পুর্বকথা ঃ
আমাকে হত্যা করার সিদ্ধান্তটি নেন আমার বাবা ।
১
শহরে গল্পগ্রস্ত মানুষের অভাব হয়না কখনও । বুকের গহীন কোণায় একটা গল্প নিয়ে এই শহরে ঘুরে বেড়ায় মুখোশ অভিনেতারা । কেউ কেউ কোনও একদিন কোনও জোনাকি পোকার দেখা পেয়ে যায়, কান পেতে সেইসব গল্প শুনবার জন্য । আর কারও কারও বুকে ঘুন পোকা বাসা বাঁধে , সেই গল্প খাওয়ার অফুরান কষ্ট জমে রয় পলকতলে । শাহানা ভেবেছিলো সে প্রথম দলের । রাশেদকে সে জোনাকি পোকা ভেবেছিলো । ভেবেছিলো, ভয় পাওয়া কলসিতলা অন্ধকারে হৃদয় পুড়িয়ে আলো হবে রাশেদ । কেনই বা ভাববে না, রাশেদও তো স্মৃতি কারিগর ছিলো । সেও তো বলেছিলো, আমি তোমার হাসির সমান সুখী । তোমার কান্না সমান মৃত । বলেছিলো, আমি তোমার ভালোবাসার সমান পাগল । তোমার দূরত্ব সমান একা । তাই তারা আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল রেখে বদলে দিতে চেয়েছিলো হাতের রেখা । যাবতীয় কাঁটাতারের বেড়া ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলো আবেগের আগ্নেয়গিরি উত্তাপে । অথচ উড়ে যেতে যেতে বলে নাগরিক চড়ুই, এমন সুখ সইবে না । কিন্তু সে তো ঈর্ষার বিষ লাগানো সূচলো বল্লম । হয়না এমন তো হয়না , কলম পিষে পিষে বলে কবি । সেও তো হতাশাবাদি কবির চিরন্তন শব্দের ধোঁকাবাজি । পৃথিবীর সব লাল নীল কাগজের চশমা পরা প্রেমিক প্রেমিকার মতো সাহানা আর রাশেদও ভেবেছিলো এমন। ভেবেছিলো, পাঁজর ভেঙ্গে কলজে চুরি হয়না কোনওকালে । কিন্তু হায়, একদিন এমনকি নক্ষত্রও পথ হারিয়ে মরে যায় । একদিন গাংচিলও কেঁদে কেঁদে জীবনানন্দের কবিতায় বেদনা জাগায় ।
২
এইটুকু বলে থামলেন দেবদূত । আমি বললাম, তারপর ??
দেবদূত হাসলেন । বললেন, তুমি কি জানো কেনও এই গল্প তোমাকে বলা হচ্ছে ??
আমি বললাম, জি জানি । আগামীকাল আমাদের সবাইকে একটি চিঠি লিখতে হবে ।
দেবদূত বললেন, হ্যাঁ , আজকের গল্প শুনে তুমি যা ভাববে সেটাই লিখতে হবে ।
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম , বললাম, তারপর ??
৩
তারপর একরাত । সে রাতে চাঁদ উঠেছিলো কিনা রাশেদ কিংবা শাহানা কারই মনে নাই । ছোট ছোট শব্দেরা পাশাপাশি হেঁটে গিয়েছিলো কিনা তাও খেয়াল নেই কারও । শুধু জানে শরীরের কোনও অন্তঃমহলে উঠেছিলো তীব্র উৎসব । বেহিসেবিকাল পুরানো এক আবেগিয় ঝঙ্কার বেজেছিলো প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে । তার না ফেরানো স্বাদ খুন করে শারীরিক বেড়াজাল । নির্ভীক সুখের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় মরে যায় অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ । শুধু শরীরের নবীন হালখাতায় রয়ে যায় কিছু স্মৃতিচিহ্ন । স্মৃতি চিহ্ন রয়ে যায় শরীরের নাম না জানা অন্তঃস্থলে । খুব গোপনে ।
৪
আমি দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি । শঙ্খে লুকানো ঝিনুকের মতো চুপচাপ ।
খাম খোলা চিঠি ঃ মা , তোমাকে
মা, জানি এই চিঠি কোনোদিন তোমার কাছে পৌঁছাবে না । তবুও লিখছি, দেবদূত বলেছেন, আমাদের রোজকার খেলার মতো এটাও একটা খেলা ।জানো মা,আমাদের স্বর্গে নানারকম খেলার ব্যবস্থা আছে । এইসব খেলায় আমাদের সবসময় আনন্দে রাখার চেষ্টা করা হয় । কারণ, স্বর্গে আনন্দেই থাকতে হয় । আমিও ছেলেভুলানো খেলায় এতদিন সব ভুলে ছিলাম । গতকাল আমাকে আমার জন্মপরিচয় জানানো হয়েছে । এটাই নিয়ম । একদিন আমাদের সবার জন্ম পরিচয় জানতে দেওয়া হবে । জন্মপরিচয় জেনে আমার কি অনুভূতি সেটা লিখে রাখতে হবে । আজকের খেলা এটাই । দেবদূত বলেছেন, এই খেলাতেই আনন্দ হবে । কিন্তু কিভাবে আনন্দ হবে এখনও বুঝতে পারছি না । আমার কেবলই বিষাদ লাগছে ।
তোমারও কি এমন বিষাদ লেগেছিল যখন আমাকে তোমার কাছে থেকে ছিন্ন করা হলো ?? ডাক্তারের কাছে আমি ছিলাম শুধুই রক্তপিণ্ড , সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে স্রেফ অভিধানের একটা শব্দ, ভ্রূণ । কিন্তু আমি তো তোমার অস্তিত্বর অংশ ছিলাম । তোমার বিষাদ কি আমার চেয়েও বেশি ছিলো?? তাই কি আমাকে আলাদা করতে চাওনি তুমি কোনোভাবেই?? আমি শুনেছি , তুমি অনর্গল কেঁদে গেছো । আমাকে রক্ষা করতে বার বার ছুটেছ বাবার কাছে । বারবার করুণা ভিক্ষা করেছো , কিন্তু বাবা তার এক রাতের আবেগকে দীর্ঘ করতে চাননি । আমাকে হত্যা করার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন । খুব ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়েছিলেন তোমাকে, কেনও আমার পৃথিবীতে আসার প্রয়োজন নেই । দেবদূত বলেছেন, তুমি বাবাকে কখনও ক্ষমা করোনি । বলেছেন, হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে তুমি বাবাকে বলেছো, আমার সন্তান তোমাকে কখনও ক্ষমা করবে না । মা, তুমি ভুল বলেছো । স্বর্গের শিশুরা কারও উপরে রাগ, ক্ষোভ রাখেনা । স্বর্গের শিশুরা মানবীয় ত্রুটির উর্ধে । আমাদের স্রেফ আনন্দিত থাকার নিয়ম ।
কিন্তু আজ নিয়ম ভেঙ্গে বিষণ্ণতা চেপে বসছে বারবার । জানো, এখানে আমাদের জন্য রয়েছে অসংখ্য দেবদূত । আছে মিষ্টি ঝর্না , অনেক পবিত্রতম নদী, অপূর্ব সব ফুল আর গানের পাখি । চোখ ধাঁধানো পরীরা এসে আদর করে দিয়ে যায় ইচ্ছে হলেই । এখানে শুধু একজন মা নেই । আমি জানিনা , মা এর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে কেমন লাগে । জানিনা , মা স্পর্শ করলে কেমন লাগে । জানিনা মায়ের বুকে ঘুমিয়ে যাওয়ার শান্তি কত । কোনোদিন জানবোও না, মা ডাকতে কেমন লাগে । আজ এসব ভেবে সবকিছু কেমন এলেমেলো হয়ে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে, এইসব আনন্দ সমাহার নয়, শান্তিময় জীবন নয় । তোমাকে জড়িয়ে থাকায় সব। মা, আমার খুব তোমার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে ।
স্বর্গ যদি সব ইচ্ছে পূরণের জায়গা হয় তাহলে তবে এই ইচ্ছে কেনও পূরণ হবে না বলতে পারো??
শেষকথা
আশ্চর্য! চিঠি শেষে আনন্দ শুরু হওয়ার কথা । অথচ আমার কেবলই বিষাদ লাগে!