কিস্তি:

DOI : ২ টি টেলিফোন , রাত ১২:০০-১:০০ , শেখ মুজিবের ট্রু লাইস : মার্চ ২৬


দৃষ্টি আকর্ষন : অফেন্ডিং মুজিবের কৈফিয়ত : কেন পোস্টটি করা হলো

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ৩:৫০
২৫৯টি মন্তব্য ১৯৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×