প্রায়ই লেখা-পড়া ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করে। দূরগামী কথার ভিতর থেকে কথা বলতে, মহাকালের কোনো না কোনো চিন্তার ভিতরে ঢুকে চিন্তা করতে ভালো লাগে। সারাক্ষণ মনে হয়, কালীদাসের মেঘদূতের সাথে পার্বতীর কাছে উড়ে যাই।
আপনারা কেউ জানেন? কালীদাস ভারতের কোন অঞ্চলে জন্মেছিলেন? তিনি বিদ্যার জন্য কালী দেবীর দাস হতে গিয়েছিলেন কেন? দুর্গাদাস কিংবা সরস্মতীদাস হলে ভালো হতো না? ওরা তো দেখতেও সুন্দরী। লোকটা দেবদাস না হয়ে কেন যে, দেবীদাস হয়েছিলেন? জানি না। বাল্মিকী সাহেবের কথাও মনে পড়ে। ওনার নাম উচ্চারণ করতে কেমন জানি লাগে। ওনার নাম বাংলা করলে চুল্মিকী, হ্যা চুল্মিকী অথবা কেশ্মিকী হয়। তার সৃষ্ট চরিত্র রাম-রাবনরা এখন দোর্দন্ড প্রতাপেই আছেন। এই চুল্মিকী সাহেবই প্রথম, নায়িকা অপহরনের গল্প বলেছেন। তিনি রাবনকে দিয়ে সীতাকে অপহরণ করিয়েছিলেন। সীতাই প্রথম অবরোধবাসিনী। তার কাহিনীকে এদিক ওদিক করে এখন কত কত সিনেমা হয়। এই চুল্মিকীর কারনেই অযোধ্যায়ও যুদ্ধ হয়।
রামায়ন, মহাভারত, পদ্মাবতী, মেঘনাদবধ কাব্য সবই হয়তো একদিন সাতটি তারার তিমিরে হারিয়ে যাবে কিংবা পুড়ে যাবে মহাশশ্মানে। অথবা কংশের জলে ভেসে যাবে। তার পরেও আমরা কোনো ভাবেই যেন অকৃতি অধম না হই। তারা তো কম করেও কিছু দেয়নি।
সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে। থাকে শুধু প্রেম, প্রেম এবং প্রেম। প্রেম একটি ধর্মের নাম। রাধা-কৃষন, লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, বেহুলা-লক্ষীন্দর। এরা সবাই প্রেম ধর্মের অবতার, দেব-দেবী। তাদের বানী-বাক্যের মূল কথা হচ্ছে, বাকা দুই নয়নে নিশা তখনো লাগতো, এখনো লাগে। এখনো আঙ্গুরলতা নন্দকে ভালোবাসে। নিন্দার কাটা তখনো পায়ে বিধতো, এখনো বিধে। তার পরেও যমুনায় জল আনতে রাধারা যাবেই। পিড়িতি শিখাইয়া তখোনো কেউ না কেউ ছেড়ে যেত, এখনো যায়। তখনো বিরহে মানুষ গেয়ে উঠতো, আমার বন্ধু দয়াময়, তোমারে দেখিবার মনে লয়। কোনো একদিন যদি ধানসিড়ি নদীটি মরেও যায়, হলুদ রঙের পা-ওয়ালা শালিখ আর একটিও অবশিস্ট না থাকে, তার পরেও এই রুপসী বাংলায় বনলতা সেনদের জন্য জীবননান্দদের জন্ম হতেই থাকবে। বনলতা সেনরাও পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে বলবেই, এতো দিন কোথায় ছিলেন? কেউ কথা না রাখলেও, বংগদেশের প্রেমিকরা নীলবরণ কাগজে বন্ধুর নামটিই লিখবে। শুধু বন্ধুর নামটিই লিখবে। নিশাচর ভবঘুরে মেস নিবাসী হিমুদেরকে কোনো না কোনো অসম্ভব রুপবতী রুপারা এসে জিজ্ঞেস করবেই, তোমার চোখ এত লাল কেন? তোমার চোখ এত লাল কেন? মুয়ুরাক্ষী নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে হিমুরা রুপাদের সারপ্রাইজ দিয়ে বলবে, এই দেখ তোমার জন্য এনেছি সাতটি অমরাবতী। সাতটি অমরাবতী।
পরবাসে দূরদেশে থাকি। এখানেও পুস্পে পুস্পে ভরা শাখি, কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি। এই দেশের কাননেও অলি আসে। তারাও ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে, ফুলের মধু খেয়ে। বাতায়ন খুলে রাখি। বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না এসে যদি ফিরে যায়। এমনিতেই ঘাটে নদী নাই। অনেক নদী মরে গেছে। মনে পড়ে যারে, সে আছে পরানের গহীন ভিতরে। আমি কোথায় পাবো তারে? একা একা গুন গুন করে গাই, ভালো আছি, ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো। বাল্যকালের সেই সব দিনরাত্রীতে ফিরে যাই, ফুলের গন্ধে ঘুম না আসা রাতে, হাসি-খেলা শেষ না হওয়া দিনে। আব্বুর কথা মনে পড়ে, আম্মুর কথা মনে পড়ে। দেশের কথা মনে পড়ে। দেশের কথা মনে পড়ে। দেশের কথা মনে পড়ে।