somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা ভাষার সংস্কার জরুরী কি?

১২ ই জুন, ২০১১ বিকাল ৩:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এ লেখাটি মূলত মাসিক শিক্ষাবার্তা এপ্রিল-২০১১ সংখ্যায় প্রকাশিত জনাব জাহাঙ্গীর হোসেন-এর “প্রসঙ্গ ২০১১’র বাংলাঃ একটি আধুনিক নিজস্ব ব্যাকরণ ও ভাষা সংস্কার অত্যাবশ্যক” শীর্ষক প্রবন্ধের পেক্ষাপটে লেখা। লেখকের সাথে অনেক বিষয়ে একমত হলেও কিছু বিষয়ে আমার দ্বিমত রয়েছে। লেখাটির মূল বিষয়গুলো তুলে ধরে আমার দ্বিমতের কারণগুলো নিচে তুলে ধরা হলো। মূল লেখাটি পড়তে উপরোক্ত পত্রিকাটি পড়তে পারেন।

প্রথমেই দেখে নিই লেখাটিতে যেসব বিষয়গুলোতে আলোকপাত করা হয়েছে এবং ভাষা সংস্কারের পক্ষে তাঁর উপস্থাপিত কারণগুলোঃ-

 বাংলা ভাষার নিজস্ব কোন আধুনিক ব্যাকরণ নেই। আমাদের বর্তমান যে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রয়েছে তা মূলত সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং কিছুটা ইংরেজী ব্যাকরণের ছোঁয়াও রয়েছে তাতে। এর প্রধান কারণ হল প্রথম দিককার যেসব বাংলা ব্যাকরণগুলো রচিত হয়েছে তার কোনটিই বাঙালির লিখিত ছিল না। রচয়িতাগণ পাণিনীয় ব্যাকরণিক ধারাকে গ্রহণ করেই বাংলা ভাষার ব্যাকরণ প্রণয়ন করেন যা বাংলা ভাষার জন্মের অনেক আগে রচিত। সুনীতিকুমার কিংবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। সংস্কৃত বৈদিক ভাষা থেকে উদ্ভুত কিন্তু বাংলা ভাষা কোন সংস্কৃত ভাষা নয়; সংস্কৃতের মত এর প্রতিটি বর্ণের উচ্চারণও স্পষ্ট নয়। সংস্কৃত লিপি থেকেও বাংলা লিপির রয়েছে বেশ পার্থক্য। সুতরাং সংস্কৃত ব্যাকরণকে বাংলার উপর চাপিয়ে দেয়ায় উচ্চারণসহ বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে।

 আমাদের ণ-ত্ব/ষ-ত্ব বিধান থেকে শুরু করে ক্রিয়ামূল-ধাতু, সমাস ইত্যাদি হুবহু সংস্কৃত ব্যাকরণের ন্যায় হওয়ায় আমাদের শিক্ষার্থীদের মুখস্ত করা ছাড়া উপায় থাকে না।

 বাংলা ব্যাকরণের রূপতত্ত্ব ও বাক্য তত্ত্বকে সময়োপযোগী ও কম্পিউটার-ইন্টারনেটের ব্যবহার উপযোগী করার জন্যে বাংলা বর্ণগুলোকে ল্যাটিন-ইংরেজী হরফে ব্যবহারের চিন্তা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিনি মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়ার উদাহরণ দিয়েছেন।

 তিনি বাংলা বর্ণমালার অনুচ্চারিত ধ্বনিবিশিষ্ট বর্ণগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বর্ণগুলো হল-ণ, ঞ, ষ, শ, ঈ, ঊ, ড়, ঢ়, ঋ, য, ঁ। এছাড়াও ঘ, ঢ, ধ, ভ বর্ণগুলোর অপ্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি দাবী করেছেন।

 বাংলা সংখ্যাগুলোর অনেকগুলো (২-2, ৪-8, ৭-9) ইংরেজী-ল্যাটিন সংখ্যার মতই দেখতে তাই অনেক সময়ই সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়া ৫ এবং ৬ হাতে লিখলে অনেক সময়ই একইরকম হয়ে যায়। তাই এগুলোর পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন।

 এছাড়া যুক্তবর্ণগুলোকে তুলে দিয়ে তার পরিবর্তে বর্ণগুলোকে উচ্চারণ অনুযায়ী ভেঙে লেখার পক্ষে মত দিয়েছেন।

বাংলা ভাষা সংস্কারের দাবি তুলে তার লেখাটিতে অনেক ক্ষেত্রেই বেশ যুক্তিসংগত কারণ তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষার বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার দাবীগুলো কতখানি যৌক্তিক তা বিচার করে দেখা যাক।

 বর্তমানে বাংলা ভাষায় রচিত ও প্রকাশিত বই-পত্রিকা-ম্যাগাজিন ইত্যাদির রয়েছে এক সুবিশাল ভাণ্ডার, যার বেশিরভাগই নতুন করে মুদ্রণ একেবারেই অসম্ভব একটি কাজ। একথা লেখকও নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। লেখকের উপস্থাপিত কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ ছিল যে কোমলমতি শিশু থেকে সবারই বেশ কিছু ব্যাকরণ নীতি, বানানরীতি ইত্যাদি হুবহু মুখস্থ করতে হচ্ছে যা বর্তমান সময়ের শিক্ষানীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু লেখকের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী ভাষা সংস্কার করলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ব প্রকাশিত বইগুলো কিভাবে পড়তে শিখবে? পড়তে হলে তাদেরকে বর্তমান ভাষারীতি তো শিখতেই হবে সাথে পূর্বটাও শিখতে হবে। ধরে নিলাম যে বর্তমান ভাষারীতিটি শিশুদের সহজাতভাবেই আয়ত্তে আসবে, তাহলেও পূর্ব ভাষারীতি, বানাননীতি তাদেরকে মুখস্থ করতে হবে। তা না হলে তারা সে জ্ঞান থেকে একেবারেই বঞ্চিত হবে।

 এটা ঠিক যে আমরা মুদ্রা থেকে ণ কিংবা তালু থেকে শ উচ্চারণ করতে পারি না, ড়, ঢ় ইত্যাদি বর্নগুলোর ধ্বণিগুলোও আমরা সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারি না, তাই বলে যে আমরা ঘ, ঢ, ধ, ভ এগুলোও উচ্চারণ করতে পারি না এমন নয়। আমরা ধানকে দান বলি না, ভাতকে বাত বলিনা, ঘরকে গর বলি না। সুতরাং একেবারেই কম প্রচলিত বর্ণগুলো যেমন ঈ, ঊ, ঞ, ঋ, ড়, ঢ়, ঁ ব্যবহার তুলে দিলেও দেয়া যেতে পারে বলে মনে করি কিন্তু ঘ, ঢ, ধ, ভ বর্ণুগলো তুলে দেয়ার চিন্তাকে অযৌক্তিক বলতে হয়। প্রথমোক্ত কারণেই ঈ, ঊ, ঋ, ঞ, ড়, ঢ়, ঁ বর্ণগুলো বর্ণমালা থেকে তোলা সম্ভব নয়, কেবল নতুন করে ব্যবহার বন্ধ করা যেতে পারে। ণ, শ, ষ এর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম চালু করা যেতে পারে বলে মনে করছি।

 বাংলা বর্ণমালাকে ল্যাটিন-ইংরেজী হরফে লেখার ক্ষেত্রে তার যুক্তিটি বেশ অদ্ভুত লেগেছে। বর্তমানে বাংলা ইউনিকোডে লেখা যায় এবং ট্রান্সলিটারেশন দিয়ে অন্য ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করা যায়। বর্তমানে ইন্টারনেটে বাংলার ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং দিন দিন ক্রমশ বাড়ছে। বাংলা ভাষায় ব্যবহারোপযোগী সফটওয়্যারও তৈরি হচ্ছে। সুতরাং তার এই যুক্তিটিও মেনে নেয়া যায় না।

 বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বেশকিছু যুক্তবর্ণের ব্যবহার বেশ ঝামেলাপূর্ণই বটে। ক্ষ কখনো খ-এর মত কখনো খ্‌খ-এর মত উচ্চারিত হয়। এছাড়া ক্ষ, ক্ষ্ম ও হ্ম যুক্তবর্ণগুলো দেখতে প্রায়ই একইরকম। এরকম আরো কিছু বর্ণ রয়েছে। তাই এগুলোসহ অন্য যুক্তবর্ণগুলোরও সংস্কার আবশ্যক। কিন্তু সংস্কারের পূর্বে ভেবে দেখতে হবে যে এতে ঝামেলা কমবে নাকি বাড়বে ?

 সংখ্যার সংস্কার করাটা খুবই যুক্তিসংগত। মোবাইল ব্যবহারের বদৌলতে বর্তমানে শিক্ষিত অশিক্ষিত প্রায় সবাইই ইংরেজী-ল্যাটিন হরফের সংখ্যাগুলো চিনতে পারে। বাংলা সংখ্যাগুলোকে ইংরেজী-ল্যাটিন হরফ দিয়ে লেখার ব্যবস্থা করলে কারো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। চীনসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ব্যবস্থা চালু আছে।

সর্বোপরি আমাদের যেটা ভাবতে হবে আমরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। আমাদের রয়েছে একটি ভাষাগত জাতিসত্তা। সংস্কারের ফলে আমাদের ভাষাটির যে পরিবর্তন হবে তার সাথে আমরা কতখানি খাপ খাইয়ে নিতে পারব। আমাদের দেশটা খুব ছোট হলেও এখানে বাংলা ভাষার বেশ কয়েকটি কথ্য রূপ রয়েছে। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে আমরা যে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলাম তা আসলে বাংলার একটি প্রমিত রূপই, কোন কথ্যরূপ নয় এবং তখনকার সময়ে যে প্রমিত রূপটি ছিল সেটা থেকে অনেক বেশি বিচ্যুতি আমাদের ভাষাগত ঐতিহ্যকে হুমকির মুখে ফেলবে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। যেহেতু বর্তমানে আমাদের ভাষার এই রূপটি একটি সুবিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে বিস্তৃত, তাই বাংলা ভাষার উৎসগত রূপ তথা উচ্চারণগত রূপ যাই হোক না কেন তার আমূল সংস্করণ ভাষাটির সৌন্দর্য বিনষ্ট করতে পারে। এ ছাড়াও একই সাথে যদি পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার সংস্কার না হয় তা দুই দেশের সংস্কৃতিতে আরো বেশি দূরত্ব তৈরি করবে। ইতোমধ্যেই দুই দেশে দুটি বানানরীতি চালু রয়েছে, রয়েছে বাংলা ক্যালেন্ডারের পার্থক্যও; যা আমাদের দুই দেশের সাংস্কৃতিক দূরত্ব বাড়িয়ে তুলছে। সুতরাং লেখকের সাথে সুর মিলিয়েই বলছি বাংলা ভাষার যে কোন সংস্কার করা হলে তা দু’দেশ মিলিত হয়েই করতে হবে। তা না হলে বাংলা ভাষার দুটো মেরুকরণ সৃষ্টি ভাষাটির আরো বিস্তৃতি রোধ করবে যা বাঙালি হিসেবে আমরা মোটেই চাই না।
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×