সকাল এগারোটা, টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুল ঝারছি। চায়ের কাপ হাতে মা এসে বললেন, খবর শুনেছিস শুভ্রা?
কী খবর?
মাহবুবকে বাড়িতে এনেছে।
অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। মা থেমে থেমে বললেন, ভালো মন্দ যা খেতে চায় ডাক্তাররা খাওয়াতে বলেছে। মায়ের দিকে তাকাতে পারছি না। তারপরেও তাকালাম, মায়ের চোখে জল টলমল। নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে বললাম, ছি: মা, কাঁদেন কেন?
মা স্বাভাবিক গলায় বললেন, না, কাঁদি না তো। নে চা’টা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
মা অশ্রু লুকাতে পারছেন না, আঁচলে চোখ মুছছেন। মায়েরা কত রকমের দু:খ পুষে রাখে!
এত কিছুর পরে মাহবুবের কথা ভেবে কি আর কাঁদতে আছে? হয়তো আছে। আমারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে, থামাতে পারছি না। বাথরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। কিন্তু দু:খ কি ধুয়ে ফেলা যায়? নিজেকে একটু গুছিয়ে বের হতেই দেখি আকাশ ভরা মেঘ। চারিদিক কেমন অন্ধকার।
এ আমার কেমন দিন? শরীর মণ কোনোটাই ভালো নেই। মাহবুবের খবরটা তিন চারদিন আগেই শুনেছি। একদম যেতে ইচ্ছে করেনি বা একবারও দেখতে ইচ্ছে করেনি তা নয়। খুউব দেখতে ইচ্ছে করেছে। যদিও এমনটা হওয়ার কথা না। পৃথিবীতে কাউকে ঘৃনা করলে মাহবুবকেই করি। তারপরেও দেখতে ইচ্ছে করছে। যার প্রতি এত ঘৃনা, তাকে আবার দেখার কি আছে? কিন্তু ঘৃনা তো মানুষ তাকেই করে, যাকে অনেক ভালোবাসতো।
দু’পা হেটে রিকশা নিলাম। আড়িয়াল খাঁর পাশ ধরে যাচ্ছি। নদীর বুকে পালতোলা নৌকায় কত রকমের সুখ দু:খ দুলছে! প্রায় ভর দুপুরে মাহবুবদের বাড়িতে পৌঁছালাম। কত দিনের চেনা ঘর-বাড়ি, কেমন অচেনা লাগছে। বাড়ি ভর্তি মানুষ কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না। মাহবুবের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। দরজায় গিয়ে আর পা চলে না। কিছুতেই চৌকাঠ পেরুতে পারছি না। অথচ এই ঘরটিতেই একদিন আমাদের বাসর হয়েছিল। পরদিন জ্বর...। মাঝখানের ছ’সাত মাস বাদ দিলে এখানেই তো নয় দশটা বছর কেটেছে। সেই রড আয়রনের খাট, কচ কচ শব্দ, ফিসফিস করে কথা বলা দিনগুলি।
কত স্মৃতি! প্রথম চিঠি পাঠালো বইয়ের মধ্যে, সে তো চিঠি নয় যেন এক শিল্প কর্ম। কী কারুকাজ, কী নিপুন হাতে লেখা! এক পৃষ্ঠার চিঠিতে ষোলোটি বক্সের এক ম্যাট্রিক্স। ‘দেবী’ সম্বোধনে লেখা। একটা চিঠি এতখানি মুগ্ধ করতে পারে, কোনোদিন ভাবতেই পারিনি।
কী উদ্ভট সব কান্ড করতো! তখন ক্লাস টেন এ পড়ি। একটা গাধা নিয়ে স্কুলে হাজির। পকেটে সিঁদুর আর রেজর। জয়নাল স্যার বিএসসি’র মাথায় রক্ত উঠে গেল। কিন্তু মাহবুবকে কে ঠেকায়? প্রাকটিক্যালে ‘গাধার কপালে সিঁদুর লাগানো পরীক্ষণ’ করবেই করবে। মার’টাও খেয়েছিল। জোড়া বেতের পিটুনীতে জ্বরে পড়লো, বেশ কিছু দিন স্কুলে আসতে পারেনি। তারপর আবার পাগলামি...। নানান ধরনের পাগলামি! চৈত্র মাসের এক ভর দুপুরে মাঠের মধ্যে ঠায় দাড়িয়ে চিৎকারে করে বললো--
শুভ্রা তোমাকে ভালোবাসি।
লজ্জায় মরে যাবার যোগাড়। কয়েকদিন পর জিজ্ঞেস করলাম, কতখানি?
কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে কিছুই না বলে চলে গেল। কিন্তু মাথায় ঢুকলো, কিভাবে ভালোবাসা মাপার যন্ত্র বানানো যায়? কী পাগল ছেলে! সেই মাহবুব এখন মুমূর্ষু। আহা: একবার মনে হচ্ছে ছুটে যাই, আবার মনে হচ্ছে না থাক। কিন্তু ওর হাতটা খুউব ধরতে ইচ্ছে করছে। ঐ হাত ধরেই তো একদিন কৃষ্ণপক্ষের রাতে ঘর ছেড়েছিলাম।
দুয়ার ধরে দাড়িয়ে আছি। মাহবুব অচেতন, শিয়রে ক্লান্ত অল্প বয়ষ্কা এক অভাগী। মাহবুবের মলিন মুখখানি চোখে পড়তেই বুকের মধ্যে কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠলো। আহারে! এমন করুন মুখ কখনই দেখতে চাইনি। এই মানুষটাই একদিন বলেছিল--
শুভ্রা, তোমাকে ছাড়া বাচঁবো না।
মাহবুবের স্ত্রীর শীতল দৃষ্টি আমাকে ছাড়িয়ে অন্য দিগন্তে। অমন দৃষ্টি কি উপেক্ষা করা যায়? তাই না দেখার মতো করে মাহবুবকে আরেক বার দেখলাম। বিশ্বাসের বাঁধন ছেড়া সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল। কত রকম কথার ছলে সত্য গোপন করতো! আবার মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতো, বুঝেছো? উত্তরে বলতাম--
যা বললে তার অধিকাংশই বুঝিনি। যা বলোনি তার অনেকখানিই বুঝেছি।
মাহবুবের চেহারায় চিন্তার ভাঁজ, শ্বাস-প্রশ্বাসে ছেদ পড়তো। বিশ্বাসের ফাটল কি চোখে না পড়ে পারে? কিন্তু মানুষ কি এতটাই বদলায়? বদলায়। নষ্টামি করার আগেই মানুষ নষ্ট হতে থাকে। আমার বাচ্চা-কাচ্চা না হওয়ায় ওর হতাশাটা বুঝতাম। কিন্তু আমারও কি দু:খ কম ছিল? মাস চারেক আগে যেদিন জানলাম আমি অন্ত:স্বত্ত্বা সেদিনই মাহবুবের বিয়ের খবরটা পেলাম। জীবনের শ্রেষ্ঠতম সুসংবাদটি ঐ ভয়ংকর দু:সংবাদই খেয়ে ফেললো। নিজের জন্য, সন্তানের জন্য ভীষণ মায়া হলো। বুকের মধ্যে কেমন জানি হু হু করে উঠলো। দুরে কোথাও, সেদিন অনেক দুরে চলে যেতে ইচ্ছে করেছিল।
গর্ভের সন্তান আর মাহবুবের জন্য আজ গভীর বিষাদে মনটা ভারী হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদি। যে চলে যাচ্ছে তার জন্য, যে আসবে তার কথা ভেবে আরেক বার...।
--[শাখাওয়াৎ নয়ন]